লেকিন হোমিওপ্যাথি কি দেখবেন, ভেতরটা? জিভ গলা চোখের তলা, কানের ভেতর, নাকে পেনসিল টর্চ ইত্যাদি?
ধুর, ওসব অ্যালোপ্যাথিক অভদ্রতা। হোমিও হল আর্টফ্যাকালটি–ভাবলাবণ্য যোজনম। খাজুরাহোর মূর্তি সাধারণ মানুষের চোখে একরকম, পুরাতত্ত্ববিদের চোখে আর-এক রকম। আমাদের চোখে পাত্র-পাত্রী, সুন্দর, অসুন্দর, বহিরঙ্গ বিচার, অন্তরঙ্গ বিচার হোমিওপ্যাথের হাতে। তিনি হিস্ট্রি নেবেন ছাপার ফর্মে–মানসিক ভাবসমূহ এবং সর্বাঙ্গীন তাবত লক্ষণচয়। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ। মেয়ের বসার ধরন, মুখের ভাব, কপালের ভাঁজ, কানের লতি, নাকের ডগা, চোখের পাতা, চুলের গোড়া, দাঁতের পাটি। এরই মাঝে সার্চিং আইস ঘুরছে চারপাশে, আত্মীয়স্বজন, তাদের চেহারা, কণ্ঠস্বর, হাসির শব্দ, হাসতে গেলে কাশি আসে কিনা। দেওয়ালে পূর্বপুরুষদের ছবি। দেখছেন আর নোট করছেন, বর্তমান থেকে অতীতে, পূর্বপুরুষ, তার পূর্বপুরুষ, পিতা, পিতামহ, বৃদ্ধপিতামহ, বৃদ্ধ প্রপিতামহ, বংশের ডালে-ডালে পাতায়-পাতায় বিচরণ, লক্ষণ সেন, বল্লাল সেন, শেরশাহ, ঔরঙ্গজীব, আকবর, বাবর, মহম্মদ ঘোরী, ভায়া খাইবার পাশ, বোলান পাশ, কাবুল, গজনি, কান্দাহার, ইরান, ইরাক…
সে কি মশাই, আমাদের বউরা সব অতদূর থেকে রোল করতে করতে, রোল করতে করতে এসেছে নাকি?
হ্যাঁ-হ্যাঁ বাব্বা, ইসকো বোলতা হ্যায় এথনোলজি। সামনে পাত্রী, তার দেহলক্ষণ ফুঁড়ে দৃষ্টি চলেছে রক্তের ধারা অনুসরণ করে কচ্ছু বিষের সন্ধানে।
হোয়াট ইজ কচ্ছু? ইজ ইট বিচ্ছু?
বিচ্ছুর চেয়েও সাংঘাতিক হল কচ্ছু, কচ্ছু মিনস…যা লোডশেডিং হয়ে গেল মোশা।
অন্ধকারে সভাপতি হাই তুলিলেন এবং সভা এইখানেই বিপর্যস্ত হইল।
০৫. পঞ্চম অধিবেশন
একটা বাল্য ফিউজ হয়ে গেছে।
দাম কত?
চার-পাঁচ টাকা হবে।
তাহলে আমরা সকলে পঁচিশ পয়সা করে চাঁদা দি।
আবার চাঁদা স্যার! শ্রবণেই ভীতি। দুগগা পুজো থেকে সরস্বতী পর্যন্ত লাগাতার চাঁদা। মুঠোমুঠো চাঁদা। সংসারী মানবের পক্ষে বড়ই ক্লেশের কারণ।
সামান্য পঁচিশ পয়সায় এত ক্লেশ!
