উকিল দাদীকে জিজ্ঞেস করছে, আপনার স্বামী সেই সন্ধ্যায় কী খেয়েছিলেন?
দাদী বলছেন, মাছ, ভাত, দুধ, মধু।
উকিল বলছে, আপনার স্বামীর পেটে পিঠা পাওয়া গেছে, আপনি কি তাঁকে পিঠা খাইয়েছিলেন?
দাদী বলছেন, না।
উকিল বলছে, ধর্মাবতার, এই লোকের চরিত্র ভালো ছিলো না। এই লোক সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্রামেরই কোণায় তার উপপত্নীর বাড়ি যায়। সইজুদ্দিন জোলার বউ তার উপপত্নী ছিলো একথা গ্রামের সবাই জানে।
দাদার দুটি বউ ছিলো, এক দাদীকে আমিও দেখেছি–বেশ সুন্দর; তবু তিনি সইজুদ্দিন জোলার বউয়ের কাছে যেতেন এটা আমাকে অবাক করে। সইজুদ্দিন জোলার বউ বেঁচে আছে, তাকে আমি দেখেছি; কালো কুচকুচে, ঘেন্না হয়। দাদা তার কাছে যেতেন, কেনো যেতেন? সইজুদ্দিন জোলার বউর কী ছিলো যে দাদা দুটি বউকে রেখে তার কাছে যেতেন? দাদাও কি কোনো সাঁকো ছিলো না, তিনি তো দুটি সাঁকো বাঁধার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু একটিও বাঁধতে খারেন নি? কোনো পুরুষই কি ঠিকমতো সকো বাঁধতে পারে না? নাকি বাঁধা সাঁকো তাকে আর আকর্ষণ করে না? তখন দিকে দিকে ছুটতে থাকে? বাবার সাথে খালার একটা সাঁকো আছে, মায়ের সাথে বাবার। কোনো সাঁকো নেই; বাবার জন্যে আমার মায়া হয়, মায়ের জন্যে আমার মায়া হয়। নবম শ্রেণীতে ওঠার পর থেকে আমি প্রায় সবই বুঝি, কিন্তু আমি কাউকে বুঝতে দিই নি যে আমি বুঝি; তাতে তারা বিব্রত বোধ করতো, তাদের গোপনে গড়ে তোলা সাঁকোগুলো নড়োবড়ো হয়ে উঠতো। তখন থেকেই আমার এমন একটি বোধ জন্মে যে মানুষের কোনো স্খলন দেখেই উত্তেজিত হওয়ার কোনো অর্থ হয় না, মানুষ এমন প্রাণী যা কোনো ছক অনুসারে চলতে পারে না। কিন্তু মানুষ ছকের কথা বলতে, আর ছক। তৈরি করতে খুব পছন্দ করে।
সে-সন্ধ্যায় হাসান ভাইয়ের ঘরে না গেলে ভালো হতো, কিন্তু আমি যে গিয়েছিলাম এতে আমার কোনো অপরাধবোধ হয় নি; বরং মনে হয়েছে না গেলে আমি জীবনের। একটি সোনালি খণ্ড হারাতাম। এমন সুন্দর একটি দৃশ্য কখনো দেখতে পেতাম না। সে-দিন ঈদের চাঁদ উঠেছিলো, আমার রক্তে ঝলক লেগেছিলো; চাঁদ ওঠার সন্ধ্যায়। আমি বন্ধুদের সাথে বাড়ি বাড়ি বেড়ানোর অধিকার পেতাম। বাড়ি বাড়ি বেড়িয়ে সন্ধ্যার বেশ পরে ঘরে ফিরে দেখি বাবা নেই, মা শুয়ে আছে, ঈদের সব আয়োজন করা হয়ে। গেছে, এবং আমার কিছু করার নেই। তখন আমি হাসান ভাইদের দোতলায় যাই, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠি, হাসান ভাইয়ের ঘরের দরোজা ঠেলে ঢুকি। আমি ঢুকতেই হাসান। ভাই আর কদবান মেজে থেকে লাফিয়ে ওঠে। দুজন উলঙ্গ মানুষকে লাফিয়ে উঠতে। দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিলো। হাসান ভাই তার লুঙ্গিটা ধরে খাটের ওপর উঠে দুটি বালিশ জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। আমি দাঁড়িয়ে থাকি। কদবান তার শাড়ি আর। ব্লাউজ পরার চেষ্টা করে। তার নতুন লাল শাড়ি আর