বউকে টপকে খাট থেকে নেমে রেগুলেটর ঘুরিয়ে তিনে করে দিলুম। তারপর আবার বউ লঙঘন করে নিজের জায়গায় শুলুম। আবার ঘুম আসছে।
–শুনছ?
–কি হল প্রাণেশ্বরী?
–সুবিধে হল না। ভোলটেজ ড্রপ করেছে। তুমি-আর একবার কষ্ট করে ফুল পয়েন্টে করে দিয়ে এসো, লক্ষ্মীটি।
আবার ঘাড়ের ওপর দিয়ে হুড়মুড় করে মেঝেতে এসে পড়লুম। এবার খুব রেগে গেছি। আর শোওয়া নয়। টুলে বসেই রাতটা কাটিয়ে দিই, জরুকা গোলাম।
–কি হল, শোবে না?
–শুয়ে তো লাভ নেই। আবার ওঠাবে, ভোলটেজ বাড়বে কমবে, ভোলটেজ স্টেবিলাইজার হয়ে বাইরেই বসে থাকি।
–রেগে যাচ্ছ কেন? কত সহজেই তোমরা রেগে যাও। একটুও সহ্য শক্তি নেই। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলে গেছেন তিনটে স–শ ষ স সহ্য কর, সহ্য কর, সহ্য কর তিনবার। নাও চলে এসো। এবার শীত করলে তোমাকে জড়িয়ে ধরে শোব।
মশাই এই হল আমার রাত। দিনের কথা শুনলে আঁতকে উঠবেন।
০৮. অষ্টম অধিবেশন
মনুষ্যক্লেশ নিবারণের নাম করে মেয়েদের খুব কেচ্ছা করা হচ্ছে, লজ্জা করে না আপনাদের? নারী হল শক্তির অংশ, নারী হল জগদ্ধাত্রী। আমরা আছি বলেই তো আপনারা আছেন। কোথায় সেই পামর যে ভোলটেজ স্টেবিলাইজার হয়ে সারারাত পাখার সুইচ-এর তলায় বসে থাকে বলে খুব নাকে কেঁদেছে? কোথায় সেই ভদ্রলোক?
আজ্ঞে আপনাকে দেখে চেয়ারের তলায় লুকিয়েছে।
তাই নাকি! এই যে বেরিয়ে এসো। উঠে এসো। তোমার ছেলেকে যা শোভা পায় তোমায় তা শোভা পায় না। লড়তে হয় সামনা-সামনি লড়ে যাও! আমি কি করি, আর তুমি কি করো এঁদের সামনেই তার বিচার হয়ে যাক। উঠে এসো।
তুঁমি আঁবার তেঁড়েমেড়ে এঁই জঁনসঁমক্ষে এঁলে কেঁন?
ইয়ে হ্যায় ইজ্জত কি সওয়াল। নাকে কেঁদে পার পাবে না। চেপে ধরলেই চিঁচি ছেড়ে দিলেই লম্ফঝম্ফ, তোমাকে আমি হাড়ে-হাড়ে চিনি।
আমি না-হয় আমার দুঃখের কথা একটু সাতকান করেই ফেলেছি তা বলে এই কি একটা ঝগড়া করার জায়গা? নারী হবে ন, নতমুখী, সহিষ্ণু, মৃদুভাষী। নরম-নরম গরম-গরম। রোদে দেওয়া শীতের বিছানায় মতো।
ন্যাকামো রেখে এদিকে উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়াও।
উঃ তোমার এই ল্যাঙ্গোয়েজ, সো ভালগার। ভাবতে পারো, দুর্গা কি মা জগদ্ধাত্রী আরতির সময়, চারদিকে ধূপধুনোর ধোঁয়া, কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ, ভক্ত নরনারী গদগদ, হঠাৎ বলে উঠলেন, ন্যাকামি রাখো।
তা কেন?
