এরপর ঝড়বৃষ্টির কাল আসছে, বর্ষা আসছে। সে আর-এক খেলা। সব জানালা খুলে শোয়া হল, মাঝরাতে তেড়ে ঝড়বৃষ্টি এল। আমার এই দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে এমন একটা দিন দেখলাম না যে দিন আমার বউ উঠে জানালা বন্ধ করেছে। মশারি তিমির পেটের মতো ফুলে উঠেছে। হু-হুঁ করে ধুলো ঢুকছে। তিনি শুয়ে আছন কাঠের পুতুলের মতো। এই শর্মাকেই তেড়েফুঁড়ে বেরোতে হবে, সারা বাড়ির যেখানে যত জানালা দুমদাম করে পড়ছে। সব একে-একে জলঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে বন্ধ করতে হবে। যেই ফিরে এসে শোব অমনি সেই মোলায়েম গলাসব বন্ধ করেছ তো?
হ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ।
রান্না ঘরেরটা?
হ্যাঁ সেটাও।
রান্নাঘরের জানলা দেখেছেন? যমেও ছোঁবে না। হাতময় কালি। একদিন রেগে গিয়ে, হ্যাঁ সেটাও বলি, সেই কালি রাত দুটোর সময় সারামুখে মাখিয়ে দিয়েছিলুম। ভোর পাঁচটায় ট্যাক্সি ডেকে বাপের বাড়ি। হাতে হ্যারিকেন। পনেরো দিন পরে পায়ে ধরে নিয়ে এলুম। শ্বশুমাতা উপদেশ দিলেন– পরের বাড়ির মেয়ে নিয়ে গেছ বাবা, অত্যাচার করলে তোমারই নিন্দে হবে। কি বংশের ছেলে তুমি। এ তো বউয়ের মুখে কালি নয় তোমার বংশের মুখে কালি। তুমি দোলের দিনে মাখাও কেউ কিছু বলবে না। অ্যালুমিনিয়াম মাখাও, আলকাতরা মাখাও, গরুরগাড়ির চাকার কালি মাখাও, বচ্ছরকার দিনে কেউ কিছু বলবে না। মজা দেখুন, শ্বশুরবাড়ির কাউন্সিলে আমাদের কেস আনরিপ্রেজেন্টেড। আমাদের পক্ষে কেউ বলার নেই, কেউ শোনার নেই। সেন্টার টেবিলে স্টেনলেস স্টিলের থালা। চারটে ফুলোফুলো বাদামি লুচি। কড়কড়ে আলু ভাজা। দুটো রসগোল্লা। ঢাউস এককাপ চা। সামনে চশমা চোখে সিগারেট মুখে গম্ভীর শ্বশুরমশাই। আর-এক চেয়ারে ষণ্ডামার্কা আধুনিক চেহারার শ্যালক। ঘরের মাঝখানে কাঁচাপাকা চুল ক্ষয়ক্ষয়া শাশুড়ি। দরজার বাইরে পরদা ধরে ম্যাকসিপরা মহা আদুরি শ্যালিকা। লুচি সহযোগে উপদেশ শুনে বউ বগলে বাড়ি। বউয়ে অরুচি!
