- বইয়ের নামঃ গোরস্থানে সাবধান
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, ফেলুদা সমগ্র
০১. রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলী
রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলীর লেখা গল্প থেকে বম্বের ফিল্ম পরিচালক পুলক ঘোষালের তৈরি ছবি কলকাতার প্যারাডাইজ সিনেমায় জুবিলি করার ঠিক তিন দিন পরে বিকেল বেলা উৎকট সারেগামা হর্ন বাজিয়ে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড মার্ক ঢুঁ অ্যাম্বাসডর গাড়ি আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। আমরা জানতাম যে লালমোহনবাবু একটা গাড়ি কেনার তাল করছেন, কিন্তু ঘটনাটা যে এত চট করে ঘটে যাবে সেটা ভাবিনি। অবিশ্যি শুধু যে গাড়িই কেনা হয়েছে তা নয়; তার সঙ্গে একটি ড্রাইভারও রাখা হয়েছে, কারণ লালমোহনবাবু গাড়ি চালাতে জানেন না। এমনকী শেখার ইচ্ছেটাও নেই। একথাটা তিনি এতবার আমাদের বলেছেন যে, শেষটায় এক’দিন ফেলুদাকে বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করতে হল, কেন মশাই, শিখবেন না কেন? তাতে লালমোহনবাবু বললেন যে, বছর পাঁচেক আগে নাকি এক বন্ধুর গাড়িতে শিখতে আরম্ভ করেছিলেন। দুদিন শিখে থার্ড দিনে একটা চমৎকার গল্পের প্লট মাথায় নিয়ে ফাস্ট গিয়ার থেকে সেকেন্ড গিয়ারে যেতে গাড়িটা এমন হ্যাঁচকা মারলে যে প্লটের খেই বেমালুম হাওয়া।সে-আপশোস আমার আজও যায়নি মশাই।
সাদা শার্ট আর খাকি প্যান্ট-পরা ড্রাইভার নেমে এসে দরজা খুলে দিতে লালমোহনবাবু একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে রাস্তায় নামতে গিয়ে ধুতির কোঁচায় পা আটকে খানিকটা বেসামাল হলেও তাঁর মুখ থেকে হাসিটা গেল না! ফেলুদা কিন্তু গভীর। তিনজনে ঘরে এসে বসার পর সে মুখ খুলল।
আপনার ওই বিটকেল হৰ্নটা পালটিয়ে সাধারণ, সভ্য হর্ন না-লাগানো পৰ্যন্ত রজনী সেন রোডে ও-গাড়ির প্রবেশ নিষেধ।
জটায়ু জিভা কাটলেন। আমি জানতুম ব্যাপারটা একটু রিস্কি হয়ে যাচ্ছে। যখন ডিমনষ্ট্রেট করলে না?—তখন লোভ সামলাতে পারলুম না।–জাপানি, জানেন তো?
কান-ফ্যাটানি হাড়-জ্বালানি, বলল ফেলুদা। আপনার উপর হিন্দি ফিল্মের প্রভাব এতটা ঝটিতি পড়বে সেটা ভাবতে পারিনি। আর রংটাও ইকুয়্যালি পীড়াদায়ক। মাদ্রাজি ফিল্ম-মার্কা।
লমোহনবাবু কাতরভাবে হাত জোড় করলেন।দোহাই মিস্টার মিত্তির! হর্ন আমি কালই চেঞ্জ করছি, কিন্তু রংটা রাখতে দিন। গ্রিনটা বড় সুদিং।
ফেলুদা হাল ছেড়ে দিয়ে চায়ের অর্ডার দিতে যাচ্ছিল, লালমোহনবাবু বাধা দিয়ে বললেন, ওটা এখন বাদ দিন, আগে চলুন। একবারটি চক্কর মেরে আসি। আপনাকে আর তপেশীবাবুকে না-চড়ানো অবধি আমার ঠিক স্যাটিস ফ্যাকশন হচ্ছে না। বলুন কোথায় যাবেন।
ফেলুদা আপত্তি করল না। একটু ভেবে বলল, তোপ্সেকে একবার চার্নকের সমাধিটা দেখিয়ে আনব ভাবছিলাম।
চার্নক? জব চার্নক?
না।
তবে? চার্নক আরও আছে নাকি?
