কিন্তু ফেলুদার সেই ঝোলাটা?
আমার মাথার পিছনে, কাচের সামনের তাকষ্টায়! ঝোলার স্ট্র্যাপটা আমার গালের পাশ অবধি ঝুলে আছে।
মিডনাইট, পাশ থেকে বলে উঠলেন জটায়ু। আমি আড়াচোখে দেখলাম ওঁর চোখ এখনও বোজা।
মিডনাইট, মা!!–জয় মা, মা সন্তোষী!…মিডনাইট…
বকো মৎ! পাশের লোক শাসাল।
আবার ঝিমুনি। আবার অন্ধকার। গাড়ির শব্দ মিলিয়ে এল…
এর পর আবার যখন চোখ খুলল। তখন মন বলছে দেখব কোনও মন্দিরের ভিতর বসে। আছি। না, মন্দির না-গিৰ্জা। এ তো পিতলের দিশি ঘণ্টা নয়। এ-সুর বিলিতি!
কিন্তু দেখলাম। এটা মন্দির নয়। এটা বৈঠকখানা। মাথার উপর ঝাড় লণ্ঠন, তবে সেটা জ্বলছে না। ঘরে আলো বেশি নেই–কেবল একটা ল্যাম্প। সেটা একটা মখমলে মোড়া সোফার পাশে একটা টেবিলের উপর রাখা। আমিও বসে আছি মখমলের সোফায়। বসে না; আধ-শোয়া। আমার পাশেই লালমোহনবাবু। তাঁর চোখ বন্ধ। আমার ডান দিকে পরের সোফাটায় বসে আছে ফেলুদা। তার মুখ গভীর। তার কপালের ডান দিকে একটা অংশ কালো হয়ে ফুলে আছে। বাঁয়ে আমাদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে একটা লোক, যাকে আমরা পেয়ারেলাল বলে চিনি। তার হাতে রিভলভার। কোল্ট৩২। নির্ঘাত ফেলুদারটা।
আরও তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দিকে মুখ করে। কেউ কোনও কথা বলছে না। কথা বলার লোক বোধহয় এখনও আসেনি। আমাদের সামনে সবচেয়ে যে বড় সোফা, যার মখমলের রং কালো, সেটা এখনও খালি। মনে হয় সেটা কারুর অপেক্ষায় রয়েছে। বোধহয় মিস্টার চৌধুরী। কিন্তু এটা আলিপুরের কোনও হালের বাড়ি নয়। এ বাড়ি আদ্যিকালের। এর সিলিং বিশ হাত উঁচু। লোহার কড়িবারগা। এর দরজা দিয়ে ঘোড়া ঢুকে যায়।
আরও আছে। ঘড়ি। ঝুলোনো আর দাঁড়ানো ঘড়ি। তার মধ্যে একটা প্রায় দেড় মানুষ উঁচু, আমার ডান দিকে। এই ঘড়িগুলোই বাজছিল একটু আগে। এখনও মাঝে মাঝে বেজে উঠছে। রাত দুটো।
ফেলুদার সঙ্গে একবারই চোখাচৌখি হয়েছে। ওর চোখের ভাষাটা আমি জানি বলেই ভরসা। পেয়েছি। ওর চোখ বলছে ঘাবড়াসনি, আমি আছি।
গুড মার্নিং, মিস্টার মিটার।
বিলিতি নিয়মে রাত বারোটার পরেই মর্নিং।
ভদ্রলোককে দেখতে পাইনি, কারণ ল্যাম্পের ঠিক পিছন দিকের দরজা দিয়ে ঢুকেছেন। এখনও মখমল। আগের বার যা দেখেছিলাম তার চেয়েও বেশি। না হবার কোনও কারণ নেই। এখন উনি আপ, ফেলুদা ডাউন।
ওতে কী আছে। পেয়ারেলাল? ওটা সার্চ করা হয়েছে ভাল করে?
ভদ্রলোকের চোখ গেছে ফেলুদার ঝোলার দিকে। ওটা যে কখন ফেলুদার কাছে চলে গেছে জানি না।
পেয়ারেলাল জানাল যে ওতে বই খাতা আর ছবি ছাড়া আর কিছু নেই। একটা বোতল ছিল, সরিয়ে রাখা হয়েছে।
কিছু মনে করবেন না। এইভাবে ধরে আনার জন্য-গলায় একটু বেশি পালিশ দিয়ে ফেলুদাকে উদ্দেশ করে কথাটা বললেন মিঃ চৌধুরী। ভাবলাম পেরিগ্যাল রিপিটার সম্পর্কে যখন আপনার এতই কৌতুহল, তখন জিনিসটা আমার হাতে এসে পড়ার মুহূর্তে আপনি থাকলে হয়তো খুশিই হবেন।-কেয়া বলওয়ন্ত, সাফা হুয়া ঘড়ি?
