কী ইয়ে?
গোরস্থানে মিডনাইট তো!—তাঁর একটা বিশেষ ইয়ে আছে। কোথায় যেন পড়িচি।
তখনই ভূত বেরোয়?
লালমোহনবাবু কয়েকবার এক্স এক্স বলে শেষের বার এক্স-এর সটাকে সাপের মতো কিছুক্ষণ টেনে রেখে চুপ মেরে গেলেন। আমার পাশে একটা প্রায়-শোনা-যায়-না খচ শব্দ থেকে বুঝলাম ফেলুদা হাতের আড়ালে দেশলাই জ্বালাল। তারপর হাতের আড়ালেই একটা চারমিনার ধরিয়ে হাতের আড়ালেই টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল।
আকাশে মেঘ বাড়ছে। গাড়ির আওয়াজ হাওয়া। হাওয়ার আওয়াজ হাওয়া। সব সাড়া, সব শব্দ শেষ। কাছের বিপ্লবি ঠাণ্ডা! আমার শরীর ঠাণ্ডা, গলা শুকনো। ঠোঁট চোটে ঠোঁট ভিজাল না।
চী-এর পরে একগাদা ঋ-ফলা দিয়ে একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল। এক সঙ্গে দুটো থাপ্নড়ের আওয়াজে বুঝলাম। লালমোহনবাবু হাত দিয়ে হাইম্পিডে কানি ঢাকলেন। ফেলুদা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
একটা গাড়ি থেমেছে। কতদূরে, সেটা এত রাত্রে বোঝা যাবে না। দরজা বন্ধর শব্দ। মন বলছে শব্দটা উত্তরে পার্ক স্ট্রিট থেকে নয়, পশ্চিমের রীড়ন স্ট্রিট থেকে। ওদিকে গেট নেই, পাঁচিল আছে; পাচিলের উপর কাচ বসানো।
আমাদের চোখ তবু লোহার গেটের দিকে। লালমোহনবাবু মুখ খুলতে যাচ্ছিলেন, ফেলুদা আমার কাঁধের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে ওঁর কাঁধে চাপ দিয়ে থামিয়ে দিল।
কিন্তু কেউ তো আসছে না গেটের দিকে।
হয়তো গাড়ি অন্য কোথাও অন্য কারণে থেমেছে! কত বাড়ি তো রয়েছে চারপাশে। হয়তো কেউ নাইট-শো দেখে ফিরল। আশা করি তাই, তা হলে আর এ-গাড়িটা নিয়ে ভাববার কিছু থাকে না।
ফেলুদা কিন্তু সটান দাঁড়িয়ে আছে, পিছনের দেয়ালের সঙ্গে সেঁধিয়ে। তার সামনেই একটা থাম। চারিদিকে বাদুড়ে অন্ধকার। কেউ দেখতে পাবে না। আমাদের।
কিন্তু আমরা তাদের দেখব কী করে? যদি তারা এসে থাকে?
দেখবার দরকার নেই। একটু পরেই সেটা বুঝতে পারলাম। চোখের দরকার নেই। কাজ করবে। কাম।
ঝুপ…ঝুপ…ঝুপ…ঝুপ…
মাটি খোঁড়ার শব্দ। কিছুক্ষণ চলল শব্দ। আমরা রুদ্ধশ্বাসে শুনছি।
ঝুপ…কুপ…
শব্দ থেমে গেল।
একটা আলো! দুরে দুটো ওবেলিস্কের ফাঁক দিয়ে ঘাসের উপর ক্ষীণ আলো। প্রতিফলিত আলো।
আলোটা স্থির নয়-দুলছে, নড়ছে, খেলছে। টর্চের আলো।
এবার নিভে গেল।
পাঁচিল টপকে এসেছে দাঁত চিপে মন্তব্য করল ফেলুদা। তারপর বলল, ফিলো করব। বুঝলাম আবার গাড়ির আওয়াজের অপেক্ষা করছে ফেলুদা।
এক মিনিট।
দু মিনিট, তিন মিনিট, চার মিনিট।
ষ্ট্রেঞ্জ! বলল ফেলুদা!
কোনও শব্দ আসছে না। আর পার্ক স্ট্রিট থেকে। রাড়ন স্ট্রিট থেকেও না। যে গাড়িটা এসেছিল। সেটা থেমেই আছে। তা হলে?
