ভবে কে বলে কদর্য শ্মশান
পরম পবিত্র চরম যোগের স্থান
পাপী পুণ্যবান মুখ কি বিদ্বান
সমান ভাবে হেলায় সকলি শয়ান।
অন্ধ খঞ্জ বধির গলিত কুষ্ঠধারী
কন্দর্প সমান রূপের দর্পহারী
সজ্জন তস্কর গৃহ বনচারী।
রাজা আর ভিখারী সকলে সমান।
হেথা এলে পরে যায় মায়া সব
রয় না ভবজরার কোনও উপদ্রব।
শ্মশান মাত্র নাম কিন্তু শান্তিধাম
সুখ দুখ শান্তির চির অবস্থান।
ভবে কে বলে কদর্য শ্মশান!
এসেছি, চলে যাব। কিংবা আসিনি যাবও না, ভ্রম মাত্র। তবু ভাবতে দোষ কি আমি অমৃতের সন্তান, আমার জন্ম, নেই মৃত্যু নেই, বন্ধন নেই, জরা নেই, যৌবন নেই। সাত্ত্বিক জীবন যাপনেই শান্তি। জপ ধ্যান, নিরামিষ আহার, সপ্তাহে একদিন উপবাস, সৎসঙ্গ, কামিনী কাঞ্চন ত্যাগ, এই হল ক্লেশমুক্তির উপায়। দিনরাত শুধু সৎচিন্তা, প্রেম।
সভায় ঘনঘন হাততালি।
পেয়ে গেছি। পথ পেয়ে গেছি। নিরামিষ মানে কতটাকা বাঁচল, একবার ভাবুন। ডেলি অ্যাট লিস্ট চার টাকা, মাসে একশো কুড়ি। একদিন উপবাস। আরও গোটা দশেক টাকা। একশো তিরিশ। কামিনী ত্যাগ মানে বউকে বাপের বাড়ি পাঠান, চ্যাঁ ভ্যাঁ সমেত।।
সাইলেন! সাইলেন! ডক্টর সিদ্ধান্ত এবার বলছেন।
লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন। না, শুধু জেন্টলমেন, লেডিজ নেই। আমি বেদ-বেদান্ত ভ্রম মায়া, এসব বুঝি না, বুঝতেও চাই না। আই নো ম্যান, হিজ ওয়ার্ল্ড অ্যানড এনভায়রনমেন্ট। মানুষের বাইরেটা কিছুই নয়, ভেতরটাই সব। কনসাস নয়, সাব কনসাসেই যত গেঁড়াকল। মানুষ হল আইসবার্গ। মনের তিনের চার অংশ ভাসমান বরফের মতো সাবকনসাসে তলিয়ে, একের চার ভেসে যাচ্ছে বাইরে।
এই যে মগ্নচৈতন্য, এটা মানুষের নিজের তৈরি নয়, অন্যের সৃষ্টি। সেই অন্যের সৃষ্টি। সেই অন্যের মধ্যে আছে পিতা মাতা, শিক্ষক, সমাজ, ঘটনা। আজকে আমরা জানতে পেরেছি, ম্যানস হিস্ট্রি ইজ রিটন বাই দি জিনস। রিসার্চ চলছে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সাহায্যে কালে আমরা পছন্দমতো মানুষ তৈরি করতে পারব। তখন পৃথিবী হবে প্যারাডাইস। হাক্সলির ব্রেভ নিউ ওয়ার্লর্ড সফল হবে। কিন্তু যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন অপ্রেসান থাকবে, ডিপ্রেসান থাকবে, মেলাঙ্কলি থাকবে, ফ্রাসট্রেসান থাকবে। নিউরোসিস, ইনিউরসিস থাকবে। হোমিসাইড, জেনোসাইড, রেপ থাকবে। ম্যানিয়াক থাকবে। কমপ্লেক্স থাকবে।
