অ্যায়, আমি বলছেন কেন? বলুন সে বলবে। আমি গো।
ওই হল। সেই তো আমি, আমিই তো সে।
বাঃ তুমিটা তাহলে উবে গেল?
না উবে যাবে কেন? কত রকমের বাদ আছে জানেন, দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ। কখনও আমিই সব। আমার জমিজমা, বিষয়সম্পত্তি, নাম ধাম কাম। সব আমার। লীলার সময় আমি তুমি। মিলনে তুমহি হি হি। হি মানে সে বা তিনি। তখন তন্ত্র।
তোমার ওসব মামদোবাজি রাখো। রেখে কবুল করো তুমি কি ধরনের মাল। নিজে করো তো ভালো, যদি না করো সমগ্র নারীজাতির স্বার্থে আমাকেই করতে হবে।
আজ্ঞে হ্যাঁ, চাপে পড়েই বলতে হচ্ছে স্ত্রীরা জন্মায় না তৈরি হয়। এক-এক স্ত্রীর এক এক স্বভাব। সেই স্বভাবের জন্যে দায়ী তাদের স্বামীরা।
এই তো পথে এসো। মনে পড়ে বৎস, বিয়ের আগে পাঁচটি বছর কি তেলান তেলিয়েছিলে আমাকে! পাঁচটায় এসো। মেট্রোর সামনে দাঁড়িয়ে আছ বাঁকা শ্যাম হয়ে। তিনটের সময় দাঁড়িয়ে থেকো বকুলতলায়। দুপুর রোদে কাগজ মাথায় দিয়ে মরা বকুলতলায় দাঁড়িয়ে আছেন আমার প্রেমিক চিদু। পার্কে বসে চানাচুর খাও, ঝালমুড়ি খাও, চকোলেট খাও, ফুচকা খাও, ভেলপুরি খাও। চলো যাই সিনেমায়, থিয়েটারে জলসায়। কত মিঠিমিঠি হাসি, মিঠিমিঠি বাতেঁ। ভ্যাজোর-ভ্যাজোর এক কথা, তুমি আমার প্রাণ, তুমি আমার সিন্ধু, জাহ্নবী, যমুনা, তুমি আমার লাইট-হাউস, তুমি আমার টর্চের ব্যাটারি, হৃদয়ের ধুকপুকি। তুমি আমার গোলাপখাস, গোলাপি রেউড়ি। দুব্বো ঘাস দিয়ে গায়ে সুড়সুড়ি। মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে দিয়ে, বাঃ বেশ বউটি। চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। তোমার শেষ ট্রাম চলে যাবে। যাকগে, তবু তোমাকে ছেড়ে আসি। প্রয়োজন হয় পয়দলে ফিরব। তোমার জন্যে আমি লাইফ স্যাক্রিফাইস করতে পারি। সেই তুমি আর এই তুমি!
আহা প্রেমে আর রণে একটু ছলাকলা শাস্ত্রসম্মত ব্যাপার। মনে নেই ইংরেজরা মীরজাফরকে মসনদে বসাবার লোভ দেখিয়ে সিরাজের পেছনে বাঁশ দিয়ে কেমন পানাপুকুরে ফেলে দিয়েছিল। সেম কেস। প্রথমে চার করে টোপ ফেলো, মাছ ঘাই মেরে যেই টোপটি গিলল মারো টান।
ও এই তোমার মনের ভাব? ভালোবেসে ল্যাং মারা! তাহলে জেনে রাখো তুমি যদি ঘোড়া হও আমি সেই খোঁড়া।
শুনলেন, শুনলেন আমি নাকি ঘোড়া!