আরও দু মিনিট গেল। আবার মেঘে ফাটল। চাঁদ বেরোল। কেউ কোথাও নেই।
ধর এটা–
ফেলুদা তার ঝোলাটা আমায় দিয়ে ঘাসে নামল। যেদিকে আলোটা দেখেছিলাম সেদিকে এগিয়ে গেল। ভয় নেই-ওর পকেটে কোল্ট ৩২। মন বলছে। শিগগিরই তার গর্জনে এই গোরস্থানের জমাট নিস্তব্ধতা খান-খান হতে চলেছে। কিন্তু -পা যে খোঁড়া ওর! সামান্য হলেও খোঁড়া। কেন যে সর্দারি করে নিজে জুতো সারাতে গেল জানি না।
কিন্তু কই? কোল্টের গর্জন?
ভুল করলেন, ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন জটায়ু। তোমার দাদা ভুল করলেন।
আর যেন কথা না বলেন। তাই আমি জিভে দিয়ে সাপের শব্দ করে ওকে থামিয়ে দিলাম! ফেলুদা কয়েক পা এগিয়ে গিয়েই অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। কী ঘটছে ওই সমাধিস্তম্ভগুলোর মধ্যে কিছুই বুঝতে পারছি না। একটা শব্দ পাওয়া গেল কি? কানের ভুল নিশ্চয়ই।
মিডনাইট? এটা কোন ঘড়ি? সেন্ট পলস? হাওয়া ওদিক থেকেই। পশ্চিমে হাওয়া হলে রাত্তিরে আলিপুরের চিড়িয়াখানার সিংহের গর্জন শোনা যায় আমাদের বালিগঞ্জের বাড়ি থেকে।
ওই যে গাড়ির শব্দ।
দরজা বন্ধ হল। স্টার্ট নিল। তারপর হুস।
আর বসে থাকা যায় না! ভয় করছে না; শুধু ভাবনা।
উঠে পড়লাম দুজনেই। লালমোহনবাবুর বিড়বিড়ানিতে কান দেব না; সময় নেই।
এগিয়ে গেলাম দ্রুত পায়ে। মেরি এলিসের কবর। কবরের দেয়ালে হাত ঘষে ঘষে এগোচ্ছি। জটায়ু আমার শার্ট খামচে আছেন পিছন থেকে। পায়ের তলায় ঘাস এখনও ভিজে, এখনও ঠাণ্ডা।
জন মাটিনের কবর। সিনথিয়া কোলেট। ক্যাপ্টেন এভানস। এবার একটা ওবেলিস্ক। কালো ফলকের উপরে—
খচ্–
পায়ের তলায় কী জানি পড়ল। মৃদু শব্দ করে চোপটে গেল। পা সরিয়ে নীচের দিকে চাইলাম। চাঁদের আলো রয়েছে। হাতে তুলে নিলাম জিনিসটা।
চারমিনারের প্যাকেট।
খালি না। অনেক সিগারেট রয়েছে ভিতরে। সব চ্যাপটা। ফেলুদা—
আর কিছু মনে নেই।–কেবল মুখের উপর একটা চাপ, আর লালমোহনবাবুর এক চিলতে আর্তনাদ।
» ১২. পুরীর সমুদ্রের ধারে
জ্ঞান হয়ে প্রথমেই মনে হল পুরীর সমুদ্রের ধারে রয়েছি। এত হাওয়া সমুদ্রের ধারেই হয়। কান ঠাণ্ডা, নাক ঠাণ্ডা, চুল উড়ছে।
কিন্তু জল কোথায়? বালি? ঢেউ কোথায়? এ গর্জন তো ঢেউয়ের গর্জন নয়; এ তো চলন্ত গাড়ির শব্দ। অন্ধকারের মধ্যে খোলা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছি আমরা। গাড়ির পিছনে বসে আছি আমি। আমি মাঝখানে, ডান পাশে লালমোহনবাবু, বাঁয়ে যে লোক তাকে চিনি না, দেখিনি কখনও সামনে ড্রাইভারের মাথায় পাগড়ি, তার পাশে আরেকটা লোক। কেউ কথা বলছে না।
একটু মাথা তুলতেই পাশের লোকটা ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। আধা-গুণ্ড টাইপের চেহারা। কোনও ধমক দিল না। কেন দেবে? আমাদের ভয় করার তো কোনও কারণ নেই। আমাদের কাছে কোনও হাতিয়ার নেই। হাতিয়ার ফেলুদার কাছে। সে এ গাড়িতে নেই। সে কোথায় জানি মা!