ফিরোজাকে নিয়ে এলাম, তার বোন বলেন, ও খুব কষ্টে আছে।
আমি বলি, সে তত পৃথক থাকতে চায়।
তার বোন বলেন, ওটা ওর বিভ্রম, তুমি কিছু মনে কোরো না।
আমি বলি, আমাদের আর একসাথে থাকা সম্ভব নয়।
তার আম্মা বলেন, তোমার হাতে ধরছি, বাবা।
ফিরোজা বলে, তুমি কি আমাকে ঘেন্না করো।
আমি বলি, না।
ফিরোজা বলে, আমি তোমার কাছে ফিরে আসতে চাই।
আমি বলি, না।
আমরা চারজন বসে আছি, কথা বলছি না; ফিরোজার বোন কথা বলছিলেন, এখন তিনিও কথা বলছেন না; তবে তারা আরো দেখবেন, হয়তো সারারাত দেখবেন, তারপরও দেখার জন্যে আরো দিনরাত পড়ে থাকবে। আমি না-টিকে ফিরিয়ে নিতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না; ফিরোজার সাথে আমার বাঁশের সাঁকো ভেঙে গেছে, ওটি আবার আমি তৈরি করতে চাই না। আমি আর কোনো সাঁকোই তৈরি করতে চাই না, প্রথাগত সাঁকো তো নয়ই। স্বামী-স্ত্রী শব্দগুলো ঘিনঘিনে মনে হচ্ছে আমার কাছে, নিজেকে আমি আর স্বামী ভাবতে পারছি না কারো, কাউকে আমার স্ত্রী ভাবতে পারছি না। কাবিনের নোংরা কাগজে অনেক আগে আমি একবার সই করেছিলাম, তার কবল থেকে আমি বেরিয়ে পড়তে চাই। এমন সময়, সন্ধ্যে সাড়ে আটটা হবে, ফোন বেজে ওঠে।
এটা মাহবুব সাহেবের বাসা, মাহবুব সাহেবের বাসা? অন্য প্রান্ত থেকে এক মহিলা। আর্ত চিৎকার করছেন, কোথাও হয়তো আকাশ ভেঙে পড়েছে।
বলছি, আমি বলি, আমি মাহবুব বলছি।
আমি ডাক্তার তাহমিনা, তিনি আরো আর্ত চিৎকার করেন, আমি এলিফ্যান্ট রোডের মুক্তি ক্লিনিক থেকে বলছি।
বলুন, আমি বলি।
আপনি অনন্যা নামের কাউকে চেনেন? তিনি বলেন, আমি খুব বিপদে আছি।
কেনো? আমি বলি।
সে বিকেলে আমার ক্লিনিকে এমআর করানোর জন্যে এসেছিলো, তিনি বলেন, তার দেরি হয়ে গিয়েছিলো, তার আর জ্ঞান ফিরে আসে নি।
আমার টেলিফোন নম্বর কোথায় পেলেন? আমি বলি।
তার ব্যাগে একটি ফিজিক্সের বইয়ের ভেতর নাম আর নম্বর পেয়েছি, মহিলা কেঁদে ফেলেন, আমি তিন হাজার এম আর করেছি, আগে এমন আর হয় নি।
এ-নামের কাউকে আমি চিনি না, আমি বলি, এ-নামের কাউকে আমি চিনি না।
আমি টেলিফোন রেখে দিই। অনন্যা নামের কাউকে আমি চিনি না।
আমি স্তব্ধ হয়ে চেয়ারে বসি, অনন্যা নামের কাউকে আমি চিনি না। আমার ঘেন্না লাগতে থাকে, ওরা তিনজনই আমার সাথে কথা বলতে চায়, কী যেনো বলে, আমি শুনতে পাই না। আমার ঘেন্না লাগতে থাকে। আমি কোনো কথা বলি না, ওরা তিনজন আমাকে কী বলছে আমি শুনতে পাই না। ওরা আর কথা বলছে না মনে হয়, হয়তো ভয় পেয়ে গেছে। আমি অনন্যা নামের কাউকে চিনি না। দশটা বাজলো মনে হয়, ঘড়িটা থামছে না, সারা পৃথিবীতে ঘড়িটা দশটা বাজার সংবাদ পৌঁছে দেবে মনে হচ্ছে। আমি একটি পায়ের পাতা দেখতে পাই, পায়ের পাতার নিচে ঘাস সোনালি হয়ে উঠছে। আমার বুক খুব ভারী হয়ে উঠছে। আমি অনন্যা নামের কাউকে চিনি না। এগারোটা বাজলো, ওরা তিনজন আমার সামনে বসে আছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ কী যেনো বলতে চাচ্ছে, আমি শুনতে পাচ্ছি না। বারোটা বাজলো, ঘড়িটা সারা সৌরজগতে বারোটা বাজার শব্দ পৌঁছে দেয়ার পণ করেছে। একটা বাজে; কার জন্যে বাজে?–আমি আর বসে থাকতে পারছি না, আমি উঠে দাঁড়াই, দরোজা খুলে বাইরে বেরোই। আমি রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকি, এলিফ্যান্ট রোড আমি চিনি, এলিফ্যান্ট রোডের দিকে হাঁটতে থাকি। এখন কটা বাজে আমি জানি না। আমি চৌরাস্তায় এসে দাঁড়াই। মহিলা কোন ক্লিনিকের নাম যেনো বলেছিলো? মডার্ন, নবজীবন, আরোগ্য, আবেহায়াত? আমি কোনো নাম মনে করতে পারছি না। কতো নম্বর এলিফ্যান্ট রোডঃ ১০, না ১০০, না ১০০০? আমি মনে করতে পারছি না। আমি প্রতিটি দালানের দরোজায় দরোজায় যেতে থাকি, প্রত্যেকটি দরোজা বন্ধ; আমি নাম পড়তে চাই, কোনো নাম পড়তে পারি না। আমি দরোজা থেকে দরোজায় দৌড়ে যেতে থাকি, চিৎকার করতে থাকি নাম ধরে, কোনো দরোজা খোলে না। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না, চারদিকে প্রচণ্ড অন্ধকার নামছে। আমার সামনে একটি দালান ভেঙে পড়ছে আমি দেখতে পাচ্ছি, আমি দৌড়ে অন্য দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছি, একটির পর একটি দালান ভেঙে পড়ছে; ওপাশের দালানগুলো ভেঙে পড়ছে, এপাশের দালানগুলো ভেঙে পড়ছে, সামনের দালানগুলো ভেঙে পড়ছে, পেছনের দালানগুলো ভেঙে পড়ছে, মহাজগত জুড়ে ভেঙে পড়ার শব্দ। হচ্ছে; আমি ভাঙা দালানের ভেতর দিয়ে ছুটছি, দালানের পর দালান ভেঙে পড়ছে, শহর ভেঙে পড়ছে, আমি অন্ধকারে ভেঙে পড়া দালানের পর দালানের ভেতর দিয়ে ছুটছি, কী যেনো খুঁজছি, আমার চারদিকে দালান ভেঙে পড়ছে, শহর ভেঙে পড়ছে, সব কিছু ভেঙে পড়ছে।