এই হল দুটো এক্সট্রিম টাইপ। এদেরই পারমুটেশান কমবিনেশানে আমাদের দেশের যাবতীয় বউ। সকলেই রাগী। কেউ বদরাগী কেউ আবার নিমরাগী। কেউ রেগে গেলে কেঁদে ফেলেন, কেউ খামচাখামচি করেন, কেউ কাপডিশ, জুতো, ঝ্যাঁটা ছোঁড়েন, কারুর হাঙ্গারস্ট্রাইক শুরু হয়ে যায়, কেউ বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন, কেউ বাপের বাড়ি যাব বলে সুটকেস গুছোতে থাকেন। সংসারের স্থির জলে এঁরা হলেন উড়ুক্কু মাছ। দেওয়ালের গায়ে বসে শুড় নাড়া আরশোলাও বলতে পারেন। থেকে-থেকেই সংসারের এ-দেওয়াল ও-দেওয়ালে ফরফর করে উড়ে বেড়ান।
এখন বলুন আপনার বউ কোন প্রজাতির?
আজ্ঞে মিক্সড টাইপ। আপনি যেসব লক্ষণ বললেন তার কিছু কিছু মেলে তবে ইনি রেগে গেলে গান করেন আর খাওয়া বন্ধ হয় না বরং বেশি-বেশি খেতে থাকেন।
হুঁ, এঁরা খুবই সাংঘাতিক ধরনের। কোল্ড অ্যান্ড ক্যালকুলেটিং টাইপ। এঁদের সঙ্গে ঘর করতে পারেন। তারাই যারা মোটাসোটা গাবদাগোবদা একটু ব্লান্ট টাইপের। সামান্য ভুঁড়ি থাকবে, হাতে বড়-বড় খসখসে চুলের মতো লোম। চোখ ঘোলাটে লাল। নাকের ছিদ্রে চুল। ঘুমোলে গাঁকগাঁক করে নাক ডাকে। খেয়ে বাছুরের মতো ঢেঁকুর তোলেন। গুতিয়ে বাসে-ট্রামে ওঠেন। নামার স্টপেজ এলে আর ধৈর্য ধরতে পারেন না, সিট থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে সদ্যোজাত ছাগলের মতো চঁট ছুঁড়তে-ছুঁড়তে হুড়মুড় করে নেমে যান। স্নানের পর মাথার চুলে সেরখানেক জল থাকবেই আর সেই অবস্থায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সরু চিরুনি দিয়ে ফচাক-ফচাক করে সামনে টেনে পেছনে উলটে চুল আঁচড়াবেন। আয়নার কাঁচে তেল জলের ছিটে। স্নানের পর স্ত্রীর শাড়িই দুর্ভাঁজ করে কোমরে ফাঁপা গিট দিয়ে একটু উঁচু করে পরবেন এবং খেতে বসার সময় কাঁধে একটা ভিজে লাল গামছা অবশ্যই থাকবে। হাত ধুয়ে প্রথমে পাছায় ভিজে হাত লেপটাবেন তারপর শাড়ির সামনের দিকে মুছবেন। এঁদের কেউ-কেউ মোটরবাইক চালাবেন। হিন্দি সিনেমা প্রিয় হবেন। তারকাঁদের মধ্যে গব্বরকে ভালো লাগবে, নায়িকাঁদের মধ্যে আমান। আড্ডাবাজ হতে হবে। তাস দাবা চলতে পারে। পরস্ত্রীর দিকে অপাঙ্গ দৃষ্টি। ঘরে লালসুতোর বিড়ি বাইরে সিগারেট। সারি আসনে বসলে পা দুপাশে যতদূর সম্ভব ফাঁক করে থাকবেন। প্যান্টের পকেট থেকে পয়সা বা রুমাল বের করার সময় পাশে যিনি থাকবেন তার কোমরে, ওপরে পাঁজরে ইনভেরিয়েবলি খোঁচা মারবেন। ঘুমের ঘোরে হাত পা ছোঁড়ার অভ্যাস থাকবে। হুড়ুম করে পাশ ফিরবেন। পাশে আর কেউ শুয়ে থাকলে খাট থেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা হবে। সস্ত্রীক বেড়াতে বেরোলে শিশুটিকে নিজেই বুকে বহন করবেন। যানবাহনে সবুক-শিশু যাঁর সামনে দাঁড়াবেন তার প্রাণ বের করে দেবেন। শিশুর পায়ে ধুলোকাদা গোবর মাখা, লাল জুতো। সেই জুতো কখনও কপালে, কখনও গালে, কখনও ধবধবে জামার বুকে এসে সিলমোহরের মতো লাগতে থাকবে। বিরক্ত হলেও ভূক্ষেপ করবেন না। যাকে তেল দেওয়ার দরকার তাকে তেল দেবেন এবং কাজ মিটে গেলে তাকে আর চিনতে পারবেন না। বাড়িতে অচেনা কেউ এলেই ফিউরিয়াস হয়ে জিগ্যেস করবেন–কি চাই? বারোয়ারি পুজোর চাঁদা দেওয়ার সময়ে প্রতিবারই একটা করে লাঠালাঠি ফাটাফাটির নায়ক হবেন।
আপনি কি ওইরকম?