একজন ভৃত্য মাথা নেড়ে বলল, ঘড়ি সাফা হয়ে এল, এক্ষুনি আসবে।
টু হান্ড্রেড ইয়ারস গ্রেভের মধ্যে পড়েছিল, বললেন মিঃ চৌধুরী।উইলিয়াম এ কথাটা আগে আমাকে বলেনি। বলেছে তার কাছে পেরিগ্যাল ঘড়ি আছে। অথচ আনিব-আনব করে দেরি করছে। তারপর চাপ দিতে বলল ঘড়ি আছে মাটির নীচে তাই দেরি হচ্ছে। ডেডবডির পাশে পড়েছিল। তাই বললাম বুরুশ দিয়ে ঝাড়ন দিয়ে সাফা না করে আমার কাছে আনবে না। ভেটিলের পোঁছ দিয়ে দেবার কথাও বলেছি।
ফেলুদা সটান চেয়ে আছে মিঃ চৌধুরীর দিকে। মুখ দেখে তার মনের ভাব বোঝার উপায় নেই। আমাদের ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করেছিল; ওকে মাথায় বাড়ি মেরে।
আপনি কোখেকে জানলেন এ ঘড়ির কথা মিঃ মিটার? প্রশ্ন করলেন মহাদেব চৌধুরী।
উনবিংশ শতাব্দীর একটা ডায়রি থেকে। যার ঘড়ি তার মেয়ের ডায়রি।
ডায়ারি? চিঠি না?
না, ডায়রি।
মিঃ চৌধুরী তার বিলিতি সিগারেটের প্যাকেটটা বার করেছেন পকেট থেকে, আর সেইসঙ্গে সোনার লাইটার আর সোনার হোল্ডার।
আপনার সঙ্গে উইলিয়ামের পরিচয় নেই? হাল্ডারে সিগারেট ঢোকালেন মিঃ চৌধুরী।
উইলিয়াম নামে আমি কাউকে চিনি না।
ফস্ করে মিঃ চৌধুরীর ডানহিল। লাইটার জ্বলে উঠল।
তা হলে ওই ডায়রি পড়েই আপনার ঘড়িটার উপর লোভ হয়েছিল?
লোভ জিনিসটা তো আপনার একচেটিয়া, মিঃ চৌধুরী।
মখমলের উপর মেঘের ছায়া। দুই আঙুলে ধরা হান্ডারটা ঈষৎ কাঁপছে।
আপনি মুখ সামলে কথা বলবেন, মিঃ মিটার!
সত্যি কথা বলতে আমি মুখ সামলাই না, মিঃ চৌধুরী। আমার উদ্দেশ্য ছিল ঘড়ি যাতে গডউইনের কবরেই থাকে; আপনার মতো লোকের হাতে—
ফেলুদার কথা শেষ হল না। একজন লোক হাতে একটা সিস্কের রুমালের উপর একটা জিনিস। এনে মিঃ চৌধুরীকে দিল। চৌধুরী জিনিসটা হাতে তুলে নেবার সঙ্গে সঙ্গে আমার পাশ থেকে একটা গোঙানির শব্দ উঠিল—
আঁ… আঁ… আঁ… আঁম্…
লালমোহনবাবুর জ্ঞান হয়েছে, আর হয়েই মিঃ চৌধুরীর হাতের জিনিসটা দেখেছেন। জিনিসটা তিনি খুব ভাল করেই চেনেন।
মিঃ চৌধুরীর অবস্থা যে কী হল সেটা আমার পক্ষে লিখে বোঝানো খুব মুশকিল। ফেলুদাকেই বলতে শুনেছি যে গানের সাত সুর আর রামধনুর সাত রঙের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে, কিন্তু একটা মানুষের গলায় আর মুখে এত কম সময়ে এত রকম সুর আর এত রকম রং খেলতে পারে সেটা ভাবতে পারিনি। গালাগাল যা বেরোল মানুষটার মুখ দিয়ে সেটা শোনা যায় না, বলা যায় না, লেখা যায় না। ফেলুদা অবিশ্যি নির্বিকার। আমি বুঝতে পারছি এটা তারই কীর্তি, কাল যখন দুপুরে দশ মিনিটের জন্য সে গোরস্থানে ঢুকেছিল তখনই সে এ কাজটা করে এসেছে। কিন্তু আসল ঘড়ি কি তা হলে নেই?