ফিরোজা ফোন করেছে, তার বেশি কথা নেই, একটি মাত্র তার কথা।
আমি তোমার থেকে পৃথক থাকতে চাই, ফিরোজা বলে।
ঠিক আছে, আমি বলি।
ফিরোজার কথা আমার মনেই পড়ে নি কয়েক দিন, তার ফোন পেয়ে মনে হলো সে আমার স্ত্রী ছিলো, এখনো আছে; তবে এখন দূরে থাকতে চায়, কিছু দিন পর হয়তো। বিচ্ছেদ চাইবে। একলা থাকতে আমার খারাপ লাগছে না, ব্রিজ ভেঙে পড়লে ব্রিজের খারাপ লাগে না, খারাপ লাগে অন্যদের, আমার খারাপ লাগছে না। আমার ব্যক্তিগত সহকারিণীটিকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে, বিষণ্ণতায় সে সুন্দর হয়ে উঠছে। কার জন্যে, কী জন্যে?
তোমাকে এতো বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেনো? আমি বলি।
সে চমকে ওঠে, আমার থেকে সে এমন প্রশ্ন আশা করে নি; কিন্তু আমার প্রশ্ন শুনে সে খুশি হয়ে উঠছে।
কই, না স্যার, এমনি, সে বলে।
বিষণ্ণ হওয়ার কথা আমার, আমি বলি।
কেনো স্যার? সে বলে।
আমার মেয়ে চলে গেছে, বউ পৃথক থাকতে চাচ্ছে, আমি বলি।
মেয়েটি আবার বিষণ্ণ হয়ে পড়ে।
আমাদের লিমিটেড এখন গোটা দশেক ব্রিজের কাজ করছে, তার মধ্যে একটি বড়ো ব্রিজ রয়েছে, কিন্তু এখন আমি ভাবছি সুড়ঙ্গপথের কথা। ব্রিজ দেখে দেখে আমার ক্লান্তি এসে গেছে। যে-শহরটিতে আমি থাকি, সেটি জঙ্গলে পরিণত হয়ে গেছে, ওর দম আটকে আসছে, ওর রাস্তাগুলো নিশ্বাস ফেলতে পারছে না। আমি সুড়ঙ্গপথের কথা। ভাবছি, একটি পরিকল্পনা এসেছে আমার মাথায়। শহরের কেন্দ্র থেকে উত্তর দক্ষিণ পুব পশ্চিমে সুড়ঙ্গ খোঁড়া যেতে পারে, তার পরিকল্পনা করছি আমি মনে মনে, কিছুটা। কাগজে কম্পিউটারে; আমার মনে হচ্ছে এটা করার এখন সবচেয়ে ভালো সময়। আমার। আমার শরীরকাঠামো ততোদিন টিকবে না, আমি একটিও সুড়ঙ্গপথ দেখে যাবো না, কিন্তু তার পরিকল্পনা করার এটাই ভালো সময়। আমাদের কয়েকজনের। সাথে আমি আলাপ করেছি, তারা হেসেছেন, একজন আমাকে স্বপ্নদ্রষ্টা উপাধি দিয়েছেন, কিন্তু আমার ভালো লাগছে। বাস্তবের থেকে স্বপ্নকেই বেশি ভালো লাগছে আমার।
অনেক দিন পর নুর মোহাম্মদ আর বেগম নুর মোহাম্মদকে দেখে ভালো লাগলো আমার আগের মতোই বারান্দায় তারা একজন দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন, চোখ আরেকটুকু ঘোলা হয়েছে মনে হয় নুর মোহাম্মদ সাহেবের; আরেকজন চায়ের। পেয়ালা নিয়ে পুব দিকে তাকিয়ে আছেন, চা খাচ্ছেন না। আমার কি বেশ ভালো। লাগলো? কী সুখ এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বসে থেকে? তাঁরা কী করে পারছেন? তাঁদের ক্লান্তি লাগছে না? ক্লান্তিকে তাঁরা এতো মহৎ করে তুলছেন কীভাবে? একদিন আমি। তাদের সাথে গিয়ে বসবো? আলাপ করবো? তারা কি আলাপ করবেন আমার সাথে? তার কি বুঝতে পারছেন তাঁরা ক্লান্ত? একটি বেজি দৌড়ে ওপাশের জঙ্গলে ঢুকলো, বেজিটাকে আমার ঈর্ষা করতে ইচ্ছে করছে; নুর মোহাম্মদদের ঈর্ষা করছি না। অনেক দিন ধরে আমি কাম বোধ করছি না, আমার একটু বোধ করতে ইচ্ছে করছে; আজ অফিসে গিয়ে দেখবো সহকারিণীটিকে দেখে আমার কামবোধ হয় কি না।
আপনার সাথে বেড়াতে যেতে চাই, অনন্যা ফোনে বলছে, আপনি কেনো রাজি হচ্ছেন না?
