বক্তা বসলেন। চেটাপ্যাট হাততালি।
এইবার বলবেন শ্রীঅমল বোস ডগট্রেনার।
আমি কুকুর চরাই, অবশ্য বিলিতি কুকুর। কুকুর মানুষে বিশেষ তফাত নেই। মানুষের মতো কুকুরের সব আছে কেবল মানুষের ভাষাটাই নেই। ট্রেনিং মেকস এ ম্যান, ট্রেনিং মেকস এ ডগ। শৈশব থেকেই মানুষকে যদি উপযুক্ত কায়দায় শিক্ষা দেওয়া যায় তাহলে মানুষও কুকুরের মতোই বুদ্ধিমান, কর্তব্য পরায়ণ, বিশ্বাসী, বিচক্ষণ ও প্রভুভক্ত হতে পারে। আমরা কুকুরকে বলি ফেথফুল ফ্রেন্ড। কজন মানুষকে বলতে পারি আমার বিশ্বাসী বন্ধু, প্রাণের বন্ধু! কজন মানুষকে বলতে পারি আমার বিশ্বাসী, কর্তব্যপরায়ণ কর্মী! পারি না। তার কারণ মানুষ এখনও পুরোপুরি শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারেনি। মানুষের সংখ্যা অনেক, সেই তুলনায় বিলিতি কুকুরের সংখ্যা অনেক কম। তা ছাড়া কুকুরের শিক্ষিত হওয়ার প্রবণতা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। কুকুর রেগে যেতে পারে, খেপে যেতে পারে কিন্তু মানুষের মতো দেখো তো না দেখে বখে যেতে পারে না। কুকুরের কামড়ের ইঞ্জেকশান আছে, অহরহ মানুষের কামড়ের কোনও প্রতিকার নেই।
মানুষ ভাবে বই পড়ে বি এ, এম এ পাশ করলেই মানুষ হওয়া যায়। অত সহজ! একেই তো মানুষের মধ্যে সদগুণের বড়ই অভাব। আলস্য, প্রতিহিংসা, বিশ্বাসঘাতকতা, বেইমানি, পরশ্রীকাতরতা, পরস্ত্রীকাতরতা, হিংসা, দ্বেষ, চুরির প্রবণতা, মুনাফার লোভ, ক্ষমতালিপ্সা, সব মিলিয়ে মানুষ একটা ক্যাডাভেরাস জীব। কুকুর সেই তুলনায় অনেক পারফেক্ট প্রাণী। আমি দেখেছি এক একটা কুকুর সারাজীবন ব্রহ্মচারী থেকে গেছে। সুপ্তিস্থলন নেই, স্বমেহন নেই। বিপরীত লিঙ্গের কুকুর দেখে সামান্য ছটফট করেছে, কুঁই-কুঁই করেছে, কিন্তু প্লেবয় ম্যাগাজিন খুলে মদের গেলাস নিয়ে বসেনি। বেশ্যালয়ে গমন করেনি।
মানুষের মতো ইমপারফেক্ট প্রাণীকে কুকুরের মতো মানুষ করতে হলে কি করতে হবে বুঝতে পারছেন? প্রাণীর পরিতৃপ্তির প্রথম শর্তই হল পেটপুরে খাওয়া, পরিশ্রম আর বিশ্রাম। দুর্ভাগ্যের কথা অধিকাংশ মানুষই অভুক্ত। যাঁরা প্রচুর খান তারা ধনী, শ্রম বিমুখ এবং অসুস্থ। ভারতবর্ষে ভোগের অনেক খরচ। খরচ মানেই উপার্জন। সোজাপথে প্রচুর উপার্জন অসম্ভব। আর সেইখানেই মরালিটির বিসর্জন। মানুষের তিনটি শ্রেণি ইমমরাল রিচ, ডিসকনটেনটেড হ্যাঁগার্ডস, অ্যান্ড মিডলক্লাস মাউস। উচ্ছিষ্ট ভোজন করে, মোসায়েবি করে, কুড়িয়ে বাড়িয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা। গুড়ের নাগরি উলটে যাচ্ছে ভ্যান-ভ্যান করে মাছি বসছে। কুকুর অনেক বলিষ্ঠ প্রাণী। কুকুরকে ট্রেন আপ করা যায়, মাছিকে করা যায় না।
তবু আমাদের চেষ্টা করতে হবে। শৈশব থেকেই মানুষকে ধরতে হবে। মেরে ধরে নয়, কুকুরের কায়দায় ট্রেনিং দিতে হবে। সে কায়দাটা হল, পুরস্কার, তিরস্কার। ভালো কাজে পুরস্কার, খারাপ কাজে তিরস্কার। একটা অবজেক্ট অফ ফিয়ার তৈরি করে রাখতে হবে। কুকুরের বেলায় আমরা হাতের কাছে রাখি পাকান খবরের কাগজ, ফোলডেড নিউজ পেপার। আর্মিতে ব্যাটন, মিডল ইস্টে চাবুক, মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে খেটে লাঠি আর একজন ফাদার ফিগার। প্রহার নয়, প্রহারের ভয়, মাঝে-মাঝে হুঙ্কার। দাঁড়াও, তোমার বাবা আসুক! দেখতে-দেখতে এমন একটা পরিবেশ তৈরি হবে–এইরে বাবা আসছে মনে করেই সব ঠান্ডা। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রথমেই বাবা তৈরি করতে হবে, বাবার মতো বাবা। শুধু বাড়িতে নয়, সর্বত্রই একটা করে বাবা চাই। রাস্তায় ঘাটে, স্কুলে কলেজে, অফিস কাছারিতে। বাবার অভাবে দেশ উচ্ছন্নে গেল।
