স্যান্ডউইচের প্লেট এসে পড়ায় আর কথা এগোল না। আমাদের তিনজনেরই খিদে। পেয়েছিল বেশ জবর। একসঙ্গে দু জোড়া স্যান্ডউইচে একটা বিশাল কামড় দিয়ে তিনবার চোয়াল খেলিয়েই লালমোহনবাবু কেন জানি থমকে গেলেন। তারপর গোল গোল চোখ করে দুবার পর পর ঈশ্বরের জয়… ঈশ্বরের জয় বললেন, যার ফলে মুখ থেকে কয়েকটা রুটির টুকরো ছিটকে বেরিয়ে টেবিলের ওপর পড়ল।
ব্যাপারটা হল এই—আমি আর ফেলুদা রাস্তার দিকে মুখ করে বসে ছিলাম, আর লালমোহনবাবুর মুখ ছিল রেস্টোরান্টের পিছন দিকটায়। ঘরের শেষ মাথায় একটা নিচু প্ল্যাটফর্ম, দেখেই বোঝা যায়। সেখানে রাত্রে বাজনা বাজে। সেখানে একটা সাইনবোর্ড দেখেই জটায়ুর এই দশা। তাতে রয়েছে এই বাজনার দলের নাম, আর নামের ঠিক তলায় লেখা— গিটার-ক্রিস গডউইন।
ফেলুদা হাত থেকে স্যান্ডউইচ নামিয়ে একটা বেয়ারাকে তুড়ি দিয়ে কাছে ডাকল।
এখানে ডিনারের সময় বাজনা বাজে?
হাঁ বাবু, বাজতা হ্যায়।
তোমাদের ম্যানেজারের সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?
ক্রিস গডউইনের ঠিকানা জোগাড় করাই ফেলুদার উদ্দেশ্য, আর তার জন্য একটা জুতসই অজুহাতও রেডি করে রেখেছিল। ম্যানেজার আসতে বলল, বালিগঞ্জ পার্কের মিস্টার মানসুখানির বাড়িতে বিয়ের জন্য একটা ভাল বাজিয়ে গ্রুপ চাই। আপনাদের এখানের দলটার খুব নাম শুনেছি।–তারা কি বিয়েতে ভাড়া খাটবে?
হোয়াই নট? এটাই তো তাদের পেশা।
ওই যে গডউইন নামটা দেখছি, ওই বোধহয় লিডার? ওর ঠিকানাটা যদি…
ম্যানেজার একটা স্লিপে ঠিকানাটা লিখে ফেলুদাকে এনে দিলেন। দেখলাম লেখা আছে— ১৪/১ রিপন লেন।
অন্য দিন হলে গল্প-টল্প করে চা-স্যান্ডউইচ খেতে যতটা সময় লাগত, আজ অবিশ্যি তার চেয়ে অনেক কম লাগল। ফেলুদার খিদে মিটে গেছে; সে একটার বেশি খেল না। লালমোহনবাবু অসম্ভব স্পিড়ে আর এনার্জির সঙ্গে ফেলুদার দুটো আর নিজের তিনটে খেয়ে ফেলে বললেন,পয়সা যখন পুরো দেব তখন খাবার ফেলা যায় কেন মশাই?
ফোর্টিন বাই ওয়ান রিপন লেনের বাইরেটা দেখে মনটা দমে যাওয়া স্বাভাবিক।–কারণ সাদত আলির নবাবির কথা এখনও ভুলতে পারিনি। কিন্তু ফেলুদা বলল, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। চার-পাঁচ পুরুষের ব্যবধানে একটা পরিবার যে কোথা থেকে কোথায় নামতে পারে তার কোনও লিমিট নেই। অবিশ্যি বাড়িগুলো যে খুব ছোট তা নয়, সবই তিনতলা চারতলা, কিন্তু কোনওটারই বাইরেটা দেখে ভিতরে ঢুকতে ইচ্ছে করে না। লালমোহনবাবু বললেন যে, বোঝাই যাচ্ছে এর প্রত্যেকটাই হানাবাড়ি। যাই হাক, ঢোকার আগে পাশেই একটা পানবিড়িওয়ালাকে ফেলুদা জিজ্ঞেস করে নিল।
ইয়ে কোঠিমে গডউইন সাহাব বোলকে কোই রহিতা হ্যায়?
গুডিন সাহাব? জো বাজা বাজাত হ্যায়?
সে ছাড়া আরও আছে নাকি?
বুঢ়ঢ সাহাব ভি হ্যায়। মার্কিস সাহাব। মার্কিস গুডিন।
কোন তলায় থাকেন সাহেব?
