যাকে দেখে প্রথম আমি সৌন্দর্যকে দেখি তার নাম তিনু আপা। তাঁর হাতপামুখ। ছিলো ঘন দুধ দিয়ে তৈরি, আমার তাই মনে হতো; এবং আমার মনে হতো তার শরীরে কোনো হাড় ছিলো না। চাঁদের থেকেও ধবধবে আর গোল ছিলো তার মুখ। একটি খালের উত্তর পাশে ছিলো তাদের বাড়ি, শুপুরি আর নারকেল গাছ দিয়ে ঘেরা। তিনু আপা বিকেলে সুন্দর শাড়ি পরে সামনের দিকে ফুলিয়ে চুল আঁচড়িয়ে মুখভরা মিষ্টি হাসি স্থির করে রেখে তাদের ডালিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে খাল ও খাল পেরিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আমি কোনো কোনো বিকেলে তাঁদের বাড়ির ভেতরের পথ দিয়ে যেতাম, দেখতাম তিনু আপা দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে মিষ্টি করে হাসতেন তিনু আপা। আমি মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকাতাম, দেখতাম তার পায়ের পাতার আলোতে মাটি দুধের মতো হয়ে গেছে। তিনু আপা কখনো হাত উঁচু। করে ডালিম গাছের ডাল ধরে কথা বলতেন আমার সাথে, আমি দেখতাম তার লাল ব্লাউজ উপচে ঘন দুধ গলে পড়ছে। তিনু আপা একবার আমার হাত দেখতে চেয়েছিলেন, আমি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম, তার আঙুলগুলো আমার আঙুল আর। মুঠোতে ঘন দুধের মতো জড়িয়ে যাচ্ছিলো; আমি মনে মনে চাইছিলাম তিনু আপা যেনো আমার হাত কখনো না ছাড়েন। তিনু আপার সাথে আমি এক্কাদোক্কা খেলতাম কখনো কখনো, আমি মনপ্রাণ দিয়ে খেলতাম, কিন্তু আমার খেলার থেকে তিনু আপার। খেলা দেখতেই বেশি ভালো লাগতো। তিনু আপা যেভাবে চাড়া ছুঁড়তেন, তার ডান হাত যেভাবে নিচু থেকে ওপরের দিকে উঠতো, চাড়া কোনো ঘরে পড়ার পর তার ঠোঁট যেভাবে নড়তো, তাতে আমার নিশ্বাস থেমে যেতে চাইতো। সবচেয়ে সুন্দর ছিলো ঘর থেকে ঘরে তাঁর লাফিয়ে চলা। তিনি যখন ঘর থেকে ঘরে লাফিয়ে যেতেন, একটুও শব্দ হতো না; তার পা একরাশ শিউলিফুলের মতো মাটির ওপর ঝরে পড়তো, তিনু আপা মাটির ওপর শিউলি ঝরিয়ে ঝরিয়ে ঘর থেকে ঘরে লাফিয়ে যেতেন। লাফানোর সময় তার শরীরটি ঢেউয়ের মতো দুলতো, আমি চোখের সামনে দুধসাগরের ক্ষীরসাগরের ঢেউ দেখতে পেতাম; বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার পরও আমার চোখে দুধসাগর ক্ষীরসাগর দুলতে থাকতো। দুধের ঢেউয়ের মতো আমার চোখে ঘুম। নামতো।