মানুষে-মানুষে খাঁচাখাই লেগেই থাকবে, হত্যা থাকবে, আত্মহত্যা থাকবে। নিপীড়ন থাকবে, নিষ্ঠুরতা থাকবে। ঘর ভাঙবে, ঘর গড়বে। কেউ রুখতে পারবে না। বদহজম, অম্বল, টাক, মাথা ধরা সবই থাকবে। আমরাও থাকব। ম্যানহোল খুলে পাক পরিষ্কারের মতো আমরা সাবকনসাস থেকে গাদা বের করার চেষ্টা করব। স্বামীকে স্ত্রী ফিরিয়ে দেব, স্ত্রীকে স্বামী, পিতাকে পুত্র, পুত্রকে পিতা। সৃষ্টির শেষদিন পর্যন্ত এইভাবেই চলতে থাকবে! অ্যালোপ্যাথিক ট্রিটমেন্ট। রোগ চাপা থাকবে, সারবে না। এক ক্লেশ যাবে আর-এক ক্লেশ আসবে। ক্লেশ আর ক্লেশ নিয়েই জীবন। লিবিডো। লিবিডো মানে জীবনীশক্তি, লাইফ ফোর্স। এই বাক্যটি ফ্রয়েড সাহেবের উদ্ভাবন। মানুষ পেতে চায়, ভোগ করতে চায়, উত্তেজনা চায়, উত্তেজনার প্রশমন চায়। দেহে চায়, মনে চায়। চাহিদার পরিতৃপ্তিতে শান্তি, সন্তুষ্টি। অপরিতৃপ্তিতে বিষাদ, ক্রোধ, বিভ্রান্তি। ক্রোধী মানুষ, অসন্তুষ্ট মানুষ, অতৃপ্ত মানুষ সংসারে শান্তি দিতে পারে না, শান্তি পেতে পারে না। ক্লেশমুক্ত হতে হলে নেতি চিন্তা, নেগেটিভ ফিলিংস ছাড়তে হবে। খণ্ডিত বিভক্ত মানুষ না হয়ে অখণ্ড মানুষ হতে হবে। উৎকণ্ঠা ভুলে যেতে হবে। হাত-পা ছড়িয়ে শ্লথ হয়ে বিশ্রাম নিতে শিখতে হবে। ফ্ল্যাট হয়ে শুয়ে পড়ুন। চোখ বোজান। মনে-মনে বলুন, বিশ্রাম, বিশ্রাম চাই। আমার দিন আর রাত উৎকণ্ঠায় ভরা। নেভার মাইন্ড। পনেরো কি তিরিশ মিনিট সময় আমি সব কিছুর বাইরে। তালে-তালে, লয়েলয়ে নিশ্বাস নিতে থাকুন। এরই নাম শবাসনে প্রাণায়াম।
আধুনিক সভ্যতার দান উৎকণ্ঠা, দুর্ভাবনা। দুর্ভাবনার চেয়ে দুরারোগ্য ব্যাধি আর কিছু নেই। বুদ্ধদেব বলেছিলেন, চিতা দহতি নির্জীব, চিন্তা দহতি সজীব। মুক্তির উপায়, ভয়ে দেখে পেছিয়ে। যেও না, ভয়ের মুখোমুখি হয়ে লড়ে যাও। অ্যাক্ট, অ্যাকসান ইজ দি রেমিডি। ওয়ার্ক অ্যান্ড নো ওরি ইজ দি রেসিপি।
আত্ম সমীক্ষা। নিজেকেই নিজে বিচার করুন। প্রত্যেকের মধ্যেই মাইনাস পয়েন্ট, প্লাস পয়েন্ট আছে। মাঝে-মাঝে নিজের বিবেকের মুখোমুখি দাঁড়ান। নিজের অক্ষমতা, সক্ষমতা, নিজের ভালো দিক, মন্দ দিক সমালোচকের দৃষ্টিতে দেখুন। নিজেকে জানা মানেই নিজেকে সংযত করা, শুদ্ধ করা, সুন্দর করা। প্রতিদিন নিজেকে আবিষ্কার করুন, ভেঙে ফেলে নতুন করে গড়ুন। গ্যেটে বড় সুন্দর কথা বলেছিলেন, আমরা যখন বলি দুনিয়াটা পালটে গেছে, আগের মতো আর নেই তখন ভুলে যাই নিজেও কত পালটে বসে আছি।
আমাদের শাস্ত্রে একটা কথা আছে সুইট লেমন মেন্টালিটি। পাতিলেবু কখনও মিষ্টি হতে পারে না। জীবন একটা টক-মিষ্টি অনুভূতি। কখনও শূন্য, কখনও পূর্ণ। জীবনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ হতে পারে না। শুধু গোলাপ নয়, গোলাপ আর কাঁটা। সুমিষ্ট পাতিলেবুর আশায় যাঁরা ঘুরছেন তাদের ক্লেশ কে নিবারণ করবে! সুইট লেমন মেন্টালিটি ছেড়ে পৃথিবীর সব কিছু মেনে নিতে হবে হোল লিভিং উইথ অল ইটস গিফটস, সুইট অ্যান্ড সাওয়ার। পৃথিবীতে আমাদের চাওয়ার শেষ নেই। পাওয়াতে আমাদের চাওয়ার নিবৃত্তি নেই। আমি কিছুই চাই না এই হল ক্লেশ নিবারণের। শেষকথা।