জন্মের ওপর দেবতার কোনও হাত নেই। তিনি সোনার পালঙ্কে আসতে পারেন, ছেঁড়া কাঁথায় এসে চিতপাত হতে পারেন, ফুটপাতেও গড়াগড়ি দিতে পারেন। জন্মের ওপর কোনও কনট্রোল নেই। কামার্ত হয়ে যে যাকে জড়িয়ে ধরবে সেইখানে ভগবান দেহ ধারণ করবেন। তারপর শুরু হবে তার দাসত্ব। সবরকমের নিপীড়ন, উৎপীড়ন। অন্য প্রাণী কত মানুষের মতো এমন জন্মেই দাসত্ব করে না। বাঘ, সিংহ, গণ্ডার। পরাভূত হয়, দাস হয় না। এই হল শয়তানের প্ল্যান। দেহভূত ভগবান রোগ শোক, জুরা ব্যাধি নিয়ে চলেছে-তো-চলেছেই। মরণ রে উঁহু মম শ্যাম সমান। শয়তানের তৈরি আখ মাড়াই কলে দেহী ভগবান ছিবড়ে হচ্ছে। সেই কল চলছে শয়তানের অর্ডারে, মানুষ বা ভগবানের তত্ত্বাবধানে।
স্টেট চায় বশ্যতা। ওসব ডেমোক্রেসি-ফেমোক্রেসি চোখে ধূলো দেওয়ার ব্যাপার। সংঘ, সংগঠন হল কিছুর ওপর কিছুর লাঠি ঘোরানো। এ ওকে চেপে রাখছে, ও তাকে চেপে রাখছে। সংসারে, সমাজে, সেরেস্তায়, রাজদ্বারে সর্বত্রই সেই নিষ্পেষণ। টর্চারের কল চলেছে। হাঁটু মোড়ো, হাত জোড় করে বলো, দাস আমি, প্রভু তুমি, হে মনুষ্যভূত দেবতা তোমার সামনে আমি নতজানু। তুমি যা বলবে তাই বলব। যেমন করে বলাবে তেমন করেই বলব, আমার কোনও স্বাধীনতা নেই। তুমি ভাতে মারতে পারো, তুমি হাতে মারতে পারো। আমি আমার দেহকে ভয় পাই, তোমার নিপীড়নকে ভয় পাই। তোমার প্রসাদে আমার এই অস্তিত্ব!
বক্তা ছাতি বগলে নেমে পড়লেন।
আপনি কে? পরিচয়, পরিচয়?
আমি এক বুদ্ধিজীবী মানুষ। কেরানি। গুডবাই ফ্রেন্ডস।
১০. দশম অধিবেশন
আজকে আমরা কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমাদের এই সভায় এনেছি। আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি। ইনি স্বামী মুগ্ধানন্দ। নমাসে হিমালয়ে থাকেন। তিন মাস ভ্রমণ করেন।
নমস্কার মহারাজ!
জয়স্তু।
ইনি ডক্টর সিদ্ধান্ত। সাইকোলজিস্ট। সারা ভারতে এঁর নাম। বহু পাগলকে সুস্থ করেছেন। বহু খুনিকে সাধু করেছেন। বহু ডিকটেটারকে ডেমোক্র্যাট করে ছেড়েছেন।
নমস্কার।
নমস্কার।
এই ভদ্রলোকের নাম অমল বোস। ইনি ডগট্রেনার। ব্যারাকপুরে কুকুরের স্কুল খুলেছেন। কুকুরকে ইনি মানুষের বাবা বানাতে পারেন।
নমস্কার।
নমস্কার।
ইনি হলেন চৈতন্য মুখোপাধ্যায়। গণিতের শিক্ষক। অঙ্ক কেটে জোড়া লাগান। বহু গাধাকে পিটে-পিটে গরু করেছেন।
নমস্কার।
নমস্কার নমস্কার।
ইনি হলেন নরেশ বেদান্ত। দার্শনিক। জগৎ মিথ্যা ব্রহ্ম সত্য, ব্রহ্ম মিথ্যা জগৎ সত্য, এইসব মারাত্মক-মারাত্মক বিষয় নিয়ে ইনি গবেষণা করেন। পথ চলতে-চলতে গীতার শ্লোক আওড়ান। বেদ-বেদান্ত এঁর কণ্ঠস্থ।
নমস্কার।
শুভায় ভবতু।
এঁর নাম হরিসাধন ভট্টাচার্য। পুরোহিত। ভাটপাড়ায় টোল ছিল। জুটমিলের শব্দে শ্যামনগরে চলে এসেছেন। টোল উঠে গেছে। জীবনে অসংখ্য শ্রাদ্ধ ও বিবাহকর্ম করিয়েছেন। সুপণ্ডিত মানুষ। একটি সংস্কৃত শব্দও ভুল উচ্চারণ করেন না। উপনয়ন ও বিবাহের সময় যজমানকে সংস্কৃত মন্ত্রের অর্থ বলে দেন।
নমস্কার।
কল্যাণ হোক।