তিনু আপার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে–খবরটি আমি এক বিকেলে জানতে পাই, আমার বুক হঠাৎ কেঁপে ওঠে, আমি খুব কষ্ট বোধ করি। আমি ভেবেছিলাম তাঁকে ডালিম গাছের নিচে দেখতে পাবো, কিন্তু পাই না, তার বদলে খবরটি পাই; আমার বিকেলটি ঘোলা হয়ে উঠতে থাকে। মাঠে না গিয়ে আমি নদীর পারের দিকে চলে। যাই, গাছপালা নদীর ঢেউয়ে আমি কোনো সৌন্দর্য দেখতে পাই না। আমি তিনু আপার ঠোঁট দেখতে পাই, মনে হতে থাকে নদীর আকাশে তিনু আপার ঠোঁট ঝিলিক দিয়ে। উঠছে; আমি তার বাহু দেখতে পাই, নদীর ঢেউয়ে তার বাহু দুলে উঠতে দেখি; তার। ধবধবে দুধের মতো দেহটি আমার সামনে ঘর থেকে ঘরে লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে। থাকে। আমি দেখতে পাই তিনি লাফিয়ে চলছেন আর তার পেছনের দিকটি নদীর ঢেউয়ের ওপর সোনার কলসির মতো দুলছে। সে-রাতে আমি একটি স্বপ্ন দেখি; দেখতে পাই তিনু আপাকে নিয়ে আমি খুব দূরে কোথাও চলে গেছি; তিনু আপা বলছেন, তুমি আমাকে নিয়ে খুব দূরে কোথাও চলো, আমি তাঁকে নিয়ে দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছি, দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। তিনু আপা আর হাঁটতে পারছেন না, আমার হাত ধরে হাঁটছেন; শেষে আমার বুকের ওপর লুটিয়ে পড়লেন।
সেই প্রথম আমি বিষণ্ণতা বোধ কৃরি, এর আগে এমন কিছু আমি অনুভব করি নি। আগে আমি আনন্দ আর সুখ বোধ করেছি, শরীরে আর মনে কষ্টও পেয়েছি, কিন্তু কোনো কিছু ভালো না লাগার অনুভূতি আমার হয় নি। তখন আমি সব কিছু অস্পষ্ট। দেখতে থাকি, আমার চোখের ওপর একটি কুয়াশার পর্দা লেগে থাকে সব সময়, মনে হতে থাকে আমি কাউকে চিনি না, আমার কোনো বন্ধু নেই, আত্মীয় নেই। বড়ো একলা লাগতে থাকে। আমি নদীর পারে একা একা হাঁটতে থাকি, বই পড়তে পারি না, ঘুমোতে আমার কষ্ট হয়। আমার শরীর ব্যথা করতে শুরু করে; তখন আমি আর তিনু। আপাকে দেখতে পাই না, একটা অচেনা লোককে দেখতে পাই, দেখি লোকটি তিনু আপার পাশে শুয়ে আছে। আমার খুব কষ্ট হতে থাকে, আমি ঘুমোতে চাই, ঘুমোতে পারি না; মনে হতে থাকে জীবনেও আমার কখনো ঘুম আসবে না। কিন্তু আমাকে ঘুমোতে হবে, নইলে আমি বাঁচবো না। আমি আমার শরীরের ওপর হাত বুলোতে থাকি; মাথা, মুখ, বাহু, উরুতে হাত বুলোতে থাকি; এক সময় আমার হাত দু-পায়ের মাঝখানের অঙ্গটির ওপর গিয়ে পড়ে। আমার হাত ওটির কঠিনতা বোধ করতে শুরু করে, এর আগে আমি ওটি ছুঁতে লজ্জা পেয়েছি, কিন্তু আজ ওর কঠিনতা থেকে আমি সরে আসতে পারি না, আমি ওকে বারবার ছুঁতে থাকি, তিনু আপা একবার যেমন করে আমার আঙুল নেড়েছিলেন, আমি তেমনভাবে নাড়তে থাকি, আমার ঘুম পেতে থাকে, নদীর ঢেউয়ে আমি ভাসতে থাকি। আমার আকাশে বিদ্যুৎ ঝলক দিয়ে উঠতে থাকে, আমি ক্ষীরসাগরে সাঁতার কাটতে থাকি, এক সময় আকাশপাতালসূর্যচাঁদ ভেঙেচুড়ে আমি কাঁপতে থাকি, আমার ভেতর থেকে সূর্যচাঁদরা গলগল করে বেরোতে থাকে। আমি কোমল আগুনের শিখার ওপর ঘুমিয়ে পড়ি।
