আমি অবাক হয়ে প্রথম পাতাটার দিকে চেয়ে আছি। আর উলটোতে সাহস পাচ্ছি না, কারণ বুঝতে পারছি পাতাগুলো ঝুরঝুরে হয়ে আছে। ফেলুদা বলল, অ্যারাকিস এ খাতা খুলেছিল।
কী করে জানলে?
খাতার পাতা অসাবধানে উলটালেই পাতার উপরের ডান দিকের কোণ আঙুলের চাপে ভেঙে যায়। এই দ্যাখ-
ফেলুদা একটা পাতা অসাবধানে উলটে দেখিয়ে দিল।
আর শুধু তাই না, বলে চলল ফেলুদা, এই ফিতেটা দ্যাখ! কয়েক জায়গায় ক্ষয়ে গেছে— একশো বছরের উপর গেরোবাঁধা অবস্থায় থাকার জন্য। কিন্তু ওই ক্ষয়ে যাওয়া জায়গা ছাড়াও দ্যাখ। এই দুটো জায়গায় ফিতে কেমন পাকিয়ে গেছে। এটা হচ্ছে টাটকা নতুন গেরোর জন্য। যে খুলেছে সে তত হিসেব করে ঠিক একই জায়গায় গেরো বাঁধেনি; সেটা করলে ধরা মুশকিল হত।
তোমার আঙুলে কালো দাগ কেন?—এটা আমি ঘরে ঢুকেই লক্ষ করেছি।
এটা আরেকটা ক্লু, বলল ফেলুদা। এটা বোঝানোর সময় পরে আসবে। দাগটা লেগেছে ওই নাস্যির কৌটোটা থেকে।
কী জানলে ওই ডায়েরি পড়ে? আগ্রহে আমার প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
টম গডউইনের শেষ বয়সের কথা, বলল ফেলুদা। একটা পয়সা হাতে নেই, খিটখিটে মেজাজ। এক ছেলে মরে গেছে, অন্য ছেলে ডেভিড়ের উপর কোনও বিশ্বাস নেই, কোনও টান নেই। কাউকে ট্রাস্ট করে না, এমনকী নিজের মেয়ে শার্লটকেও না। কিন্তু শার্লট তবু তার পরিচর্যা করে, তাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, ভগবানের কাছে তার মঙ্গল প্রার্থনা করে। জুয়ায় সর্বস্ব গেছে টমাস গডউইনের, শার্লট নিজে সেলাইয়ের কাজ করে আর কার্পেট বুনে কলকাতার মেমসাহেবদের কাছে বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে। গডউইন লখনী-এর নবাবের কাছে দামি জিনিস যা পেয়েছিল সব বিক্রি করে দিয়েছে, কেবল তিনটি জিনিস ছাড়া। এই কাসকেট, এই নস্যির কৌটো-যেটা সে আগেই শার্লটকে দিয়েছিল–আর তৃতীয় হল সাদতের কাছে পাওয়া তার প্রথম বকশিশ।
সেটাও শার্লটকে দিয়ে গেছিল?
না। সেটা সে কাউকে দেয়নি। মারা যাবার আগে সে মেয়েকে বলে গিয়েছিল, সেটা যেন তার কফিনের মধ্যে পুরে তাঁর মৃতদেহের সঙ্গে কবর দেওয়া হয়। শার্লট তার বাপের ইচ্ছা পূরণ করে। মনে শান্তি পেয়েছিল।
সেটা কী জিনিস?
শার্লটের ভাষায়—ফাদারস প্রেশাস পেরিগ্যাল রিপিটার।
সেটা আবার কী?