আজ্ঞে না। কিছু কিছু মিলছে তবে পুরোটা নয়।
তাহলে তো নির্যাতিত হতেই হবে। আচ্ছা শোনা যাক।
অতীতের ইতিহাস আমি বলতে চাই না। সে যা হওয়ার হয়ে গেছে। একবার আমাকে চুড়ি মেরেছিল।
সে আবার কি?
আমার শ্বশুমাতা আত্মরক্ষার জন্যেই বোধহয় মেয়ের হাতে কিরিকাটা দুটো বালা পরিয়ে দিয়েছিলেন। একবার ঘষে দিলেই বিহারি পোকা।
বিহারি পোকা?
সাঁওতাল পরগনায় বর্ষাকালে সন্ধেবেলা একরকমের পোকা ওড়ে। গায়ের পাশ দিয়ে একবার উড়ে গেলেই হল। ছাল ছিঁড়ে কালো ঘা। আমার বউয়ের বালা দুগাছা সেই মাল। বেশি জোরজার করলেই যাও বলে একবার হাতঝামটা। ব্যাস দাগরাজি। সপ্তাহখানেক ভোগো। সুগার থাকলে ঘা শুকোতে মিনিমাম এক মাস। তার ওপর একা রামে রক্ষে নেই দোসর লক্ষ্মণ। হাতে একটি নোয়া। আছে। মুখটা সামান্য ফঁক ক্ষয়ে ক্ষয়ে ক্ষুরধার। মাথার ওপর দিয়ে একবার হাত ঘোরালেই এক খামচা চুল গন। তার ওপর ব্লাউজে ডেও-ডেও সেফটিফিন। তার ওপর নাকে একটি তিনকোণা পাথরের নাকছাবি। তার ওপর কানে মধ্যযুগের গ্ল্যাডিয়েটারদের ঢালের মতো কানের পাতা চাপা কানপাশা।
এ তো মশাই রণচণ্ডী, খড়গখেটকধারিণী!
আজ্ঞে পরকুপাইন, শজারু গোছের জিনিস। শরীরে লেবেল মেরে দিলেই হয়–হ্যান্ডল উইথ কেয়ার।
এখন এমত একটি বস্তুর আচার আচরণের কয়েকটি নিদর্শন : আমি খেটে খাওয়া মানুষ।
তিনি তো খেটে খাওয়া নারী, আপনার সংসারের যন্ত্রী।
দ্যাটস টু। তবে আমি বেশ খাঁটি। খেটেখুটে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরি। স্বাস্থ্যের নিয়মে বলে সলিড এইট আওয়ারস ঘুম। ভোর পাঁচটায় আমাদের কাজের লোক আসে। খটাখট কড়ার শব্দ। দরজা খুলে দিতে হবে। দুজনেরই কানে শব্দ আসছে। দুজনেই শুনছি। কে ওঠে, কে খুলে দেয়। মশাই, মটকা মেরে পড়ে থাকে। প্রতিদিন তিনশো পঁয়ষট্টি দিন এই শর্মাকেই ঘুমচোখে উঠে টলতে টলতে গিয়ে দরজা খুলতে হয়। আর এমন শয়তান যেই এসে বিছানায় শুই অমনি মোলায়েম গলায় জিগ্যেস করে, কি গো খুলে দিয়ে এলে! কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে। এটা ইউনাইটেড নেশানে তুলে ধরার মতো একটা আন্তর্জাতিক ব্যাপার। একেই আমার একটু কুসংস্কার আছে। সকালে আমি কারুর মুখ দেখতে চাই না, দিন ভালো যায় না। সেই আমাকে জোর করে দেখতে বাধ্য করাবে। ওই পাঁচটার সময় সাহস করে আর ঘুমোতে পারি না। ঘুমের সেকেন্ড এডিশান সহজে কাটতে চায় না। ভালো ঘুম হয় না বলে সারাদিনই শরীর খ্যাত খ্যাত করে, হাই ওঠে। এফিসিয়েনসি কমে আসছে বলে জুনিয়াররা টপাটপ প্রোমোশান নিয়ে মাথায় চেপে বসেছে।