ল্যান্ডিং-এ এসে ফেলুদা যেটা করল সেটা আমাকে হকচাকিয়ে দিল, লালমোহনবাবুর যে কী দশা হল সেটা অন্ধকারে বুঝতে পারলাম না। ফেলুদা নীচে না গিয়ে সটান তিনতলায় রওনা দিল।
আপ-ডাউন গুলিয়ে ফেললেন নাকি? ব্যস্তভাবে প্রশ্ন করলেন জটায়ু। উত্তর এল, চলে আসুন, ঘাবড়াবেন না।
উপরে উঠেই সামনে লুঙ্গি পরা দারোয়ান।
আপ কিসকো মাংতে হ্যায়?
আমি শুধু তোমার প্রয়োজন মেটাতে এসেছি ভাই!
ফেলুদা অ্যারাকিস সাহেবের দারোয়ানের দিকে একটা পাঁচ টাকার নোট এগিয়ে দিয়েছে। লোকটা থাতমত। ফেলুদা তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, তোমার মনিব যে-ঘরে বসেছেন। সেটা এখন চারদিক থেকে বন্ধ কি না সেটা আগে বলো।
ওষুধ ধরেছে বোধহয়। চাকর বলল কারান্দার দিক থেকে বন্ধ, কিন্তু শোবার ঘর দিয়ে দরজা আছে ঢোকার; সেটা খোলা।
তোমার কোনও চিন্তা নেই—কিছু করতে হবে না—শুধু একবারটি শোবার ঘরটা দেখিয়ে দাও। নইলে বিপদ হবে। আমরা পুলিশের লোক। ইনি দারোগা।
লালমোহনবাবু পায়ের বুড়ো আঙুলে দাঁড়িয়ে হাইটটা ঝাঁট করে দু ইঞ্চি বাড়িয়ে নিলেন। এ ল্যান্ডিং-এ বাতি আছে। ফেলুদা নোটটা আর একটু এগিয়ে একেবারে দারোয়ানের হাতের তেলোতে ঠেকিয়ে দিল। তেলোটা আপনা থেকেই নোটের উপর মুঠো হয়ে গেল।
আইয়ে—লেকিন…
লের্কিন-টেকিন ছাড়ো ভাই! তোমার মনিবের বন্ধুদের একজনের ওপর পুলিশের সন্দেহ, তাই যাওয়া দরকার। তোমার সাহেবের বা তোমার কিচ্ছু হবে না।
আইয়ে।
শোবার ঘর অন্ধকার, আর তার একটা খোলা দরজার ওদিকে যে ঘর, সেও অন্ধকার। আমরা তিনজনে সেই দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
প্ল্যানচেটের ঘর থেকে এখন কোনও শব্দ নেই। তবে একটু আগে পর পর তিনবার টেবিলের পায়ের শব্দ পেয়েছি। বুঝতে পারছি ভূত নামানোর ক্লাবের সদস্যরা সব দম বন্ধ করে টমাস গডউইনের আত্মার জন্য অপেক্ষা করছেন। লালমোহনবাবু এত জোরে আর এত দ্রুত নিশ্বাস ফেলছেন যে ভয় হচ্ছে তাতেই পাশের ঘরের সবাই আমাদের অস্তিত্ব টের পেয়ে যাবে। ফেলুদা ইতিমধ্যে বোধহয় দরজার আরও কাছে এগিয়ে গেছে। কোথেকে যেন কেরোসিন তেলের গন্ধ আসছে। একবার শুনলাম একটা বেড়াল ম্যাও করল। বোধহয় দোতলার সেই কালো হুলোটা।
ট—মাস গডউইন! ট—মাস গডউইন।
গোঙানির মতো স্বরে নামটা দুবার উচ্চারিত হল। বুঝলাম। এইভাবেই এরা আত্মাকে ডাকে।
আর ইউ উইথ আস? আর ইউ উইথ আস?
কোনও সাড়া নেই, কোনও শব্দ নেই। প্রায় আধ মিনিট হয়ে গেল। তারপর আবার সেই কাতর প্রশ্ন–
টমাস গডউইন.আর ইউ উইথ আস?
ইয়ে-স! ইয়ে-স!