এখানে ফেলু মিত্তিরও ফেল মেরে গেছে রে তোপ্সে। ডিকশনারিতে বলছে রিপিটার বন্দুক বা পিস্তল হতে পারে, আবার ঘড়িও হতে পারে। পেরিগ্যাল হয়তো কোম্পানির নাম। সিধু, জ্যাঠাও শিওর নন। তুই ঘুম থেকে ওঠার আগে ওর বাড়িতে ঢু মেরে এসেছি। দেখি, বিকাশবাবু যদি আলোকপাত করতে পারেন।
পার্ক স্ট্রিটে একটা নিলামের দোকান আছে; নাম পার্ক অ্যকশন হাউস। সেখানে বিকাশ চক্রবর্তী বলে এক ভদ্রলোক কাজ করেন যাঁর সঙ্গে ফেলুদার খুব আলাপ। একটা কেসের ব্যাপারে ফেলুদাকে ওখানে যেতে হয়েছিল বার কয়েক, তখনই চেনা হয়।
এই সেদিনও দোকানটার পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখেছি অনেক পুরনো ঘড়ি সাজানো রয়েছে। আমার মন বলছে। ওটা বন্দুক-টন্দুক নয়, ঘড়ি।
লালমোহনবাবু আসার আগে অবধি ফেলুদা শার্লট গডউইনের ডায়রি থেকে অনেক ঘটনা বলল। শার্লটের এক ভাইঝি বা বোনঝিরও কথা নাকি আছে ডায়রিতে। শার্লট তাকে উল্লেখ করেছে মাই ডিয়ার ক্লেভার নীস বলে। সে নাকি কোনও কারণে তার ঠাকুরদাদাকে অসন্তুষ্ট করেছিল, কিন্তু মারা যাবার আগে টিম গডউইন তাকে ক্ষমা করে তাঁর আশীবাদ দিয়ে যান। শার্লটের দুই ভাই ডেভিড আর জনের কথাও ডায়রিতে আছে। ডেভিডের সমাধি আমরা সাকুলার রোডের গোরস্থানে দেখেছি। জন বিলেতে গিয়ে আত্মহত্যা করেন; কেন সেটা শার্লট জানতে পারেননি।
লালমোহনবাবু এসে বললেন, কাল সকাল অবধি দোটানার মধ্যে ছিলুম,-পুলকের জন্য ভক্তিমূলক গল্প লিখি, না আপনার সঙ্গে ভিড়ে পড়ি। কালকের কাণ্ডকারখানার পর আর দ্বিধা নেই। খ্রিল ইজ বেটার দ্যান ভক্তি। সেই বাক্সে কিছু পেলেন?
একটা সোয়াশো বছরের পুরনো ডায়রি থেকে জানলাম যে, টমাস গডউইনের কবর খুঁড়লে তুয়তো একটা পেরিগ্যাল রিপিটার পাওয়া যেতে পারে।
কী পিটার?
চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক। পেট্টিল কত আছে?
দশ লিটার ভরসুম তো আজ সকালেই।
গুড। ঘোরাঘুরি আছে!
পার্ক অকশন হাউসে ঢুকেই ফেলুদার ভুরুটা কুঁচকে গেল।
আসুন, মিস্টার মিত্তির।!! কী সৌভাগ্য আমার। কোনও নতুন কেস-টেস নাকি?
বিকাশবাবু এগিয়ে এসেছেন। বেশ চকচকে নাদুসনুদুস চেহারা, গাল ভর্তি পান। কেন জানি দেখলেই মনে হয় নর্থ ক্যালকাটার লোক।
আপনার যে সৌভাগ্য সে তো দেখতেই পাচ্ছি, বলল ফেলুদা।এই সেদিন দেখলাম গোটা আষ্টেক ছোট বড় ঘড়ি সাজানো রয়েছে; এর মধ্যেই সব বিক্রি হয়ে গেল?
কেন? কী ঘড়ি চাই আপনার? ওয়াল ক্লক? অ্যালার্ম ক্লক?
ফেলুদা তখনও এদিক ওদিক দেখছে। বিকাশবাবুকে দেখে কেন জানি মনে হচ্ছিল যে উনি ওই খটমট নামওয়ালা ঘড়ির বিষয় কিছু জানবেন না। ফেলুদার প্রশ্ন শুনে বললেন, রিপিটার বোধহয় এক রকমের অ্যালাির্ম ঘড়ি। তবে পেরিগ্যাল ঠিক বুঝলাম না। তা ঘড়ির বিষয়ে জানার জন্য তো খুব ভাল লোক রয়েছে। তার বাড়িতে শুনেছি আড়াইশো রকম ঘড়ি আছে। ঘড়িপাগলা লোক আর কী।
কার কথা বলছেন?।
মিস্টার চৌধুরী। মহাদেব চৌধুরী।
বাঙালি?
বাঙালি হলেও মনে হয় পশ্চিম-টশ্চিমে মানুষ। ভাঙা-ভাঙা বলেন বাংলা। বেশির ভাগ ইংরিজিই বলেন। এলেমদার লোক। আগে বম্বে ছিলেন, এখন কলকাতায় এয়েছেন। আর এসেই, যা পাচ্চেন—একটু ভাল হলেই—কিনে নিচ্ছেন। অবিশ্যি পুরনো হওয়া চাই। আপনি যে বলচেন এখানে ঘড়ি দেখচোন না, তার বেশির ভাগই আপনি দেখতে পাবেন ওর বাড়িতে গেলে। আর লোকটা জানেও। আপনি একবারটি গিয়ে কথা বলে দেখুন না। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল–দেখেননি?