তাহলেই তো তুমি অনেক দূরে চলে যাবে, আমি বলি।
চলে যে যাবোই তা তো আমি নিশ্চিতভাবে জানি না, অনন্যা বলে, যেতেও পারি, তার আগে চলুন না গাছ দেখে আসি নদী দেখে আসি।
আমি নদী আর গাছ অনেক দেখেছি, আমি বলি।
একলা নদী দেখা একলা গাছ দেখার থেকে দুজনে গাছ আর নদী দেখা ভিন্ন, অনন্যা বলে।
আমার থেকে সবাই আজকাল দূরে চলে যেতে চায়, আমি বলি।
আজ আমার আব্বার মৃত্যুর দিন, অনন্যা বলে, তাই আজ বেড়াতে যেতে খুব ইচ্ছে করছে।
তোমার আব্বা নেই? আমি বলি, তুমি তো কখনো বলে নি।
অনন্যা কাঁদতে থাকে, আমি তার কান্না দেখতে পাই।
চলুন না একটু বেড়িয়ে আসি, অনন্যা বলে।
না, আমি বলি।
আমার সহকারিণীটিকে দেখে আমি কামবোধ করছি, সে এখন অনেক বেশি স্বাভাবিক হয়ে উঠছে আমার সামনে, মাঝেমাঝে দু-একটি কথা বলছে, ঝিলিকের মতো লাগছে আমার।
স্যার, আজকে কি আমাকে বিষণ্ণ লাগছে? সে বলছে।
না, খুব ঝলমলে দেখাচ্ছে, আমি বলি।
আমাকে তো আপনি পছন্দ করেন না, স্যার, সে বলে।
কে বললো তোমাকে? আমি বলি।
আমার মনে হয়, সে বলে, আমার একটি খবর আপনাকে দিতে ইচ্ছে করছে, স্যার।
বলো, আমি বলি।
আমার বিয়েটা কয়েক দিন আগে ভেঙে গেছে, সে বলে, এখন ভালো আছি, স্যার।
আমার সাথে তুমি আজ বেড়াতে যাবে? আমি বলি।
যাবো, সে বলে।
আমি ফোন করে পাঁচতারা হোটেলের দশতলায় একটি কক্ষ বুক করি, দেবীর সাথে গিয়েছিলাম যে-কক্ষটিতে।
আমি আজ তোমাকে ছুঁতে চাই, আমি বলি।
আমিও চাই, সে বলে।
আমরা দশতলার কক্ষটিতে প্রবেশ করি, মেয়েটি উড়ছে বলে মনে হচ্ছে; গাড়িতে প্রজাপতির মতো করছিলো, বারবার জানালার কাঁচে লেগে ফিরে ফিরে আসছিলো। ভেতরে, বদ্ধতা বোধ হয় তার সহ্য হচ্ছিলো না। আমি ঘরে ঢুকে তার দিকে তাকাই, আমাকে সে জাগিয়ে তুলছে মনে হচ্ছে। আমি এতো দিন খেয়াল করি নি সে একটি চমকার শরীর, হাঁটার সময় অনেকটা নাচার মতো ভঙ্গি করে। এক সময় হয়তো। নাচতো, এখনো নাচে? তাকে আমি কী করে জড়িয়ে ধরবো? আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না। আমি একটি সোফায় বসে পড়ি, সে মেঝেতে বসে।
তুমি মেঝেতে বসলে কেনো? আমি বলি।