আমার ডান পাশেও পায় ঠক ঠক করে কাঁপছে। টেবিলের নয়, মানুষের। লালমোহনবাবুর হাঁটু।
ইয়েস। আই হ্যাভ কাম! আই অ্যাম হিয়ার!
হিয়ার বললেও মনে হয় বহু দূর থেকে আসছে গলার স্বরটা।
প্ল্যানচেটের দল আবার প্রশ্ন করল।
তুমি কি সুখে আছ? শান্তিতে আছ?
উত্তর এল-নো-ও!
কী দুঃখ তোমার?
প্রায় আধ মিনিট সব চুপ। তারপর আবার প্রশ্ন করল অ্যারাকিসের দল।
কী দুঃখ তোমার?
আই…আই…আই…ওয়ন্ট মাই…আই ওয়ন্ট মাই…কাসকেট।
এর পরেই একসঙ্গে কতকগুলো অদ্ভুত ব্যাপার। পাশের ঘর থেকে এক ভয়াবহ চিৎকার, আতঙ্কের শেষ অবস্থায় যেটা হয়—আর পরমুহূর্তেই আমার হাতে একটা হ্যাঁচকা টান আর কানের কাছে ফিসফিস—চলে আয়, তোপ্সে!
অ্যারাকিসের চাকর আমাদের তিনজনকে ছুটে বেরোতে দেখে যেন আরও হতভম্ব হয়ে কিছুই করল না। এক মিনিটের মধ্যে তিনজনে রিপন লেন পেরিয়ে রয়েড ষ্ট্রিটে রাখা আমাদের গাড়িটার দিকে এগোতে লাগলাম।এ এক খেল দেখালেন মশাই বললেন লালমোহনবাবু। এ জিনিস ফিল্মে দেখালে সুপারহিট।
লালমোহনবাবুর তারিফের কারণ আর কিছুই না; ফেলুদার হাতে এসে গেছে সাদত আলির দেওয়া টমাস গডউইনের আইভরি কাসকেট।
০৭. ফেলুদা নিজেই আমাকে তার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছে
পরদিন সকাল। ফেলুদা নিজেই আমাকে তার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছে। কাল রাত্রে লালমোহনবাবু আমাদের নামিয়ে দিয়ে যাবার পর আধা ঘণ্টার মধ্যে স্নান-খাওয়া সেরে ফেলুদা তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। সত্যি বলতে কী, রাত্রে আমার ভাল করে ঘুমাই হয়নি। বেশ বুঝতে পারছি যে আমরা একটা আশ্চর্য রকম প্যাঁচালো রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়েছি! এ গোলকধাঁধার কাছে লখনী-এর ভুলভুলাইয়া হার মেনে যায়। কোন দিকে কোন রাস্তায় যেতে হবে জানি না, সব ভরসা ফেলুদার উপর। অথচ ফেলুদা নিজেই কি ভুলভুলাইয়া থেকে বেরোনোর পথ জানে?
ফেলুদা তার ঘরে খাটের উপর বসে, তার সামনে টমাস গডউইনের বাক্স, তার ভিতরের জিনিস খাটের উপর ছড়ানো। দুটো তামাক খাবার সাদা পাইপ-তেমন পাইপ আমি কখনও চোখেই দেখিনি; একটা রুপোরা নাস্যির কোটো; একটা সোনার চশমা, আর চারটি লাল চামড়ায় বাঁধানো খাতা–তার প্রত্যেকটার মলাটে সোনার জল দিয়ে লেখা ডায়রি। খাতাটা যে সিস্কের কাপড়ে বাঁধা ছিল সেটা বিছানার উপরেই পড়ে আছে, আর তার পাশে পড়ে আছে নীল ফিতেটা। ফেলুদা একটা খাতা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, খুব সাবধানে প্রথম পাতাটা উলটে দ্যাখ।
এ কী! এ যে শার্লট গান্ডউইনের খাতা!
১৮৫৮ থেকে ৬২ পর্যন্ত। যেমন মুক্তোর মতো হাতের লেখা, তেমনি স্বচ্ছন্দ ভাষা। কাল সারা রাত ধরে পড়ে শেষ করেছি। কী অমূল্য জিনিস যে রিপন লেনের অন্ধকূপের মধ্যে এতকাল পড়েছিল, তা ভাবা যায় না।