আমি অনন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, ঘাস সোনালি হয়ে উঠছে দেখতে পাই।
না, আমি বলি।
কেনো? অনন্যা বলে।
তোমাকে আমার সুন্দরের থেকে বেশি মনে হয়, আমি বলি।
তাতে কী? অনন্যা বলে।
আমি তা বুঝতে পারছি না, আমি বলি, তবে আজো তোমাকে ভোগ করার কোনো ইচ্ছে আমার হয় নি। কোনো দিন হতে পারে।
আপনার চোখ দেখে আমি তা বুঝতে পারি, অনন্যা বলে, কিন্তু জানেন আমি যেখানেই যাই সবাই আমাকে ভোগ করতে চায়, হয়তো সব মেয়েদেরই চায়।
আমিও সাধারণত চাই, আমি বলি।
আমার ছাত্রটি আমাকে ভোগ করতে চায়, অনন্যা বলে, ওই গোলাপের অর্থ আমি বুঝি।
চুপ করে হাসে অনন্যা, এবং বলে, বুড়ো প্রিন্সিপালটি আমাকে ভোগ করতে চায়। ইলেক্ট্রিক বিল দিতে গেলে কেরানিটি এমনভাবে তাকায়! কোর্টে আমাদের একটি মামলা আছে, আমিই দেখাশোনা করি, আমাদের প্রত্যেকটি উকিল আমাকে ভোগ করতে চায়, আমি বুঝি, তাদের চার পাঁচটি করে বাচ্চা আছে।
খোঁড়া ভিখিরিকে পয়সা দেয়ার সময় খেয়াল কোরো, দেখবে সেও তোমাকে ভোগ করতে চাচ্ছে, আমি বলি, মনে মনে ভোগ করছে।
এমনকি আমার তিনটি সহকর্মিণীও চাচ্ছে, অনন্যা বলে, আমি ওদের সাথে ভোগে সঙ্গী হই।
তা চাইতে পারে, আমি বলি, সব সময় পুরুষ লাগে না।
ওরা হোস্টেলে থাকে, অনন্যা বলে, আমাকে জোর করে নিয়ে যায়, ভালো খাওয়ায়, আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওরা ঘুমোয়, আমাকে কিছু বলে না।
ওরা ভাবছে এক সময় তুমি নিজেই অংশ নেবে, আমি বলি।
আমি শিগগিরই বোধ হয় অনেক দূরে চলে যাবো, অনন্যা বলে, কষ্ট হয় আপনার সাথে দেখা হবে না।
কোথায় যাবে, কেননা দেখা হবে না? আমি বলি।
আমি নিজেও জানি না, অনন্যা বলে, হয়তো কেউ জানবে না। তার আগে আমরা একদিন বেড়াতে যাবো।
তার আগে তুমি আমার সাথে বেড়াতে যাবে, আমি বলি, তাহলে আমি তোমার সাথে কোনো দিন বেড়াতে যাবো না। তখন তুমি আর অনেক দূরে যেতে পারবে না।
বেড়াতে না গেলেও হয়তো আমাকে চলে যেতে হবে, অনন্যা বলে, চলুন না। আজই বেড়াতে যাই।
না, না, না; আমি বেড়াতে যাবো না, আমি বলি।
অনন্যাকে আজ মধুরতম মনে হচ্ছে, আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো আমার বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করবে, হয়তো তাকে ভোগ করার বাসনা জেগে উঠবে, আমার রক্ত জ্বলে উঠবে। আমি উঠে পড়ার প্রস্তাব দিই, অনন্যা আরো কিছুক্ষণ থাকতে চায়, কিন্তু আমি উঠতে চাই।
আপনার কি কোনো জরুরি কাজ আছে? অনন্যা বলে।
না, কোনো কাজ নেই; বেরিয়ে কোথায় যাবো, তাও জানি না; কিন্তু আমি উঠতে চাই।
কেনো? অনন্যা বলে।
আর কিছুক্ষণ থাকলে আমার মনে ভোগ করার সাধ জাগবে, আমি বলি।
জাগুক না, অনন্যা বলে।
আমি অনন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি; কিন্তু এখনো আমার ভোগ করার সাধ জাগছে না, অনন্যার শরীর পরিমাপ করার আগ্রহ হচ্ছে না, মনে হচ্ছে আমার ভেতর। কোনো পুরুষ নেই, লিঙ্গ নেই। অদ্ভুত লাগে আমার।
আমাকে দেখে যাদের সাধ জেগেছে, অনন্যা বলে, তাদের জন্যে আমার কোনো সাধ জাগে নি; আমার ইচ্ছে হচ্ছে যার জন্যে আমার সাধ জেগেছে আমার জন্যে তার একটু সাধ জাগুক।
