পৃথিবীতে এখন বর্ষপালনরীতি চালু হয়েছে। এখন চলছে শিশুবর্ষ। শিশু ক্লেশ নিবারণের, শিশু নির্যাতনের নানা কথা শুনতে পাচ্ছি। যদিও আমি শিশুর পিতা তবু আমি আমার নির্যাতিত শৈশবের জন্যে উপযুক্ত বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছি। সেদিনের সেই নির্যাতিত শিশু আজরে নির্যাতক পিতা, তবু বিচার চাই।
এই সভা আজকের মতো মুলতুবি রইল। ক্লেশের ক্লাসিফিকেশান ও কোডিং-এর জন্যে প্রয়োজন হলে আমাদের একাধিকবার বসতে হবে। যারা ঘুমিয়ে পড়েছেন উঠে বসুন। বাড়ি যান। আজ থেকে প্রত্যেকেই লিখতে থাকুন কার কিসে ক্লেশ!
০২. দ্বিতীয় অধিবেশন
গত সভায় আমাদের মাননীয় বক্তা অনেক আবোল-তাবোল বকেছেন।
বাঙালির স্বভাবই হল, যারা একটু বলতে কইতে পারেন তারা আর মাইক ছাড়তে চান। যদিও এ সভা অ-মাইক। এটাও কিন্তু মনুষ্য ক্লেশের মধ্যে পড়ে। আমরা শুনব না, শুনতে চাইছি না তবু জোর করে শোনাবার চেষ্টা। দেখো আমি কত বড় পণ্ডিত। কত কি জেনে বসে আছি। বক্তারা চিরকালই শ্রোতাদের ক্লেশের কারণ। এর নাম দেওয়া যাক বকর-বকর ক্লেশ।
যিনি নোট নিচ্ছিলেন, সভাপতি নীচু গলায় তাকে বললেন, বাঁদিকে ওপরে লিখুন, বকর বকর ক্লেশ, বড় করে লিখুন, হ্যাঁ, আন্ডার লাইন করুন।
এই বকরমবাজদের মধ্যে পুংলিঙ্গও আছে স্ত্রীলিঙ্গও আছে, সুতরাং বকরমবাজরা হলেন উভলিঙ্গ জীব। ইংরেজিতে এদের বলে–হারমাফ্রোডাইট। এঁরা অফিসে সহকর্মী, যানবাহনে সহযাত্রী, মঞ্চে নেতা, সভাপতি কিংবা প্রধান অতিথি, বেতারে বক্তা, গৃহে শয্যাসঙ্গিনী! একবার দম দিয়ে ছেড়ে দিলেই হল। দম মারো দঅঅম।
সভাপতি ফিসফিস করে বললেন, শেষ লাইনটা বাদ দিন। ও দমটা গ্রামোফোনের দম নয়, যদুর জানি গাঁজার দম।
কথা কম, কাজ বেশি, এদেশে তা সম্ভব হল না। চৈত্র মাসে, গাজনের সন্ন্যাসীরা চড়কের দিন জিভে বাণ ফোঁড়েন, এর নাম হল বাণ-ফেঁড়। উদ্দেশ্যটা কি? বাক্যের উৎসস্থলে বাণ মেরে বাক্যবাণ বন্ধ করা। যে কুকুর বেশি ঘেউঘেউ করে তার মুখে মাজল বেঁধে দেওয়া হয়। যে বাছুর সবসময় বাঁটের দুধ খাওয়ার জন্যে বেশি ছোঁকছোঁক করে তার মুখে জাল বেঁধে দেওয়া হয়। আমি স্বীকার করছি, মানুষের মুখের গঠনটাই বেয়াড়া। থ্যাবড়া। শেয়াল বা কুকুরের মতো ছুঁচোলো নয়। মাজল পরাবার কোনও উপায়ই ঈশ্বর করে রাখেননি। ঠোঁট দুটো গুণছুঁচ দিয়ে সেলাই করে দিলেই বকরম-বকরম বন্ধ হতে পারে! কিন্তু সে তো আর সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ, কঁদুনে খোকার মুখে যেমন চুষি বা সাকার ঢুকিয়ে দেওয়া হয় সেইরকম একটা কিছু যদি চালু করা সম্ভব হতো তাহলে মন্দ হতো না। চুষলেই চাটনি, বেশ নেশা ধরানো চাটনি। এত বড়-বড় চুষি, সি এস পি সি এম ছাপ মারা। যেই মনে হবে লোকটা বড় বিপজ্জনক, ক্লেশদায়ক, সুযোগ পেলেই বকতে আরম্ভ করবে, দাও মুখে চুষি রে।
যেমন ধরুন কোনও মহিলা এসে বললেন, কত্তার জ্বালায় বাড়িতে আর টিকতে পারছি না, চব্বিশ ঘণ্টা বকর-বকর করে পাগল করে দিচ্ছে। সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের এই সংস্থার তৈরি স্পেশ্যাল একটা নিপলস্ তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হল। সঙ্গে এক শিশি চাটনি।
সভাপতি প্রশ্ন করলেন, কীসের চাটনি? আমের না আমড়ার?
