জোবুস হল জোবের ল্যাটিন সংস্করণ, বলল ফেলুদা। পুরো লেখাটাই ল্যাটিনে সেটা বুঝতে পারছেন না?
ল্যাটিন-ফ্যাটিন জানি না মশাই; ইংরেজি নয় এটা বুঝতেই পারছি। নামের উপর ডি-ও—এম লেখা কেন?
ডি-ও—এম হচ্ছে ডমিনুস অমনিউম ম্যাজিস্টের। অর্থাৎ ঈশ্বর সকলের কর্তা। আর তার নীচে যে কথাগুলো রয়েছে তার একটার প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করি। Marmore! মৰ্মর-সৌধ জানেন তো? সেই মর্মর আর এই মারমোরে একই জিনিস-মার্বল। আর আরও মজা হচ্ছে এই যে, মর্মর কথাটা সংস্কৃত নয়, ফারসি। অথচ সৌধ হল সংস্কৃত। এইভাবে সংস্কৃত-ফারসি সংস্কৃত-আরবি আমরা দিব্যি জোড়া লাগিয়ে চালিয়ে দিই। যেমন, শলাপরামর্শ। শল্যা হল সলাহ–অর্থাৎ পরামর্শ, ফারসি কথা: পরামর্শ সংস্কৃত। বা কাগজপত্র-কাগজ আরবি, পত্র সংস্কৃত। তারপর আবার—
ফেলুদার লেকচার শেষ হল না, কারণ কথা নেই বার্তা নেই উঠল এমন এক ধুলোর ঝড় (জটায়ু বললেন প্রলয়ঙ্কর) যেমন আমি আর কোনওদিন দেখিনি। আমরা পড়ি-কি-মারি করে লালমোহনবাবুর সবুজ অ্যামবাসডরে গিয়ে উঠলাম, আর ড্রাইভার হরিপদবাবু গাড়ি ছুটিয়ে দিলেন এসপ্ল্যানেডের দিকে। এই প্রথম দেখলাম ধুলোর জন্য অকাটার—থুড়ি—শহিদ মিনারটা আর দেখা যাচ্ছে না। হাওয়ার তেজ কত বুঝতে পারছি না। কারণ গাড়ির কাচ তুলে দেওয়া হয়েছে। তবে এটা দেখলাম যে, চানাচুরওয়ালারা যে সরু লম্বা বেতের মোড়ার মতো স্ট্যান্ডের উপর তাদের জিনিসপত্র রাখে, তারই একটা গড়ের মাঠের দিক থেকে শূন্য দিয়ে পাক খেতে খেতে উড়ে এসে আমাদের ঠিক সামনে একটা চলন্ত ডবল ডেকারের দোতলায় আছড়ে পড়ে পরীক্ষণেই আবার ছাড়া পেয়ে কার্জন পার্কের দিকে উড়ে গেল।
পার্ক স্ট্রিটের কাছাকাছি এসে দেখি ট্রাম বন্ধ, কারণ একটা দেবদারু গাছ ভেঙে লাইনের উপর পড়েছে, ফেলুদার ইচ্ছে ছিল আমাদের পার্ক স্ট্রিটের পুরনো গোরস্থানটা দেখিয়ে নিয়ে যাবে, কিন্তু সেটা আর এই ঝড়ের জন্য হল না! যদি যেতাম, তা হলে হয়তো একটা ঘটনা চোখের সামনে দেখতে পেতাম।–যেটার বিষয় পরদিন সকালে কাগজে বেরোল। চব্বিবশে জুনের এই প্রলয়ঙ্কর ঝড়ে (উইন্ড ভেলসিটি ওয়ান হান্ড্রেড অ্যান্ড ফটিফাইভ কিলোমিটার্স পার আওয়ার) সাউথ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানে একটা গাছ ভেঙে পড়ে নরেন্দ্ৰনাথ বিশ্বাস নামে এক গ্রৌঢ় ভদ্রলোককে গুরুতরভাবে জখম করে। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অবিশ্যি তিনি সন্ধ্যাবেলা এই আদ্যিকালের গোরস্থানে কী করছিলেন সে খবর কাগজে লেখেনি।
০২. দুপুরের অর্ধেকটা বাদলার উপর দিয়েই গেল