হয়তো কোনো দিন জাগবে, আমি বলি।
তখন হয়তো আমি থাকবো না, অনন্যা বলে।
অনন্যা ওঠে, আমি তাকে একটি রিকশয় উঠিয়ে দিই। অনেকক্ষণ রিকশটির দিকে তাকিয়ে থাকি। একটু আগে আমার মনে হচ্ছিলো কোথায় যাবো আমি জানি না, কিন্তু এখন আমার তা মনে হয় না। আমার বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে। খুব দুঃখ পেলে আমি খুব সুস্থ হয়ে উঠি। ছেলেবেলা জেগে ওঠে আমার মধ্যে, যখন আমি চরম কষ্টে পড়ি তখনি এটা হয়, দুঃখ পেলে আমি কেমন করে যেনো নিজেকে গুটিয়ে আনি নিজের মধ্যে। এখন যদি আমি রাস্তায় বসে ভিক্ষে চাইতে শুরু করতাম, সেটা অস্বাভাবিক। হতো না, আমার ভেতরটা তেমনি করছে; যদি আমি ট্রাকটির নিচে ঝাঁপিয়ে পড়তাম, সেটা অস্বাভাবিক হতো না, আমার ভেতরটা তেমনি করছে; কিন্তু আমি বাসার দিকে হাঁটতে থাকি। একটি রিকশ নিই, কাজের মেয়েটি আমাকে দেখে অবাক হয়। মেয়েটির মুখ দেখে ওকে নিঃসঙ্গ লাগে, ও আমার থেকেও নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে। একটু হুইস্কি খাবো? না। একটা এক্সএক্সএক্স ছবি দেখবোর না। আমার সহকারিণীটিকে ফোন করবো? না। আমি আমার বইগুলো আবার খুঁজতে শুরু করি, অনেক দিন বই পড়ি নি, একটি পাগলা কবির কবিতার বই আমার হাতে পড়ে, এককালে ওর কবিতা ভালো। লাগতো, ওর পাগলামো আমি পছন্দ করতাম; আমি পড়তে শুরু করি, পাগলামো। আমার আবার ভালো লাগতে শুরু করে। আমি ওর কবিতা পড়তে থাকি, উঁচুকণ্ঠে ..পড়তে থাকি, আমার মুখস্থ হয়ে যেতে থাকে, বাইরে সন্ধ্যা হয়ে যেতে থাকে। বারবার ফোন বাজতে থাকে, আমি ধরি না, আমার কোনো বাইরের জগৎ নেই। কিন্তু ফোনের শব্দে আমার চারপাশ ভেঙে পড়তে থাকে; আমি ফোন ধরি।
মাহবুব সাহেব, মাহমুদা রহমান বলেন, আপনাকে পাবো ভাবি নি, কিন্তু একটি খবর দেয়ার জন্যে আপনাকে চারদিকে ফোন করছি।
কী খবর বলুন?
এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে হাফিজের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, মাহমুদা রহমান বলেন, হাফিজ মারা গেছে।
আমি খুব দুঃখিত, আমি বলি, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
কিন্তু আমার কোনো কষ্ট লাগছে না, মাহমুদা রহমান বলেন।
হাফিজুর রহমানের লাশ দেখতে কি যেতে হবে আমাকে? মাহমুদা রহমান আমাকে যেতে বলেন নি, আর হাফিজুর রহমান বলে কেউ ছিলেন, তাঁর সাথে আমার পরিচয়। ছিলো, আমার মনে পড়ে না; তার চেহারা কেমন ছিলো? আমার মনে পড়ে না। অর্চিকে মনে পড়ে আমার, অর্চির মুখটি মনে পড়ে না। অর্চি কি পৌঁছে ফোন করেছে? অর্চি কি পৌচেছে? অর্চির প্লেন কি এখনো উড়ছে, চিরকাল উড়তে থাকবে? অর্চির এখন ফিরে আসতে ইচ্ছে করছে? অর্চি কে? আমার মেয়ে? অর্চির অনেক ছবি আছে অ্যালবামে, এখনি আমি বের করে দেখতে পারি, দেখতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু দেখতে গেলে ছবিগুলো যদি কাঁদে, ছবিগুলোর চোখে যদি জল দেখা দেয়? অনন্যা কি বাসায় ফিরেছে, না কি। সে অনেক দূরে যাবে বলেছে, অনেক দূরে যাত্রা করেছে? কতো দূর যাবে? আমি কি অনন্যাকে একবার ফোন করবো? আমি ফোন করলে সে ভয় পাবে, মনে হবে আমার কিছু হয়েছে।