অবজেক্ট অফ ফিয়ার তৈরি হলেই শুরু হবে আসল ট্রেনিং। ট্রেনিং এর মূল কথাই হল বশ মানান। জৈনদের সাধনায় অনেক যোগ আছে। তার মধ্যে একটি হল স্থান যোগ। দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকা ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা। নট নড়নচড়ন। নড়লেই যোগ নষ্ট। তারপর অভ্যাস করো একপায়ে দাঁড়ান। এর নাম ধৈর্য।
কুকুরকে আমরা প্রথমে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকার ট্রেনিং দি। সিট ডাউন। নড়লে বা ওঠার চেষ্টা করলেই সেই অবজেক্ট অফ ফিয়ার, পাকানো খবরের কাগজ চোখের সামনে আস্ফালন। করে ভয় দেখাই। তারপর আদেশ তামিল করার ট্রেনিং। দূরে একটা বল রেখে বলি নিয়ে আয়। আনলেই উৎসাহ দেওয়ার জন্যে পুরস্কার, এক টুকরো বিস্কুট। বলটা সামনে রেখে বলি, পাহারা দে, কাউকে ছুঁতে দিবি না। সামনে খাবার রেখে বলি, খাবি না।
ওই একই কায়দায় ছেলে মানুষ করতে হবে। নরমগরম ট্রিটমেন্টে চরিত্রে টেম্পার লাগাতে হবে। ইস্পাত আর চরিত্র একই জিনিস। বেশি আদর না, বেশি শাসন না। বশ্যতা স্বীকার করো। আমরা চাই দ্বিতীয় ভাগের সুবোধ বালক, যাহা পায় তাহাই খায়, কদাচ অবাধ্যতা করে না। সংসারের নিয়ম হল প্রথমে দাসত্ব তারপর নেতৃত্ব। দাস থেকেই নেতা। আমাদের সকলের মধ্যেই হিরো ওয়ারশিপের মনোভাব লুকিয়ে আছে। অস্বীকার করে লাভ নেই। পলিটিক্যাল হিরো, ফিল্ম হিরো, স্পোর্টস হিরো, হিরো হলেই হল, শতশত ফ্যান কাতারে কাতারে রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগল–যুগযুগ জিও। অফিসে সেরেস্তায় বড় কর্তাদের কি সাংঘাতিক দাপট! কে কার ঝাড়ে বাঁশ কাটে! কার ধনে কে পোদ্দারি করে! কে কাকে ক্ষমতায় বসায়! তবু যে বসে গেল তাকে সবাই মানতে বাধ্য। তিনি তখন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ভাগ্যবিধাতা গড। সরকারি অফিস হলে তিনি তখন সাহেব, স্যার। হায়ারর্কি তখন এইরকম–দাসের দাস, দাসের দাসের দাস, তস্য দাস। সেই গডকে তখন নানাভাবে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা, তেল দিয়ে, ব্যক্তিগত খিদমত খেটে। উঠতে স্যার বসতে স্যার। কলা নিন মূলো নিন। দিন স্যার ইলেকট্রিক বিলটা আপনার তিন মাইল লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে জমা দিয়ে আসি। দিস ইজ মাই সেক্রেড টাস্ক। টেলিফোন বিল? ও দ্যাটস এ প্লেজার। বাড়িতে কাজ আছে? সো হোয়াট। আমি তো আছি! ভোর রাতে উঠে শেয়ালদা থেকে আমি মাছ কিনে এনে দেব। একদম ভাববেন না স্যার, নতুনবাজার থেকে ঘাড়ে করে ছানা কিনে এনে দেব। পরিবেশন? নো প্রবলেম। কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে লেগে যাব। যে নিজের বাড়িতে কুটোটি নেড়ে উপকার করে না সে বসের বাড়িতে হাসি-হাসি মুখে গাধার চেয়ে বেশি খাটে। বাড়ির