সভাপতি গলা ছেড়ে বললেন, মনুষ্যক্লেশ নিবারণী সমিতিটাই এখন দেখছি দারুণ ক্লেশের কারণ হয়ে উঠছে। ক্লেশ তো কমবেই না। উলটে আরও ক্লেশ যোগ করে ছাড়বে। এটাকে তুলে দেওয়া হোক!
না না। তোলা চলবে না। সকলে সমস্বরে চিৎকার করে উঠলেন।
তুলে দিলে এই সন্ধেবেলাটা আমরা যাব কোথায়? সাত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার মতো ক্লেশদায়ক আর কি আছে? আমাদের বাড়ি…।
বক্তা উঠে দাঁড়িয়ে সকলের দিকে হাসি-হাসি মুখে তাকালেন, আমাদের বাড়ি, সেই হোম হোম সুইট হোম। স্বামী স্ত্রী যেন দুটি খত্তাল। একটি ঘরে আর একটি বাইরে। যতক্ষণ দুজন দুদিকে, অলরাইট, শান্তি। যেই কাছাকাছি স্ট্রাইকিং ডিসটেনসে এল, ঝম ঝম ঝম ঝং। চিনে বাদ্যি শুরু হল। তা সেই পুংখত্তালের আটক থাকার জায়গাটাকে আপনারা উঠিয়ে দেবেন? আমরা এখানে। থাকলে গেরস্তরা তবু একটু শান্তিতে থাকে।
বক্তা বসলেন। সভাপতি বললেন, দ্যাট মিনস এই সমিতি কিছু কাজের হয়েছে।
অফকোর্স হয়েছে। এই তো হোমিওপ্যাথিক কায়দায় সেদিন মেয়ে দেখে এলুম। উঃ, সে এক এক্সপিরিয়েনস মশায়।
কীরকম, কীরকম? সকলে উৎসাহী হয়ে উঠলেন শোনার জন্য।
ভাইপোর বিয়ে। মেয়ে দেখা হচ্ছে। সেদিনে সেই উনি বললেন না, মেয়ে বাজিয়ে নিতে হয়। বাড়িতে বললুম, ব্যাপারটা আমি হ্যাঁন্ডল করব। একটা বউমা আনব তবে বাজিয়ে আনব। সকলেই রাজি, দেখা যাক তোমার কেরামতি। আমার ফ্রেন্ড পঞ্চানন হোমিওপ্যাথি করে। সোস্যাল সার্ভিস নয়, ফিওয়ালা হোমিওপ্যাথ। চল পঞ্চু, দেখি তোমার কেরামতি। স্পাইগিরি করতে হবে। ভাবলক্ষণ দেখে বুঝতে হবে একটি মেয়ের ভেতরে কি আন্ডার কারেন্ট বইছে। জেনেটিক স্ট্রাইকারটা ধরে ফেলতে হবে ওপর থেকে। ছেলের দুই কাকা সেজে, বড়কাকা আর ছোটকাকা…।
হাসালেন মশাই, কাকার আবার বড় কি? কাকা বড় হলেই তো জ্যাঠা হয়ে যায়। বলুন মেজোকাকা, সেজোকাকা।
সেকী! ব্যাপারটা তাহলে তো খুব কেলো হয়ে গেছে মশাই। আমরা তো ছেলের বড়কাকা আর ছোটকাকা বলে মেয়ে দেখে এলাম তিন ঘণ্টা ধরে।
ধরে ফেলবে, ফিশি অ্যাফেয়ার। বড়কাকা হয় না।
কে বলেছে হয় না, ছোট হলে বড়ও হয়। সেই পড়েননি বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে।
লাও এ আর-এক পণ্ডিত। আরে মশাই এ বড় সে বড় নয়। বয়েসে বড়।
আপনি মশাই আর-এক মূর্খ। ছোট বয়স বেড়ে-বেড়েই তো বড় বয়স হয়। যেমন ধরুন আমার পিতা। পিতা ছোট ছিলেন, পিতা বড় হতে শুরু করলেন, পইতে হল, আরও বড় হলেন, হতে-হতে আমার পিতা হলেন।
গবেট, ফাশক্লাস গবেট। স্ট্যাটাস, সম্মান, সম্মানের কথা হচ্ছে, হাইট, বয়স, ওজন এসব কোনও ফ্যাকটারই নয়। যে-কোনও ছোটকাকার বয়স পাঁচও হতে পারে বেঁচে থাকলে একশোও হতে পারে। দে আর বরুন লাইক দ্যাট, ছোটকাকা, মেজোকাকা, সেজোকাকা, বড়কাকা, মেজোজ্যাঠা, সেজোজ্যাঠা অ্যান্ড সো অন।
দাঁড়ান, দাঁড়ান ব্যাপারটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। কই আমি তো পিতা হয়ে জন্মাইনি। জন্মে তবে পিতা হয়েছি। তবে হ্যাঁ পড়েছি, ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। তার মানে কাকা হয়ে, জ্যাঠা হয়ে জন্মানো যায় একসেপ্ট পিতা। পিতাস আর মেড নট বরুন। মাথাটা কেমন করছে। আমি সভাপতির সাহায্য চাই। প্লিজ এই ঘোটপাকানো ব্যাপারটা একটু সমঝে দিন।
সভাপতি বললেন, ব্যাপারটা হল রিলেশানের ব্যাপার। একটা ব্ল্যাকবোর্ড থাকলে বোঝানো সহজ হতো। যাক এই কার্ডবোর্ডটায় এঁকে বুঝিয়ে দি। দশটা লোক পাশাপাশি। ধরা যাক তিন নম্বর ব্যক্তি কারুর পিতা। তাহলে কি হল?