পরদিন সকাল আর দুপুরের অর্ধেকটা বাদলার উপর দিয়েই গেল। ফেলুদা কেথেকে জানি একটা ১৯৩২ সালের ক্যালকাটা অ্যান্ড হাওড়ার ম্যাপ জোগাড় করেছে; দুপুরে খিচুড়ি আর ডিম ভাজা খেয়ে পান মুখে পুরে একটা চারমিনার ধরিয়ে ও ম্যাপটার ভাঁজ খুলল। সেটাকে মাটিতে বিছনোর জন্য টেবল চেয়ার সব ঠেলে দেয়ালের গায়ে লাগিয়ে দিয়ে মেঝের মাঝখানে ছ-ফুট বাই ছ-ফুট জায়গা করতে হল। ম্যাপের উপর হামাগুড়ি দিয়ে আমরা কলকাতার রাস্তাঘাট দেখছি, ফেলুদা বলছে রাজনী সেন খুজিস না, এ অঞ্চলটা তখন জঙ্গল, এমন সময় জটায়ু এলেন। আজ আর ধুতি-পাঞ্জাবি নয়, গাঢ় নীল টেরিকটের প্যান্ট আর হলুদে বুশ শার্ট। ছিয়াত্তরটা গাছ পড়েছে কালকের ঝড়ে ঢুকেই ঘোষণা করলেন ভদ্রলোক। আর আপনার কথা রেখেছি মশাই, এখন আর হর্ন শুনলে হিন্দি ফিল্মের কথা মনে পড়বে না।
আজ তাড়া নেই, তাই চা খেয়ে বেরোনো হল। ছিয়াত্তরটা গাছ পড়ার খবর কাগজে পড়ে বিশ্বাস হয়নি, কিন্তু পার্ক স্ট্রিট থেকে নিজের চোখে উনিশটা গাছ বা গাছের ডাল পড়ে থাকতে দেখলাম, তার মধ্যে সাদার্ন এভিনিউতেই তিনটে। তাও তো এর মধ্যে কত ভালপালা সরিয়ে ফেলা হয়েছে কে জানে।
গোরস্থানের গেটের সামনে যখন পৌঁছলাম (এখানে আসছি সেটা ক্যামাক স্ট্রিটের আগে ফেলুদা আমাদের বলেনি) তখন জটায়ুর দিকে চেয়ে দেখি তাঁর স্বাভাবিক ফুর্তি ভাবটা যেন একটু কম। ফেলুদা তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিতে ভদ্রলোক বললেন, একবার এক সাহেবকে কবর দিতে দেখেছিলুম—ফর্টিওয়ানে— রাঁচিতে। কাঠের বাক্সটা গর্তে নামিয়ে যখন তার উপর চাবড়া চাকড়া মাটি ফেলে না—সে এক বীভৎস শব্দ মশাই।
সে শব্দ এখানে শোনার কোনও সম্ভাবনা নেই, বলল ফেলুদা।এই গোরস্থানে গত সোয়াশো বছরে কোনও মৃতব্যক্তিকে সমাধিস্থ করা হয়নি।
গেট দিয়ে ঢুকতেই ডাইনে দারোয়ানের ঘর। দিনের বেলা যে-কেউ এ গোরস্থানে ঢুকতে পারে, তাই দারোয়ানের বোধহয় বিশেষ কোনও কাজ নেই। তবে হ্যাঁ, বলল ফেলুদা। একটা ব্যাপারে একটু নজর রাখতে হয়-যাতে সমাধির গা থেকে কেউ মার্বেলের ফলক খুলে না। নেয়। ভাল ইটালিয়ান মার্বেল বাজারে বিক্রি করলে বেশ দু পয়সা আসে।–দারোয়ান!
দারোয়ান ঘর থেকে বেরিয়ে এল। দেখে বলে দিতে হয় না সে বিহারের লোক, খৈনিটা মনে হয়। সবেমাত্র পুরেছে মুখে।
কাল এখানে একজন বাঙালিবাবু জখম হয়েছেন-মাথায় গাছ পড়ে?
হাঁ বাবু।
সে জায়গাটা দেখা যায়?
উয়ো রাস্তাসে সিধা চলিয়ে যান—একদম এন্ড তক। বাঁয়ে ঘুমলেই দেখতে পাবেন। অভিতক পড়া হুয়া হ্যায় পেড়।
আমরা তিনজন ঘাস-গজিয়ে-যাওয়া বাঁধানো রাস্তাটা দিয়ে এগিয়ে গেলাম। দুদিকে সমাধির সারি-তার এক-একটা বারো-চোদ্দো হাত উঁচু। ডাইনে কিছু দূরে একটা সমাধি প্রায় তিনতলা বাড়ির সমান উঁচু। ফেলুদা বলল, ওটা খুব সম্ভবত পণ্ডিত উইলিয়াম জোনস-এর সমাধি, ওর চেয়ে উঁচু সমাধি নাকি কলকাতায় আর নেই।