ব্লাউজ থেকে একটা অদ্ভুত সুগন্ধ ভেসে আসতে থাকে আমার দিকে। কদবান শাড়ি পরতে গিয়ে বারবার ভুল করে, তার শাড়ি খসে পড়ে যেতে থাকে। তার বুকের সবুজ পেপে দুটি দেখে আমার চোখ মুগ্ধ। হয়, এই প্রথম আমি চোখের সামনে সম্পূর্ণ মুক্ত বুকের পেঁপে দেখতে পাই। কদবান কিছুতেই ব্লাউজ পরে উঠতে পারে না, পরার চেষ্টা করতেই তাঁর সবুজ পেঁপের বাগান ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে ওঠে। কদবানের পেঁপের দিকে লক্ষ বছর ধরে আমার থাকিয়ে থাকার ইচ্ছে হয়; কিন্তু আমি বেরিয়ে আসি।
আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাসান ভাইয়ের সুচিত্রা, শেফালি, নুরজাহান, বকুলের কথা ভাবতে থাকি। তারা কি সত্য হাসান ভাইয়ের জীবনে? শেফালিদির সাথে এক সন্ধ্যায়। তার যা ঘটেছিলো, তা কি সত্য? তা কি সত্য নয়? শেফালিদিদের বাড়ি কি হাসান ভাই কখনো গেছে। আমার মন বলতে থাকে, হাসান ভাই কখনো ওই বাড়িতে যায় নি। শেফালি হাসান ভাইয়ের জন্যে কখনো কোনো সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে থাকে নি, হাসান ভাই কখনো শেফালির শাড়ির ভেতর হাত দেয় নি। সত্যি কি দেয় নি? আমি জানি না, আমি জানি না। এমন সময় হাসান ভাই আমার ঘরে ঢোকে। হাসান ভাই আমার দু-হাত তার দু-মুঠোতে ধরে মাথা নিচু করে বসে থাকে, কোনো কথা বলতে পারে না। আমি তার মুখের দিকে তাকাই; হাসান ভাইয়ের মুখ দেখে আমার কষ্ট হয়।
কোনোদিন বলবো না, আমি বলি।
হাসান ভাই আমার হাত ধরে মাথা নিচু করে বসে থাকে। তার মাথা নিচু থেকে আরো নিচুতে নামতে থাকে; আমার মনে হয় নামতে নামতে হাসান ভাইয়ের মাথা আমার পায়ের কাছে নেমে যাবে। আমার খুব কষ্ট হতে থাকে, হাসান ভাইয়ের মাথা। আমি এতো নিচুতে দেখতে চাই না।
কোনোদিন বলব না, আমি আবার বলি।
আমি কদবানকে বিয়ে করবো, হাসান ভাই বলে। তার চোখের জলের ফোঁটা আমার হাতে লাগে।
কেউ রাজি হবে না, আমি বলি।
একমাসও যায় নি তারপর, কদবান একদিন রান্নাঘরের মেজের ওপর পড়ে যায়, বমি করতে থাকে। দু-দিন আমাদের বাড়িটা বেশ থমথম করে। তার পরদিন ভোরে উঠে দেখি কদবান নেই। কিন্তু আমরা কেউ কোনো প্রশ্ন করি নি। কেউ কারো কাছে। জানতে চায় নি কদবান কোথায়? কদবানের এক ভাই আমাদের বাড়িতে মাঝেমাঝে কাজ করতো, সেও কখনো কদবানের নাম উচ্চারণ করে নি। আমি কখনো কদবানের নাম বলি নি, মা কখনো কদবানের নাম বলে নি, বাবা কখনো কদবানের নাম বলেন। নি। আমাদের বাড়িতে যারা আসতো, তারা কখনো কদবানের নাম বলে নি। যেনো কদবান পৃথিবীতে কখনো ছিলো না। মাঝেমাঝে আমার মনে প্রশ্ন জাগতো, কদবান কি পৃথিবীতে এখনো আছে? কদবানের জন্যে শোকে আমার বুক ভরে গিয়েছিলো, আমি তার ঝকঝকে কালো রঙের সৌন্দর্য দেখে দেখে বেড়ে উঠেছিলাম, তার সবুজ পেঁপে আমার চোখে রূপের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলো। কদবানকে মনে হলে আজো আমার চোখের সামনে সবুজ পেঁপেভরা পেঁপে গাছ দুলে ওঠে।