আজ্ঞে তিন নম্বর ব্যক্তি তাহলে কারুর পিতা হলেন।
ইয়েস। এ পর্যন্ত তাহলে ক্লিয়ার?
হ্যাঁ ক্লিয়ার।
তাহলে তিন নম্বর ব্যক্তি যার পিতা, দুনম্বর ব্যক্তি তার মেজোজ্যাঠা, প্রথম ব্যক্তি তার বড়জ্যাঠা। এই হল ওপর দিকের রিলেশান। এইবার পিতার নীচের দিকে যারা তারা সব কাকা, ছোটকাকা, নকাকা, রাঙাকাকা।
দাঁড়ান পজিশনটা একটু সরিয়ে নি, ধরা যাক ওই সারির চতুর্থ ব্যক্তি তো আমার পিতা হলেন না, তিনি আমার জ্যাঠা হলেন, কোন জ্যাঠা?
সেজো জ্যাঠা।
পঞ্চম ব্যক্তি কে হলেন?
ন’কাকা।
তার মানে ছোটকাকা উবে গেলেন!
উবে নয়, যার ছোটকাকা হওয়ার কথা ছিল তিনি হয়ে গেলেন বাবা। সম্পর্ক বুঝতে গেলে সারেগামা বুঝতে হবে। এই সারির দশটি লোক হল, বড়, মেজো, সেজো, ছোট, ন, রাঙা, নতুন, গোলাপ ইত্যাদি। এইবার এদের ছেলেপুলে, ডালপালায় নানা সম্পর্ক।
কি আশ্চর্য ভাই, এই প্রথম আবিষ্কার করলুম জন্মেই বাবা হওয়া যায় না তবে জ্যাঠা কি কাকা হওয়া যায়, বাবাস আর মেড নট বরন।
খুব জ্ঞান বেড়েছে মশাই। এদিকে মনুষ্যক্লেশ নিবারণী। মেয়ে দেখা কেমন হল তা আর শোনা হল না।
সভাপতি বক্তাকে মেয়ে দেখার কথা বলতে আদেশ করলেন। বক্তা আবার শুরু করলেন?
আমি ছোটকাকা, পঞ্চু ডাক্তার বড়কাকা। পঞ্চুকে দেখতে-শুনতে বড়-বড়ই লাগে, বেশ ভারিক্কি। মেয়েকে তখনও আসরে ছাড়া হয়নি। মেয়ের বাবা সামনে বসে আলাপসালাপ করছেন। কোলের ওপর নিজের থ্যাসকান উদর, মুখটি গোলাকার, নাকের ডগাটা গণ্ডারের মতো, ঈষৎ লাল। চুল বুরুশের মতো, কালো কুচকুচে। একটা চোখ সামান্য ছোট। হাতের আঙুল পাকার মতো। প্রথম পাবে ছাড়াছাড়া চুল, শূন্য নম্বর পেন্টব্রাশের মতো; সোজা-সোজা হয়ে আছে। কথা বলতে বলতে কলার মতো আঙুল দিয়ে হাঁটুতে বাজনা বাজাচ্ছেন কেটল ড্রামসের মতো। মাঝে-মাঝে হাঁটু নাচাচ্ছেন, ভুরু কোঁচকাচ্ছেন। পঞ্চু ডাক্তার সব লক্ষ্য করছে। আমি দেখছি বুঝছি না কিছুই, একটু অস্বাভাবিক লাগছে এই যা। পঞ্চু দেখছে এবং বুঝছে। পঞ্চ হঠাৎ প্রশ্ন করল, আপনার বাবার সামনের দাঁত দুটো কি ফঁকা ছিল? ভদ্রলোক থতমত খেয়ে বললেন, কেন বলুন তো?