আরও নিশ্চয়ই আছে, তবে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা চার্নক একজনই।
তাই তো— মানে…
তার নাম জব নয়, জোব। জব হল কাজ, চাকরি; আর জোব হল নাম। যে ভুলটা আর পাঁচজনে করে সেটা আপনি করবেন কেন?
এখানে বলে রাখি ফেলুদার লেটেস্ট নেশা হল পুরনো কলকাতা। ফ্যান্সি লেনে একটা খুনের তদন্ত করতে গিয়ে ও যখন জানল যে ফ্যান্সি হচ্ছে আসলে ফাঁসি, আর ওই অঞ্চলেই দুশো বচ্ছর আগে নন্দকুমারের ফাঁসি হয়েছিল, তখন থেকেই নেশাটা ধরে। গত তিন মাসে ও এই নিয়ে যে কত বই পড়েছে, ম্যাপ দেখেছে, ছবি দেখেছে তার ইয়ত্তা নেই। অবিশ্যি এই সুযোগে আমারও অনেক কিছু জানা হয়ে যাচ্ছে, আর তার বেশির ভাগটা হয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দুটো দুপুর কাটিয়ে।
ফেলুদা বলে দিল্লি-আগ্রার তুলনায় কলকাতা খোকা-শহর হলেও এটাকে উড়িয়ে দেওয়া মোটেই ঠিক নয়। এখানে তাজমহল নেই, কুতুবমিনার নেই, যোধপুর-জয়সলমীরের মতো কেল্লা নেই, বিশ্বনাথের গলি নেই—এ সবই ঠিক-কিন্তু ভেবে দ্যাখ তোপ্সে—একটা সাহেব মশা মাছি সাপ ব্যাঙ বন-বাদাড়ে ভরা মাঠের এক প্রান্তে গঙ্গার ধারে বসে ভাবল এখানে সে কুঠির পত্তন করবে, আর দেখতে দেখতে বন-বাদাড় সাফ হয়ে গিয়ে সেখানে দালান উঠল, রাস্তা হল, রাস্তার ধারে লাইন করে গ্যাসের বাতি বসল, সেই রাস্তায় ঘোড়া ছুটল, পালকি ছুটল, আর একশো বছর যেতে না যেতে গড়ে উঠল এমন একটা শহর যার নাম হয়ে গেল সিটি অফ প্যালেসেজ। এখন সে শহরের কী ছিরি হয়েছে সেটা কথা নয়; আমি বলছি। ইতিহাসের কথা। শহরের রাস্তার নাম পালটে এরা সেই ইতিহাস মুছে ফেলতে চাইছে—কিন্তু সেটা কি উচিত? বা সেটা কি সম্ভব? অবিশ্যি সাহেবরা তাদের সুবিধের জন্যই এত সব করেছিল, কিন্তু যদি না করত, তা হলে ফেলুমিত্তির এখন কী করত ভেবে দ্যাখ! ছবিটা একবার কল্পনা করে দ্যাখ— তোর ফেলুদা—প্রদোষচন্দ্ৰ মিত্র, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর—ঘাড় গুঁজে কলম পিশছে কোনও জমিদারি সেরেস্তায়, যেখানে ফিংগার প্রিন্ট বললে বুঝবে টিপসই।
বিবিডি বাগা—যার নাম ছিল ডালহৌসি স্কোয়ার—যে ডালহৌসি আমাদের দেশে লাটসাহেব হয়ে এসে গপগপ রাজ্য গিলেছে, আর সেই সঙ্গে প্রথম রেলগাড়ি আর প্রথম টেলিগ্রাফ চালু করেছে—সেই বিবিডি বাগে দুশো বছরের পুরনো সেন্ট জনস চার্চের কম্পাউন্ডে কলকাতার প্রথম ইটের বাড়ি জোব চার্নকের সমাধি দেখে লালমোহনবাবু যদিও বললেন খ্রিলিং, আমার কিন্তু মনে হল সেটা আকাশে মেঘের ঘনঘটা আর সেই সঙ্গে একটা গুরু-গভীর গর্জনের জন্য। সমাধির গায়ে একটা মাৰ্বেলের ফলকের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ভদ্রলোক বললেন, এ তো দেখছি জোবও নয় মশাই-জোবাসা ব্যাপার কী বলুন তো?।