কাজে মুখ ভার করে বলে– আমি একটা ডিগনিফায়েড সার্ভেন্ট ভাই! বড় কত্তার বাড়িতে গ্লোরিফায়েড দাস। এর দুটো কারণ, গড় সন্তুষ্ট হলে প্রসাদ মিলতে পারে। দ্বিতীয় কারণ, দাসত্বে নিজের ব্যক্তিত্বকে খোঁটা বেঁধে ঠেলে ঠুলে দাঁড় করাতে হয় না। সোজা হয়ে বসার সাধনা করতে হয়, কষ্ট আছে। কুঁজো হয়ে বসা বড় আরামপ্রদ। আত্মবিসর্জনে ঝামেলা কম। প্রসাদ জুটে গেল তা ভালোই, না জুটলেও কোনও ক্ষতি নেই। বঞ্চনা সহজে হজম করা যায়। যুগযুগ ধরে মানুষ তাইতেই অভ্যস্ত। ব্যক্তিত্ব ফলাতে গিয়ে যে সংঘর্ষ তা সহ্য করা শক্ত। টেনসনে ইরিটেসান, অংসাইটি, নার্ভাস ব্রেকডাউন! উঁচতে উঠতে চিতপাত হওয়ার ভয়। জমিতে ফ্ল্যাট হয়ে থাকলে সরীসৃপের আনন্দ! সেই জন্যেই আমাদের প্রবাদ, অতি বড় হোয়য়া না ঝড়ে পড়ে যাবে, অতি নিচু হোয়য়া না ছাগলে মুড়োবে। ব্যক্তিত্বকে কুঁজো করে, মোসায়েব হয়ে তালে তাল মিলিয়ে দিনগত পাপক্ষয় করে যাও। রামপ্রসাদ গান বেঁধেছিলেন– আমি চাই না মা গো রাজা হতে, রাজা হওয়ার সাধ নাই মা চিতে, দুবেলা যেন মা পাই গো খেতে। আমাদের ধর্মও বলছে, তুমিই সব, আমি তোমার দাস। আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, আমি ঘর তুমি ঘরণী, যেমন করাও তেমনি করি, যেমন চালাও তেমনি চলি। বীরভাবের বীরাচারীর শেষে স্ত্রী আচারী হয়ে গাঁজা ভাং খেয়ে শ্মশানে লুটোপুটি। বীরের পতন অনিবার্য। দাসের পতন নেই। মানুষ নিপীড়িত, অত্যাচারিত হতে ভালোবাসে। সুখের চেয়ে যন্ত্রণার আনন্দ অনেক বেশি। ডিকটেটাররা তাই এত ভালো শাসক। গণতন্ত্র সর্বত্রই ফেলিওর। হার্ডি বোধহয় সেইকারণেই বলেছিলেন, ডেমোক্র্যাসি হ্যাঁজ অল দি ভারচুস সেভ ওয়ান ইট ইজ নট অ্যাট অল ডেমক্রেটিক। ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর প্রান্তে-প্রান্তে এক ডিকটেটার যায় তো আর-এক ডিকটেটার আসে। অসংখ্য মানুষ অম্লান বদনে তার প্রভুত্ব মেনে নিয়ে বসে থাকে। ডিকটেটারে ডিকটেটারে লড়াই হয়, সাধারণ মানুষ প্রাণ দিতে বাধ্য হয়। নেতারা বসে থাকেন ঠান্ডা ঘরে, জলচৌকিতে। সাধারণ মানুষ বোমা, পটকা, ছোরাছুরি নিয়ে অলিতে-গলিতে মারামারি করে মরে। একদল বলে, অমুক যুগযুগ জিও, আর-একদল বলে তমুক যুগযুগ জিও। অমুকে তমুকে বিশেষ ফারাক নেই। একই মুদ্রার এ পিঠ আর ও পিঠ। দুজনেই এক গেলাসের ইয়ার। একই হোটেলে একই টেবিলে মুখোমুখি বসে রাইট আর লেফট। সুগারকোটেড বুলি, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, স্বপ্নের জাল বুনে বুনে জনতাকে হাতে রাখা। বল রয়েছে মাঠে খেলোয়াড়দের পায়ে। গ্যালারিতে ফ্যানরা উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। খেলার প্রতিযোগিতা মাঠ ছেড়ে গ্যালারিতে, গ্যালারি থেকে রাস্তায়, রাস্তা থেকে স্টেশানে, সেখান থেকে পাড়ায়, ভাঙচুর, গুলি, লাঠি, কাঁদানে গ্যাস, মৃত্যু। যা নিয়ে কাণ্ড, যাদের নিয়ে কাণ্ড, তারা প্রোফেসনাল। তাদের কাছে খেলা উপলক্ষই, টাকাটাই সব। তারা যখন নরম বিছানার গরম ঘুমে, ভরা পেটের স্বপ্নে তখন অসহায় মানুষ স্টেশান প্ল্যাটফর্মে, পিঠে লাঠি, চোখে কাঁদানে গ্যাসের জল। রাত তিনটের সময় ছোঁড়াখোঁড়া বিরিঞ্চিবাবু শহর থেকে ফিরছেন সেরেস্তায় খাতা ঠেলে।