নাও কাম টু দি পাখা প্রবলেম। খাটের ধারে শোবেন বউ। দেওয়ালের দিকে শোবেন স্বামী। যুক্তি–আমাকে তো ভোরে উঠতে হবে, টুক করে পাশ থেকে খসে পড়ব, তোমার ঘুমের ব্যাঘাত হবে না।
অফিসের ভাত ধরায়। সাত খুন মাপ। কিন্তু আমাকে যে বাথরুমে যেতে হয়।
বাথরুমে যাবে কেন? শোওয়ার আগে বেশ করে জল খেয়ে ঘণ্টাখানেক বসে-বসে মশার কামড় খাও তারপর বাথরুম করে একেবারে ড্রাই হয়ে শুয়ে পড়ো। রাতে বারেবারে উঠতে নেই খোকাবাবু। টানা ঘুমোতে হয়। এক ঘুমে রাত কাবার।
বেশ বাবা তাই হোক। শ্বমাতা বলেছেন স্বামী মানেই স্যাক্রিফাইশ। সন্ন্যাসীও স্বামী, বউয়ের বরও স্বামী।
কিন্তু ম্যাডাম আসল খেল তো শুরু হবে শোওয়ার পর।
মশারির ভেতর তিনি, বাইরে তার ঝুলন্ত পা জোড়া। পাতায়-পাতায় ঘষে ধুলো ঝরাতে ঝরাতেই গোটাকতক মশা ঢুকবে। এরপর তিনি ভেতরে পা টেনে নিতে-নিতেই আরও গোটাকতক। এরপর চুড়িবাদ্য করতে-করতে লটরপটর হাতে মশারি খুঁজতে-গুঁজতে আরও খানকতক। এইবার খোঁপা আলগা করে শয়ন ও হাই উত্তোলন–আলো নেবাও।
হয়ে গেল আমার পড়া। চোখে আলো পড়লে ঘুম হবে না। ঘুম না হলে ভোরে ওঠা যাবে না। দায় আমার। আলো নিবল। একটু উসখুস। দু-চারবার পায়ের পাতায়-পাতায় ঘষাষষি।
উঃ মশা ঢুকেছে। আলো জ্বালো।
আলো জ্বলল।
–নাও মশা মারো।
হাঁটু গেড়ে মশারির আয়তক্ষেত্রের ভেতরে এক বাহু থেকে আর-এক বাহুতে আমার ছোটাছুটি আর দুহাতে তালি। মশা কি অত সহজে মরে! তিনি শুয়ে-শুয়ে নির্দেশ দিতে থাকবেন।
–ওই যে ওই যে, ওই তো ওই কোণে, ওই কোণে। হা-হা উড়ে এদিকে চলে এল। ধ্যাস ল্যাদাডুস। মশা মারতেও শেখোনি, চাকরি করো কি করে!
মশার সঙ্গে গাদি খেলা। শেষে তাঁর দয়া হবে।
–নাও নিবিয়ে দাও, হয়েছে-হয়েছে।
আবার আলো নিবল। ঘুম আসছে-আসছে। গলা শোনা গেল।
–শালা খুব জ্বালাচ্ছে।
–কে?
–মনে হয় একটা পুরুষ মশা।
–কি করে বুঝলে পুরুষ মশা?
–তা না-হলে কানের কাছে এত গুনগুন করে গান গাইবে কেন? কামড়াবি কামড়া। তোমার মতো স্বভাব আর কি! একবার শুরু করলে চাপড় না খাওয়া পর্যন্ত থামতে চাও না।
–বেশ তা না-হয় হল। স্বামী আর মসকুইটো এক শ্রেণীর মাল, তা আমাকে এখন কি করতে হবে?
–মারতে হবে। আলো জ্বালো।
আলো জ্বেলে আবার মশার সঙ্গে এক চক্কর চোর পুলিশ খেলা। আবার শুতে-শুতেই বায়নাক্কা–হে প্রাণনাথ গলা শুকিয়ে গেছে, এক গেলাস জল। মশারির ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে জলের গেলাস নিয়ে আধশোয়া হয়ে আলগোছে ঢকঢক করে জল খেয়ে একটি প্রাণঘাতী শব্দ ছাড়া হল–আঃ। বিছানার বাইরে আমি দাঁড়িয়ে আছি মহারানির খাস ভৃত্য। গেলাসটা নিয়ে রেখে দিতে হবে।
গেলাস রাখতে-না-রাখতেই হুকুম মনে হয় অম্বল হয়ে গেল, দুটি জোয়ান দাও তো গো।
জোয়ান খেয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়া হল। খাট কেঁপে উঠল। ভাবলুম শেষ হল। অতই সহজ!–পাখাটা পুরো করে দাও। বেশ তাই করে দি। বিছানায় এসে শুয়েছি। বেশ ঘুম আসছে। দুচোখ জুড়ে। শুনছ? হ্যাঁ গো শুনছ?
–বল।
–পাখাটা তিন করে দাও, শীত-শীত করছে।
–তুমি করে দাও না!
–আমি শুয়ে পড়েছি। নামতে গেলেই মশা ঢুকে যাবে, পায়ে ধুলো লেগে যাবে।
–আমারও তো তাই হবে।
–তুমি নামার কায়দা জানেনা, তোমার চটি আছে।