মনে নেই বিয়ের পর বছর খানেক কি করেছিলে? ঘুরতে ফিরতে, শুতে বসতে মাধু মাধু। একবার চিদু বলে ডাক ভাই।
আহা সেইটাই তো আমার প্রেমের প্রথম উল্লাস। প্রথম উল্লাসেই আমার কোমর ভেঙে গেল। বাপস তোমার কি ওজন! উইনডো সিলে উঠে, ছাপা শাড়ি পরে সার্কাস-মোহিনীদের মতো ছিটকিনি লাগাচ্ছিলে। হঠাৎ বেরিয়ে এল সে। সেই বোম্বাই হিরো। তোমাকে মনে হল হেলেন। কোমরটা ধরে শূন্যে তুলে বার্ট ল্যাংকাস্টারের মতো যেই না একপাক ঘুরেছি মট করে একটা শব্দ হল, কোমরটা খুলে গেল। তিনমাস বিছানায়। তখনই বুঝলুম স্ত্রী অতিশয় গুরুভার পদার্থ। তারপর আমি আর অমন প্রেমাস্ফালন দেখিয়েছি! দেখাইনি। তাহলে তুমি কেন খোঁড়া হয়ে গেলে ডার্লিং!
কেন হলুম? বলব সেকথা! তোমার প্রথম উল্লাসের দিনে তোমার স্ত্রীর কি মাথার ওপর হাত তোলার উপায় ছিল? আমার হাত তোলা মানেই তোমার চিত্ত বিক্ষেপ এবং স্থান-কাল-পাত্র ভুলে লণ্ডভণ্ড কাণ্ড। ছিটকিনি হাত না তুলে লাগানো যায়?
সে একটু হতেই পারে। তুমি নারী আমি নর। আমি নারী তুমি নর হলে তুমিও অমন হেদিয়ে পড়তে। তা বলে তুমি আমার সাড়ে তিনশো টাকা দামের ব্রিফকেসের ওপর মড়মড়িয়ে উঠে জানালার ছিটকিনি বন্ধ করবে?
মনে পড়ে, একদিন ইডেনে ঘাস ভিজে ছিল? আমার শাড়িতে দাগ লেগে যাবে বলায় তুমি ব্রিফকেস পেতে দিয়ে মহাদরে বসিয়েছিলে। তখন তো তোমার বুক মোচড় দিয়ে ওঠেনি। বলেছিলে, আমার ব্রিফকেস ধন্য হল। সেই ঈশ্বরী পাটনির নৌকা। মা অন্নপূর্ণার পায়ের স্পর্শে সেঁউতি সোনার হয়ে গেল।
তখন তো তুমি প্রেমিকা ছিলে। প্রেমিকা একটা অন্য রকম ব্যাপার। কল্পনা-কল্পনা রোমানস টোমানস মিলিয়ে ভূতের মতো। আকৃতি আছে শরীর নেই। প্রেমিকা হল পালকের মতো, তুলোর মতো হালকা। স্ত্রী হল পাথর লোড। প্রেমিকার প্রেম ছাড়া কোনও কর্তব্য নেই। স্ত্রীর কত কর্তব্য। স্ত্রী হওয়া মানেই বশ্যতা স্বীকার করা, সাবমিশান। বরফ দেখেছ? বরফ তুষার। চারদিকে পড়ে আছে পেঁজা তুলোর মতো। আবার কুলফি মালাইও দেখেছ। প্রাক-বিবাহিত জীবন সেই তুষারের মতো। কিন্তু যেই তুমি বিয়ে করলে অমনি হয়ে গেলে খাপে ভরা কুলপি মালাই। এক সংসার থেকে এসে আর-এক সংসারের খোলে ঢালাই হওয়া। একটা জিনিস বোঝ না কেন, মেয়েরাই বিয়ের পর সব ছেড়েছুঁড়ে শ্বশুরবাড়ি যায়, ছেলেরা যায় না। নিয়মটা আগে ওলটাও তারপর গালগলা ফুলিয়ে চিৎকার করবে। তুমি হলে লেপ, আমার ইচ্ছে হলে শাটিনের ওয়াড় পরাব, ইচ্ছে হলে মার্কিনের। লেপের কিছু স্বাধীনতা আছে কি?
তার মানে পুরুষ-জাতি স্বার্থপর। সুবিধেবাদি। প্রবঞ্চক। কাজের সময় কাজি, কাজ ফুরোলেই পাজি।
তা বলতে পারো।
সময় তো অনেক এগোল, চারদিকে শিক্ষার প্রসার, বিজ্ঞান মানুষকে সঁদে পাঠাচ্ছে, তোমাদের স্বভাব একটু সংশোধন করে দেখো না! সেই ঘিনঘিনে স্বামী, বউকাঁটকি শাশুড়ি! আর কতকাল চলবে এইভাবে!