আমার বোনের বাসা ছিলো রেলকলোনির পাশে। আমি তখন সাইকেল চালাতে শিখেছি। দুলাভাইয়ের একটি সাইকেল ছিলো, সেটি নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়তাম; খুব ভালো লাগতো আমার রেলকলোনির পাশের গুঁড়োগুড়ো কয়লাবিছানো পথে সাইকেল চালাতে। খুব মসৃণ ছিলো ওই পথ, একটুও ঝাঁকুনি লাগতো না। একদিন সাইকেলের চেইন পড়ে যায়, একটি লোক এসে আমাকে চেইন লাগাতে সাহায্য করে। তার সাহায্য আমি চাই নি, সে নিজেই আসে, চেইন লাগিয়ে দেয়, এবং আমাকে পাশের দোকানে নিয়ে চা খাওয়াতে চায়। লোকটির কথা শুনে আমি বুঝতে পারি সে বিহারি, আমার ভয় লাগে, আর চা আমি খাইওনা, তাই তার সাথে আমি যাই নি। লোকটি বলে সে রেলে কাজ করে, আমি চাইলে সে আমাকে ট্রলিতে করে বেরিয়ে আনতে পারে। ট্রলিতে চড়ার সখ ছিলো আমার;–সাইকেল চালাতে চালাতে আমি দেখেছি। রেলের লোকেরা ট্রলিতে করে সাঁই সাঁই করে ইস্টিশনের দিকে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। একদিন বিকেলে সে আমাকে ট্রলিতে করে বেড়াতে নিয়ে যায়; তার সাথে আমি কয়েকবার ইস্টিশনের দিকে যাই, আবার ফিরে আসি। তাকে আমার বেশ ভালো লাগে। পরের দিন দুপুরে সে আমাকে তার বাসায় নিমন্ত্রণ করে। ওই কলোনির সব বাসাই ছিলো মূলিবাঁশের, আমাকে সে তার বাসাটি দেখিয়ে দেয়। পরের দিন দুপুরে আমি তার বাসায় যাই। আমি ঢুকতেই সে ঠেলে দরোজা বন্ধ করে দেয়, আমি অবাক হই; এবং সে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ভয় পাই, সে আমাকে নিয়ে মেজের ওপর গড়িয়ে পড়ে; আমি টের পাই সে তার একটি বিশাল শক্ত অঙ্গ আমার গায়ে লাগাতে চাচ্ছে। আমি তার অঙ্গটিকে ডান মুঠোতে শক্ত করে ধরে ফেলি, নখ বিধিয়ে দিই; বাঁ হাত দিয়ে তার অণ্ড দুটিকে চেপে ধরি। গো গোঁ করে সে মেজের ওপর উল্টে পড়ে। আমি দরোজা খুলে বাইরে বেরোই, আস্তে আস্তে বাসার দিকে হাঁটতে থাকি।
আমার পনেরো বছর হতে না হতেই অনেক কিছুই ভেঙে পড়ে আমার চোখের সামনে, আমার মনের ভেতরে। আমি, সব সময়ই, চারপাশে অনেক ভালো ভালো কথা শুনতে পাই, শুনে আমার কেমন হাসি পায়, যদিও আমি হাসি না। বইয়েও আমি অনেক ভালো ভালো কথা পড়ি, পড়ে আমার হাসি পায়। আমার মনে হতে থাকে মানুষ ভালো ভালো কথা বলতে পছন্দ করে, এটা মানুষের স্বভাব; কিন্তু মানুষ দুর্বল প্রাণী। আমাদের বাড়ি থেকে তাকালে উত্তর দিকে একটা মঠ দেখা যেতো, আমার মনে হতো মঠটি এখনই ভেঙে পড়বে; একবার আমি একটি মসজিদে শিরনি দিতে গিয়েছিলাম, মৌলভির হাতে গামলাটি দিয়েই আমি দৌড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম, মনে হচ্ছিলো ওই পুরোনো দালানটি এখনই ভেঙে পড়বে। ওই দুটির কোনোটিই হয়তো এখনো ভেঙে পড়ে নি, হয়তো পড়েছে, অনেক দিন ওগুলোর কথা আমার মনে পড়ে নি।