সেবার আমি একলা বেড়াতে যাই রাজবাড়ি, মেজো বোনের বাসায়। এর আগে দুবার আমি ওই শহরে গেছি, তাই একলা আমি যেতে পারবো এতে কেউ সন্দেহ করে না; আমারও ভালো লাগে যে আমি একলা যাচ্ছি। বাঘড়া থেকে আমি গাজি ইস্টিমারে উঠি, বাবা আমাকে ইস্টিমারে উঠিয়ে দিয়ে যান। আমি ওপরের ডেকে উঠে কোনো জায়গা পাই না, দিকে দিকে সবাই বিছানা পেতে শুয়ে আছে, বসে আছে; কোথাও একটু জায়গা নেই। আমি সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। একটি লোক আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। লোকটি দেখতে বেশ ভালো, মুখে অল্প দাড়ি আছে, মাথায় টুপিও রয়েছে। বয়সে বাবার মতোই হবে। লোকটিকে আমার ভালোই লাগে। আমি কেনো দাঁড়িয়ে আছি সে জানতে চায়। সে আমাকে বলে তার বিছানার পাশে জায়গা আছে, আমি। সেখানে গিয়ে বিছানা পেতে শুতে পারি। নানা দিক ঘুরে, অনেক মানুষ পেরিয়ে, সে ডেকের শেষ দিকে নিয়ে যায় আমাকে; সেখানে তার বেশ বড়ো বিছানাটি পাতা। রয়েছে। বিছানার পাশে জায়গাও রয়েছে। সে তার বিছানাটি কিছুটা গুটিয়ে আরো। জায়গা করে দেয়; আমি সেখানে আমার বিছানা পাতি। সে চা আনায়, আমি তাকে বলি যে আমি চা খাই না; কিন্তু কুকিজটি খেতে সে আমাকে বাধ্য করে। সে জাহাজের রেস্টুরেন্টের লোকটিকে বারবার ডেকে কুকিজ আনতে বলে, কুকিজটি সে আমার হাতে গুঁজে দেয়, সেটি না খেলে খুব খারাপ দেখায় বলে আমি সেটি খাই। কুকিজ খেতে। অবশ্য আমার সব সময়ই ভালো লাগে। লোকটিকেও আমার খারাপ লাগে না। লোকটি বলে আমার সমান তারও একটি ছেলে রয়েছে, সেও টেনেই পড়ে। তখন বেশ রাত, ইস্টিমারের শব্দ আর ঘোলাটে আলোতে সব কিছু আমার অদ্ভুত লাগছে। লোকটি গৃমিয়ে পড়েছে মনে হয়, কিন্তু আমার শুতে ইচ্ছে করছে না। দিকে দিকে লোকেরা ঘুমিয়ে পড়ছে, তাদের ঘুমোনোর ভঙ্গি দেখে মনে হয় তারা সারাজীবনে ঘুমোয় নি, আজই প্রথম ইস্টিমারে উঠে ঘুমোনোর সুখ পেয়েছে। আমিও এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি। একটু শীত লাগে, ঘুমের ঘোরে আমার মনে হয় কে যেনো আমার গায়ে চাদর বিছিয়ে দিচ্ছে, তাতে আমার ঘুমিয়ে পড়তে আরো ভালো লাগে। ঘুমের ঘোরে আমি টের পাই একটি হাত আমার হাফপ্যান্টের সামনের দিকের বোতাম খুলছে, আমি হাত দিয়ে হাতটি সরিয়ে দিই; কিন্তু হাতটি আবার সামনের দিক দিয়ে ঢুকে আমার অঙ্গটিকে। নাড়তে থাকে। আমি হঠাৎ উঠে বসে আমার হাফপ্যান্টের সামনের দিকে হাত দিই, লোকটি দ্রুত হাত সরিয়ে নেয়, দেখি আমার হাফপ্যান্টের বোতামগুলো খোলা। আমি ঘুম থেকে উঠে বসে থাকি, লোকটি অন্য দিকে মুখ দিয়ে ঘুমোতে থাকে। ভোর হলে সে অজু করে নামাজ পড়ে, আমার সাথে কোনো কথা বলে না।