মামুন ছিলো ছোটো খালার ছেলে, দেখতে আমারই মতো, আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোটো। মামুনকে আমি খুব ভালোবাসতাম দেখতে আমার মতোই ছিলো। বলে; ও আমাদের বাড়ি বেড়াতে এলে আমার পেছনেই লেগে থাকতো সব সময়। মামুনের একটা বড়ো গৌরব ছিলো সে দেখতে আমার মতো। আমি এতোবার শুনেছি যে মামুন দেখতে আমার মতো তাতে আমার ধারণা হয়ে গিয়েছিলো যে দেখতে আমার মতো হওয়া গৌরবের বিষয়। বাবা মামুনকে আমার মতোই আদর করতেন। মামুন। এলে আমরা দুজন এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি, এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গল, এক মাঠ থেকে আরেক মাঠে ছুটে বেড়াতাম। পথে পথে শুনতাম, ওরা দেখতে একই রকম; যেনো এক মায়ের পেটের ভাই।
খালা বলতো, মামুন তোর আপন ভাই, তুই ওকে দেখে রাখবি।
আমি বলতাম, আচ্ছা।
এক বিকেলে মামুন আর আমি নদীর পারের কাশবনের ভেতর দৌড়োদৌড়ি করছিলাম, তখন একটি বুড়ী আমাদের ডাকে। সে একটা বোঝা তার কাখ থেকে নামিয়ে বিশ্রাম করছিলো, এখন আর বোঝা কাঁখে তুলতে পারছে না, আমাদের সে। ডাকে তার বোঝা কাঁখে তুলে দিতে। আমি আর মামুন তার বোঝা তুলে দেয়ার পর সে দোয়া করতে করতে আমাদের ভালোভাবে দেখে। বুড়ী বাইচ্চা থাক বলে আমাদের দোয়া করে, আমার ও মামুনের মুখে হাত বুলোয়, এবং জানতে চায় আমরা একই মায়ের পেটের ভাই কিনা। আমি তাকে বলি যে আমরা একই মায়ের পেটের ভাই নই, খালাতো ভাই। বুড়ী আমাদের মুখের দিকে চেয়ে থেকে পথে চলতে শুরু করে। তার বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলার অভ্যাস ছিলো, যেমন থাকে গ্রামের সব। বুড়ীরই। আল্লার দুনিয়ায় কত দেহুম, বুড়ী ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটতে হাঁটতে বলতে থাকে, খালাতো ভাইরা দ্যাকতে একরকম, তয় মাগী দুইডা অইলেও বাপ একটাই। কত দ্যাকলাম। শুনে আমি চমকে উঠি, মামুন কিছু বুঝতে পারে নি বলে চমকায় না। নদীর পারে কাশবনে আমি গুচ্ছগুচ্ছ অন্ধকার দুলতে দেখতে থাকি, মামুনকে আমার অচেনা মনে হতে থাকে। মনে হয় আমি আর বাড়ি ফিরে যেতে পারবো না, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়। আমি বসে পড়ি, মামুন অবাক হয়ে আমার পাশে বসে। জোনাকিরা দেখা দিতে থাকে, সেগুলোকেও আমার কয়লার টুকরো মনে হয়।
রাতে ঘুমোতে আমার কষ্ট হয়, আমি ঘুমোতে পারি না। মামুন ঘুমিয়ে আছে, ওর কোনো কষ্ট হচ্ছে না। বড়ো হলে, বুঝতে পারলেই কষ্ট বাড়ে। চারপাশে অনেক রাত, এক গাছ থেকে আরেক গাছে বাদুড় উড়ে যাওয়ার শব্দ পাচ্ছি, আমি ঘর থেকে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, পুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকি, কোনো নতুন বউকে গোসল করতে দেখি না, বোঝা কাঁখে একটি বুড়ীকে হেঁটে যেতে দেখি। তখন