বাঃ এই বললে তুমি হলে জগদ্ধাত্রী, সিংহবাহিনী। তা ভাষা, চাল-চলনটাও তো সেই রকম হওয়া উচিত।
বাজে না বকে পাশে এসে দাঁড়াও।
আহা যান না মশাই, মিসেস যা বলছেন শুনুন না! তখন তো খুব গিন্নির নামে বলছিলেন, এবার ম্যাও সামলান। আমরা বাবা বলিও না ঝামেলাতেও পড়ি না। আমরা জানি সরকারের বিরুদ্ধে আর স্ত্রীদের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানেই সিডিসান। পাচে পড়ে যাব। পুলিসের গায়ে কিল না মেরেই মরতে হয়, মারলে তো কথাই নেই।
আচ্ছা, আপনারা এইবার দেখুন, দুজনের হাইটটা দেখুন। আমার স্বামী আমার চেয়ে প্রায় একহাত লম্বা।
পশ্চিম বাংলায় সাধারণত তাই হয়। বউ মোটা তোক ক্ষতি নেই তবে মাথায়-মাথায় না হলেই ভালো। মাথা ছাড়িয়ে গেলে নাকচ। বউ লম্বা হলে কত্তার অকল্যাণ হয়। লোকে বলে হিড়িম্বা। বউ নয় তো যেন গিলে খেতে আসছে। এই তো বেশ মানিয়েছে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন মনে হচ্ছে যেন–মেড ফর ইচ আদার। দেখুন-দেখুন কি সুন্দর মানিয়েছে, যেন হরগৌরী, যেন দুষ্মন্ত শকুন্তলা, যেন রাম আউর রমা। আমার ঠাম্মা দেখলে নমস্কার করে বলতেন আহা নয়ন সার্থক হেন লক্ষ্মী-জনার্দন।
স্টপ।
বউ বেঁটে, স্বামী লম্বা। যে বাড়িতে বসবাস সেই বাড়িতে সমস্ত দরজা-জানালা সাত থেকে দশ ফুট উঁচুতে। ডিঙ্গি মেরে-মেরে নাগাল পাওয়া যায় না। জানালার গবরেটে উঠে উল্লুকের মতো ঝুলতে ঝুলতে প্রথম-প্রথম ছিটকিটি লাগাতুম। তখন সবে বিয়ে হয়েছে, এমন ঢিপসি হয়ে যাইনি। উনি বললেন, তুমি যখন জানলায় উঠে ওভাবে লচকে লচকে ছিটকিনি লাগাও তখন আমার ভেতর থেকে বোম্বে ছবির একটা হিরো বেরিয়ে আসে। একদিন হঠাৎ, না আমি বলতে পারব না, লজ্জা করছে।
আপনি হেলপ করুন। উনি মুখ ঘুরিয়ে থাকুন। আপনি বলে ফেলুন। মনে করুন এটা আদালত কিংবা চার্চের কনফেশান বক্স। ক্রাইম কবুল করুন।
ক্রাইম আবার কি? স্ত্রীকে ধরে পেটালেও ক্রাইম হয় না, আদর করলেও রেপ হয় না। মনুসংহিতা বলছে।
দ্বিধাকৃত্বাত্মনো দেহমর্ধেন পুরুষোহভবৎ।
অর্ধেন নারী তস্যাং স বিরাজমসৃজৎ প্রভুঃ।।
সৃষ্টির পূর্বে ঈশ্বর আপনাকে দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া এক অংশে পুরুষ, অপরাংশে নারীমূর্তি পরিগ্রহ করিলেন ও সঙ্গত হইলেন। তার মানেটা কি! আমার অর্ধেকটা আমি আর অর্ধেকটা উনি। হাফ প্লাস হাফ ইজ ইকুয়ালটু সেই।
সেইটা কি?
আমি। সেই মহা আমি, যার এত হাঁকডাক হম্বিতম্বি, রাজা প্রজা, বড়বাবু ছোটবাবু, সধবা বিধবা, হিরো ভিলেন, সাধু শয়তান প্রজা ক্যাপিটাল আমি। বউকে পেটানো মানে নিজেকে পেটানো, খামচানো মানে নিজেকে খামচানো, আদর করা মানে নিজেকে আদর করা। ওর ভেতর কে বসে আছে ঘাপটি মেরে? আমি। হাম হায়। বৃহদারণ্যক পড়ুন ও ন বা অরে জায়ায়ৈ জায়া প্রিয়া ভবত্যত্মনস্তু কামায় জায়া প্রিয়া ভবতি। জায়ার ভেতর আত্মস্বরূপিণী দেব বর্তমান। তাই তো জায়া এত প্রিয়। তার মানে কি? কে একটা আমার ভেতরেও রয়েছে ওর ভেতরেও রয়েছে। যেই বলব, কে গো, সে বলবে আমি গো, আবার যেই ও বলবে, কে গো, আমি বলব, আমি গো।