দো তল্লা। তিন তল্লামে আর্কিস সাহাব।
আর্কিস-মার্কিস দুই ভাই নাকি বাবা? প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবু।
নেহি বাবু। আর্কিস সাহাব আর্কিস সাহাব, মার্কিস সাহাব গুডিন সাহাব—দো তল্লামে মার্কিস সাহাব, তিন তল্লামে…
ফেলুদা আর্কিস-মার্কিসের ঝামেলা ছেড়ে ইতিমধ্যে চোদ্দ বাই একে ঢুকে পড়েছে। আমরাও দুষ্মা বলে তার পিছন পিছন ঢুকলাম।
যা ভেবেছিলাম। তাই। ভিতরে বাইরে কোনও তফাত নেই। জুন মাসের দিন বড় বলে এই সাড়ে ছাঁটার সময়ও বাইরে আলো রয়েছে, কিন্তু ভিতরে সিঁড়ির কাছটায় একেবারে মিশমিশে অন্ধকার। ফেলুদার একটা অদ্ভূত ক্ষমতা আছে—হয়তো ওর চোখটাই ওইভাবে তৈরি— অন্ধকারে সাধারণ লোকের চেয়ে ও অনেক বেশি দেখতে পায়। ওর তরতরিয়ে সিঁড়ি ওঠা দেখে লালমোহনবাবু রেলিংটাকে খামচে ধরে কোনওরকমে উঠতে উঠতে বললেন, ক্যাট-বাৰ্গলার হয় জানতুম মশাই, ক্যাট-গোয়েন্দা এই প্রথম দেখলুম।
দোতলা থমথমে। একটা ক্ষীণ বাজনার শব্দ শোনা যাচ্ছে, বোধ হয় কোনও রেডিও থেকে আসছে। সিঁড়ির মুখে একটা দরজা, তার পিছনে বারান্দা, তাতে আলো না জ্বললেও বাইরেটা খোলা বলে খানিকটা দিনের আলো এসে পড়ে বারান্দার ভাঙা-কাচের টুকরো বসানো। মেঝেটাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। আমাদের বাঁয়ের দরজা দিয়ে যে ঘরটা দেখা যাচ্ছে তাতে কেউ নেই, কারণ বাতি জ্বলছে না। ভিতরে বারান্দার বাঁ দিকে একটা ঘর আছে বুঝতে পারছি, কারণ সেই ঘর থেকেই এক চিলতে আলো এসে বারান্দার একটা কোণে পড়েছে। একটা কালো বেড়াল সেই আলোয় কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে একদৃষ্টি আমাদের দেখছে। তিনতলা থেকে পুরুষের গলার শব্দ পাচ্ছি মাঝে মাঝে। একবার যেন একটা ঘংঘঙে কাশির শব্দও পেলাম।
বাড়ি চলুন, বললেন জটায়ু। এ হল রিপন লেনের গোরস্থান।
ফেলুদা বারান্দার দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
কেই হ্যায়?
কয়েক সেকেন্ড কোনও শব্দ নেই, তারপর উত্তর এল—কোন হ্যায়?
ফেলুদা ইতস্তত করছে, এমন সময় আবার কথা এল, এবার বেশ কড়া স্বরে।
অন্দর আইয়ে!—আই কান্ট কাম আউট।
ভেতরে যাবেন, না বাড়ি যাবেন?
ফেলুদা লালমোহনবাবুর প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে চৌকাঠ পেরিয়ে এগিয়ে গেল। ও ঘুড়ি, আমরা ল্যাজ, একেবেঁকে এগোলাম দুজনে পিছন পিছন।
কাম ইন, হুকুম এল বাঁয়ে ঘরের ভিতর থেকে।
০৬. মাঝারি সাইজের বৈঠকখানা
তিনজনে ঢুকলাম ভিতরে। একটা মাঝারি সাইজের বৈঠকখানা। দরজার উলটো দিকে একটা সোফা, তার কাপড়ের ঢাকনির তিন জায়গায় ফুটা দিয়ে নারকোলের ছোবড়া বেরিয়ে আছে। সোফার সামনে একটা শ্বেতপাথরের টেবিল;-এখন শ্বেত বললে ভুল হবে, কিন্তু এককালে তাই ছিল। বাঁয়ে একটা কালো প্রাচীন বুক কেস, তাতে গোটা পনেরো প্রাচীন বই। বুক কেসের মাথায় একটা পিতলের ফুলদানিতে ধুলো জমা প্লাস্টিকের ফুল, সে ফুলের রং বোঝে কার সাধ্যি। দেয়ালে একটা বাঁধানো ছবি, সেটা ঘোড়াও হতে পারে, রেলগাড়িও হতে পারে, এত ধুলো জুমেছে তার কাচে। যে ফিলিপস রেডিওটা সোফার পাশের টেবিলের উপর রাখা রয়েছে সেন্টার মডেল নিৰ্ঘাত ফেলুদার জন্মেরও আগের। আশ্চর্য এই যে সেটা এখনও চলে, কারণ সেটা থেকেই গানের শব্দ আসছিল। এখন একটা শিরা-বার-করা ফ্যাকাসে হাত নব ঘুরিয়ে গানটা বন্ধ করে দিল। যার হাত, তিনি সোফার এক কোণে একটা কুশন কোলে নিয়ে বাঁ পা-টা, একটা মোড়ার উপর তুলে দিয়ে বসে মিটমিট করে আমাদের দিকে চাইছেন। এর শরীরে যে সাহেবের রক্ত আছে সেটা চামড়ার রং থেকে বোঝা যায়, আর চুলের যেটুকু পাকা নয় তার রং কটা। চোখটা যে কীরকম সেটা বুঝতে পারছি না, কারণ ছাত থেকে ঝোলানো যে বাতিটা জুলছে সেটার পাওয়ার পচিশের বেশি নয়।