দেখতে পাই। বাবার ঘর থেকে কে যেনো বেরোচ্ছে, অন্ধকারে তাকে ছায়া বলে মনে হয়, কিন্তু তাকে আমি চিনতে পারি। তার শাড়ির আঁচল জড়ানোর ভঙ্গি, হাঁটার ভঙ্গি আমি চিনতে পারি। মনে হয় সুখে ভেঙে পড়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলো। আমি চিৎকার করে উঠতে পারতাম, কিন্তু তখন আমার কণ্ঠে কোনো শব্দ ছিলো না, শরীরে কোনো রক্ত ছিলো না। বাবার মুখ আমার মনে পড়ে, তখন আমার অন্য রকম ভাবনা হয়। আগে আমার মনে হতো বাবার কোনো সাঁকো নেই, এখন মনে হতে থাকে বাবার একটি সাঁকো আছে, একথা ভেবে আমার ভালো লাগতে থাকে। তখন আমার ঘুম পায়, আমি ঘুমিয়ে পড়ি, আমার কোনো কষ্ট হয় না। ভোরে উঠে আমি, বাবাকে দেথি, ইচ্ছে করেই খালাকে দেখি; দুজনকেই আমার খুব সুখী মনে হয়, যেমন সুখী মনে হয় সাঁকোর দু-পারকে। বাবাকে আমার খারাপ লাগে না, খালাকে আমার খারাপ লাগে না। তবে কয়েক দিন ধরে ওই ঘটনাটি আমি ভাবি, আমার মনে হতে থাকে মানুষ এমনই; মনে হয় মানুষ বাইরে এক রকম, তার বাইরেরটা সত্য নয়; মানুষ ভেতরে অন্য রকম, তার ভেতরেরটাই সত্য; কিন্তু ভেতরেরটা কেউ দেখতে দেয় না। বাবার ভেতরেরটা কেউ জানে না, বাইরেরটা জানে; তার বাইরেরটা দেখে কেউ। তার সামনে কথা বলতে পারে না। ভেতরেরটা জেনে ফেললে কি সবাই বাবাকে ঘেন্না করবে, বিপদে ফেলবে? না, বাবার ভেতরেরটা আমি কাউকে জানতে দেবো না; বাবাও কখনো জানবেন না যে আমি তার ভেতরেরটা জানি।
আমার দাদা খুন হয়েছিলেন, ছোটোবেলা থেকেই আমি তার কথা শুনে এসেছি। তিনি খুন হয়েছিলেন বলে তাকে আমার মহাপুরুষ মনে হতো; আমি মনে করতাম। কেউ খুব বড়ো হয়ে গেলে ছোটোরা তার বিরুদ্ধে চলে যায়, তাকে সহ্য করতে পারে না, তখন ছোটোরা তাকে খুন করে। খুন করে ছোটোরা নিজেদের বড়ো করে তোলে নিজেদের কাছে। দাদার যে-বর্ণনা বারবার আমি শুনেছি তাতে তাকে মহাপুরুষ না। ভাবার কোনো উপায়ই আমার ছিলো না। তিনি দেখতে বড়ো ছিলেন, চারপাঁচজন তার সাথে জোরে পারতো না; তিনি অল্প বয়সেই ধানের ব্যবসা করে অনেক টাকা। করেছিলেন, ওই টাকা দিয়ে বিলে কিনেছিলেন কানি কানি জমি আর দিঘি। তার খুনের পর পঞ্চাশটা সিন্দুক ভেঙে পুলিশের লোকেরা মনের পর মন রুপোর টাকা বের। করেছিলো, ঘোড়ায় করে সেগুলো নিয়ে গিয়েছিলো। এক রাতে তিনি খুন হয়ে যান। সে-সন্ধ্যায় তিনি খাওয়াদাওয়া করে বাইরে যান, রাতে জঙ্গলের পাশের পথে খুনীরা। তাকে খুন করে ফেলে রাখে। তার গলা থেকে শরীর আলাদা করে দেয়। তবে তাঁকে খুন করার জন্যে কেউ শাস্তি পায় নি, কেউ ধরা পড়ে নি। একদিন আমি একটা সিন্দুক খুলে কতকগুলো পুরোনো কাগজ পাই, মোটা মোটা মসৃণ ঘিয়ে রঙের কাগজ, তার। ভেতরে আরো কতকগুলো কাগজ। কাগজগুলো খুলে দেখি দাদার খুনের মামলার কাগজপত্র ওগুলো। আমি পড়তে শুরু করি, একজায়গায় এসে আমি চঞ্চল হয়ে উঠি।