ইনি হলেন রামরাম বাটপাড়িয়া। ব্যাবসাদার মানুষ। স্বাধীনতার আগে কোটিপতি ছিলেন। বর্তমানে অবুদপতি।
নমস্কার।
নমস্তে জি।
হাঁ জি।
ইনি হলেন পন্টু হালদার। ফেমাস মাস্তান। হ্যাঁ, মাস্তান বললে ইনি অসন্তুষ্ট হন না, বরং গর্ববোধ করেন। কারণ মাস্তানী এখন জাতে উঠেছে। ভেরি ডিগনিফায়েড প্রফেশান।
নমস্কার।
ঠিক আছে, ঠিক আছে।
ইনি হলেন বটু পাল। নেতা। ছবার এম এল এ হয়েছেন। ট্রেড ইউনিয়ন করেন। এঁর কথায় দেশীয় শিল্পের চাকা চলে, চাকা বন্ধ হয়। ডজনখানেক বন্ধের সফল শিল্পী।
নমস্কার।
সেলাম। শ্রমিক ঐক্য জিন্দাবাদ। চলবে না, চলবে না। ও সরি।
সরি।
ইনি হলেন অ্যাডভোকেট এ. এন. ঘোষ। ইনি দোষীকে নির্দোষী, নির্দোষীকে দোষী প্রমাণ করায় সিদ্ধ।
নমস্কার।
থ্যাঙ্ক ইউ।
এইসব গুণী মানুষকে আজ আমরা এক ছাদের তলায় একসঙ্গে উপস্থিত করেছি একটি মাত্র উদ্দেশ্যে–পথের সন্ধান পাব বলে। মানুষ হয়ে জন্মেছি, যতদিন না মৃত্যু আসছে ততদিন এই জীবন টেনে-টেনে চলতে হবে। আমাদের মৃত্যুর পরও মানুষ আসবে, মানুষ থাকবে। জীবন মানেই ক্লেশ। তবু চেষ্টা ক্লেশহীন জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় কিনা। শঙ্করাচার্য বলেছেন–যাবৎ জনমং তাবৎ মরণং যাবৎ জননী জঠরে শয়নং ক্ষণপতি সজ্জন সঙ্গতিরেকা ভবতি ভবার্ণবে তরণে নৌকা। এঁরা একে-একে আমাদের পথ বাতলান। গৃহিনীরা জানেন পেঁয়াজ ছাড়াতে গেলেই চোখে জল আসে। বাঁচার উপায়ও জানেন–বটির ডগায় একটি পেঁয়াজ গেঁথে রেখে পেঁয়াজ ছাড়ালে চোখে জল আসে না। সেইরকম ভাণমুক্ত, ক্লেশমুক্ত, জীবনযাপন পদ্ধতি হয়তো এঁদের জানা থাকতে পারে। স্বামী মুগ্ধানন্দ, আপনি আলোকপাত করুন প্রভু।
নারায়ণং নমস্কৃত্য নরষ্ণৈব নরত্তোমম
দেবীং সরস্বতীবৈষ্ণব ততোজয়মুদীরয়েৎ।
আপনারা মনুষ্যক্লেশ নিবারণের চেষ্টা করেছেন। উত্তম কার্য। তবে গোড়াতেই আমার মনে একটি সংশয় জাগছে–কীসের ক্লেশ, কার ক্লেশ। জগৎ একটি মায়া। ব্রহ্মই সত্য। মায়ার পরদার মধ্যে দিয়ে দেখছি বলেই জগৎকে সত্য বলে মনে হচ্ছে। জগৎ বলে কিছু নেই। সবই একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বপ্ন মাত্র। সত্য মনে করলেই সত্য, মিথ্যা মনে করলেই মিথ্যা। ক্লেশ মনে করলেই ক্লেশ, অক্লেশ মনে করলেই অক্লেশ। সবই এক বিরাট খেলা। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছেন–পাঁকে থাকবি পাঁকাল মাছের মতো। গায়ে পাঁক লাগবে না। এ দুনিয়া ধোঁকার টাটি, খাই দাই আর মজা লুটি। তবে হা ব্রহ্মজ্ঞান তো আর সকলের হয় না, হতে পারে না। আমাদের সব মতুয়ার বুদ্ধি। গরু যতক্ষণ হাম্বা হাম্বা করে ততক্ষণে তার মুক্তি নেই। যেই মরল অমনি তার নাড়ি শুকিয়ে একতারার তাঁত হল, অমনি সে তুঁহুঁ-তুঁহুঁ করে বেজে উঠল। চিরমুক্তি। আমি-আমি, হাম্বা-হাম্বা তখনই দাসত্ব। আমি যেই শেষ হল গরুর তখন তুঁহুঁ অবস্থা। তুঁহুঁতেই মুক্তি। সব ছাড়া যায়, আমি ছাড়া যায় না। জগৎকে সত্য ভেবে যারা রোগ শোক জরার দাসত্ব করছেন, প্রতিদিন সংসারে মার খাচ্ছেন তাঁর এই গানটি শুনুন–