আজ্ঞে হ্যাঁ। পঁচিশ পয়সা আমার এক পিঠের বাস ভাড়া। পঁচিশে একটা পাতিলেবু, দুটো সিগারেট, পাঁচটা বিড়ি কিংবা পঞ্চাশ গ্রাম লাল-লাল কঁচা লঙ্কা। লিটল ড্রপস অফ ওয়াটার, লিটল গ্রেনস অফ স্যান্ড।
উঃ কি যন্ত্রণায় যে পড়া গেছে! ছেলেবেলায় পাঠ্যপুস্তকে গোটাকতক কবিতা, সেই কবিতার কোটেশান শুনতে-শুনতে কান পচে গেল। এই এক লিটল ড্রপস আছে আর-একটা আছে জন্মিলে মরিতে হবে, আর-একটা আছে টু আর ইজ হিউম্যান, আর-একটা আছে লোকে যারে বড় বলে, আর-একটা আছে ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন, আর-একটা আছে জীবে দয়া করে যেই জন, আর-একটা আছে…
ওরে কেউ তোরা থামা না ওকে।
এই মশাই স্টপ, একদম চুপ, ক্লেশদায়ক মানুষ।
হবে না। উনি যে একজন প্লিডার। প্লিড করে করে কত মক্কেলকে কত জজ সাহেবকে খতম করে দিলেন। ইহাকে বলে ভার্বাল টর্চার।
সভাপতি মৃদু কেশে বললেন, আমরা শুরু করেছিলাম ফিউজ বা দিয়ে। সেখান থেকে চলে গেছি জীবে দয়াতে। খুব হয়েছে ভাই সকল, একটা আলো না জ্বললেও ক্ষতি হবে না। এখন কাজের কথায় আসা যাক। কাজ না করলে চিত্ত বড়ই ব্যাকুল হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই সমিতির অধিবেশন বসছে।
দীর্ঘদিন কোথায় মশাই! চারটে অধিবেশন হয়েছে, আজ হল পঞ্চম।
আমার কাছে দীর্ঘ। বয়স ভেদে সময় স্লো ফাস্ট হয়। শেক্ষপিয়র পড়েছেন আপনারা?
শেক্ষপিয়র নয়, শেকসপিয়র, মোক্ষমূলর নয় ম্যাকমুলার।
ধ্যার মশাই! শেকসপীয়র নয় পিয়ার, শেকসপিয়ার।
আপনি আমার চেয়ে বেশি জানেন? ই আর এ ডিপথং হয়ে অ।
ডিপথং? ডিপথং আবার পেলেন কোথায়?
সভাপতি মৃদু হেসে ঝগড়া থামালেন, আমি শেক্ষপিয়র, শেকসপিয়র, পিয়ার সব উইথড্র করে নিলুম। মনে করুন আমিও পড়িনি আপনারাও পড়েননি।
না, তা কেন? তা মনে করব কেন? আমরা শেকসপিয়ার পড়েছি অনেকে।
আমি বাদ। আমি পড়েছি শেকসপিয়ার। ডেফিনিটলি পড়েছি।
সভাপতি দুহাত তুলে বললেন, কি বিপদেই পড়া গেল!
বিপদ তো আপনি নিজেই তৈরি করলেন। হচ্ছে মনুষ্যক্লেশ, আমদানি করলেন ছাত্রজীবনের ক্লেশ শেকসপিয়ারকে।
শেকসপিয়ার ক্লেশদায়ক? বলেন কি!
ঠিকই বলি, যে-কোনও পাঠ্যবস্তুই মনুষ্যক্লেশের কারণ, যে-কোনও অপাঠ্যই চিত্তবিনোদনের হেতু। যে-কোনও মানুষকে ডেকে জিগ্যেস করুন, কজনের ছাত্রজীবন সুখের ছিল। কজনের মনে আছে শেকসপিয়ার।
আমার রয়েছে–টাইম ট্রাভেলস ইন ডাইভার্স পেসেস উইথ ডাইভার্স পার্সনস। আই উইল টেল ইউ হু টাইম অ্যাম্বলস উইথাল হু টাইম গ্যালপস। বলুন তো কোথায় আছে?
আমি একটু বাইরে থেকে আসছি।
ওই দেখুন, কুইজ কনটেস্ট হচ্ছে ভেবে পালাচ্ছে।
না তা নয়, ছোট বাইরে।
ছোট বাইরে! স্কুলে কলেজে সর্বত্র তুমি এই করে এসেছ। পড়া ধরা শুরু হলেই ছোট বাইরে।
আজ্ঞে না-আ।
আজ্ঞে হ্যাঁ-অ্যা। ছোট বাইরেতে যেতে হয় যান, বলে যান কোথায় আছে।
আপনি বলুন না।
আপনি বলুন না।
সভাপতি নস্যি ডিবে টেবিলে ঠুকে বিবদমান দুই পক্ষকে থামিয়ে দিলেন, শান্তি শান্তি।
হোয়াই শান্তি, আমি একবার বলবই, দুয়ো হেরে গেছে দুয়ো।
হেরে গেছি! বাঃ বেশ মজা। আপনি আবার জিতলেন কখন?
আমি নিউট্রাল। না নেগেটিভ না পজেটিভ, হ্যাঁ-হ্যাঁ বাবা, কমপ্লিটলি নিউট্রাল। হেরেছেন আপনি, গো হারান হেরেছেন। নিউট্রালরা কখনও হারে না। গুম হয়ে বসে থেকে মৃদু-মৃদু হাসে, হারজিতের খেলা তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।