আমার ভেতর একটি লাল ক্ষুধা জেগে উঠছে, তার সাথে পেরে উঠছি না আমি, টের পাচ্ছি আমি ভাঙছি; আমার ভেতরে ভাঙন শুরু হয়েছে, আমি তার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ওই ভাঙনের শব্দ অত্যন্ত মধুর, আমি সারাক্ষণ ব্যাকুল হয়ে থাকছি ওই ভাঙনের শব্দ শোনার জন্যে। সব কিছু আমার অন্য রকম লাগতে শুরু হয়েছে। মা সব সময় শুয়ে থাকে, যখনই ঘর থেকে বেরোই দেখি শুয়ে আছে, যখন ফিরি দেখি শুয়ে আছে। মা খুব ক্লান্ত, মা সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। মা অনেক সময় মেজেতে শুয়ে থাকছে, রান্নাঘরের খাটালেও শুয়ে থাকছে কখনো। অথচ মার জন্যে আমার মায়া হচ্ছে না; আমি তার পাশ দিয়ে যাচ্ছি আসছি, তাকে ডাকতেও ইচ্ছে করছে না। মাও আমাকে বেশি ডাকছে না আজকাল, মা খুব ক্লান্ত। বাবাকে বাড়িতে দেখি না, বাবাও ভেঙে গেছেন আরো; তারা ভেঙে গেছেন, এবং আমি ভাঙছি। আমার ভাঙন তাঁদের ভাঙনের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি রক্তে কাপন বোধ করছি, আমার রক্ত উলঙ্গ পাগল হয়ে গেছে, আমি তার কলকল প্রবাহের শব্দ শুনছি; রক্তের ঘর্ষণে আমার গায়ের ত্বক অ্যালিউমিনিআমের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। আমি যেখান দিয়ে যাই, আমার মনে হয়, সেখানকার বাতাস উত্তপ্ত হয়ে উঠছে আমারই রক্তের মতো; পুকুরে নামলে মনে হয়। পুকুর হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠলো, পুকুরের পানি গর্জন করে উঠলো আমার রক্তের মতো।
আমি নিজে নিজে সুখ পেতে শুরু করেছি; নিজের শরীরের ভেতরে যে এতো শিমুল বন ছিলো, সেখানে মধুর চাক ছিলো, তাতে এতো মধু ছিলো, সে-মধুর চাক ভাঙতে যে এতো সুখ, তা আমার জানা ছিলো না। জানার পর আমি আমার ভেতরের মধুর চাক। ভাঙতে শুরু করি, ভেতর থেকে জমাট মধু বের হয়ে আসতে থাকে। বোশেখের রোদে হেঁটে হেঁটে একবার আমি বিলের ভিটায় যাই, চারপাশে গলানো পারদের মতো রোদ, ভিটায় একটি বড়ো কাঠবাদামের গাছ, তার পাশে একটি ঝোঁপ, আর ঝোঁপের পাশে সবুজ ছায়ার অন্ধকার। আমি সে-ছায়ায় বসে রোদ পান করতে থাকি, আমি রোদের স্তরের ওপর রোদের স্তর দেখতে থাকি, রোদ রসের মতো লোমকূপের ছিদ্র দিয়ে আমার ভেতরে ঢুকতে থাকে। দূরে অনেকগুলো গরু চরছে, কোনো রাখাল দেখা যাচ্ছে না, বোরোধানের খেতের ভেতরে সবুজ আগুন জ্বলছে। আমার ভেতরে আগুন লেগে যায়। আমি আমার মধুর চাকে হাত দিই, বিলকিসকে মনে পড়ে, যাকে আমি দু-দিন আগে। পুকুরে গোসল করতে দেখেছি, কদবানের পেঁপে দুটিকে আমার সবুজ মনে হতো, বিলকিসের দুটিকে আমার সবুজ মনে হয় নি, পেঁপে মনে হয় নি, শ্রাবণের আকাশের ভেজা চাঁদ মনে হয়েছে, আমার ভেতর থেকে গলগল করে মধু বেরিয়ে আসতে থাকে। কাঠবাদাম গাছের পাশের ঝোপে আমি মধুর প্লাবনে ডুবে যাই।