মিষ্টি-মিষ্টি চাটনি। এমন চাটনি যার মধ্যে কিছু নেশার উপাদান থাকবে। বকবক করার নেশার চেয়েও জোরালো নেশা। ফরমূলাটা ধরুন এইরকম হবে, কাঁচা আম এক কেজি, চিনি ৫০০ গ্রাম, এক ভরি আফিমের জল, অভাবে পোস্তর খোলাসেদ্ধ জল, বেলশুট চূর্ণ ২০০ গ্রাম। বেল দেওয়ার কারণ, আফিমে একটু কনস্টিপেশন হতে পারে, বেলে সেটা কেটে যাবে। কনস্টিপেশনে বায়ু বেড়ে যায়, বায়ু উর্ধমুখী হলে বকবকানি আরও বেড়ে যেতে পারে।
এখন আম সেদ্ধ করে কাত করে বের করে মিহি মোলায়েম করে হেঁকে ফেলুন। চিনি রস করে মিশিয়ে দিন। সামান্য জিরে গুঁড়ো, অল্প একটু লঙ্কা, আফিমের জল, বেলচূর্ণ দিয়ে বেশ করে ফুটিয়ে নিন। ঠান্ডা হলে শিশিতে ভরে ফেলুন। গায়ে লেবেল মেরে দিন নাম ফরমূলা ১, মনুষ্যক্লেশ নিবারণী সমিতির মোক্ষম দাওয়াই। বয়স্কদের বকম-বকম, কানের কাছে অনবরত হাঁচি অথবা কাশির মতোই বিরক্তিকর। ফাঁপা চুষিতে এক চামচে ফরমূলা ১ ভরে কত্তাকে চুষতে দিন, গিন্নির মুখে গুঁজে দিন, শ্বশুরের মুখে ঠুসে দিন, শাশুড়ির ঠোঁটে পুরে দিন। অব্যর্থ দাওয়াই! অভ্যাস হয়ে গেলে চুষি একবার ধরে গেলে, কেউ আর বক্তা থাকবেন না, সবাই তখন শ্রোতা।
সভাপতি একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, আফিম পাবেন কোথায়? ইট ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট টু প্রোকিউর। এই তো আমার পা ফুলছে বলে কবরেজ বিধান দিয়েছেন, একগুলি করিয়া সরষের অহফিম দুধসহ সেব্য। তার জন্যে কার্ড চাই, আবগারি বিভাগের পারমিট চাই। তা ছাড়া ওই বস্তুটি যৌবন ধরে রাখে, খিদে বাড়ায়, গালে গোলাপি আভা আনে, মানুষকে মৌতাতে রাখে। কিশোর ন্যাচারাল প্রসেসে যুবক হবে। সংসারে প্রবেশ করবে। ধাক্কা আর মার খেতে-খেতে অকালে বুড়িয়ে ঝরাপাতার মতো চেহারা হয়ে যাবে। ডিসপেপসিয়া, ন্যাবা, বুক ধড়ফড়, কন্যাদায়, পুত্রদায়, পিতৃঋণ সব নিয়ে একদিন অকালে বল হরি হরিবোল। ফিনিশ। সেখানে আফিম ইনট্রোডিউস করে জীবনকে মধুর করে তোলা অপরাধ। আমরা তো আর কনস্টিটিউশনের অ্যাগেনস্টে যেতে পারি না। জীবনবিরোধী কার্যকলাপ পরিহার করিয়া চলাই বাঞ্ছনীয়।