কখন বাসায় ফিরেছি আমি জানি না, কাজের মেয়েটি দরোজা খুলে দিয়ে আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। আমি আমার ঘরে গিয়ে দরোজা বন্ধ করে দিই। শুধু টেলিফোন বাজছে, টেলিফোন বাজছে, পৃথিবীতে আর কিছু নেই টেলিফোনের শব্দ। ছাড়া, আমি কোনো টেলিফোন ধরছি না, পৃথিবীর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না। আমি একটি বোতল বের করি, পান করতে থাকি। অর্চি কি কষ্ট পাচ্ছে তার কি ফিরে আসতে ইচ্ছে করছে? তার কি প্লেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছে হচ্ছে? আমার। ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছে হচ্ছে, মনে হচ্ছে আমি ঝাঁপিয়ে পড়েছি, আমাকে ঘিরে আছে। অন্ধকার আকাশ। আমি নদীর পর নদী দেখতে পাচ্ছি, নদীর ওপর আমার ব্রিজগুলো দেখতে পাচ্ছি, মেঘবতী, যমুনা, করতোয়া, ফুলঝরি, ফুলমতি, সুরমা, একটির পর একটি ব্রিজ ধসে পড়ছে, ধসে পড়ার দৃশ্য আমার কাছে সুন্দর লাগছে। ফিরোজা কি এখন নৃতাত্ত্বিকটির বিছানায়? ফিরোজার বা স্তনটি লাফিয়ে উঠছে আমার চোখের সামনে, সেটিতে দুটি বড়ো বড়ো তিল আছে, আমার কামড়ের দাগ হয়তো মুছে গেছে। যতোই বয়স বাড়ছে ততোই সুন্দর হচ্ছে ওর স্তনযুগল। অনন্যা কী করছে, ঘুমোচ্ছে? তার ছাত্রটি? কতোগুলো গোলাপ সে ফেলেছে এ-পর্যন্ত? অনন্যা কি কখনো ঘুমিয়েছে কারো সাথে? তার ছাত্রটির সাথে? স্যার, আপনার জন্যে বসে থেকে থেকে ছটায় বাসায় যাচ্ছি, আপনার জন্যে কেমন লাগছে; লাগুক। আমি কি একবার ফোন করবো আমার সহকারিণীটিকে? অনন্যাকে না, আমি কাউকে ফোন করবো না। কলাপাতাটি কি বেঁচে আছে, মাহমুদা রহমান উদ্ধার পেয়েছেন? এখন হিন্দি ছবির যে-মেয়েটি নাচছে, তার বগলের লোমগুলো আমার ভালো লাগছে, ওর বগলের লোমে কে কে কে কে কে জিভ রাখে? অনন্যার বগলে কি লোম আছে? অনন্যা কি শেভ করে? বাঙালি। মেয়েগুলো শেভ করে, ওরা কোথায় শিখেছে কে জানে, বিচ্ছিরি লাগে; হয়তো অনন্যাও শেভ করে। মাহমুদা রহমান করত, দেবী করতো, ফিরোজাও করতো। আমাদের। কাজের মেয়েটিও বোধ হয় করে। নইলে আমার ফেলে দেয়া ব্লেডগুলো পাই না কেনো? আবদুর রহমান সাহেব কি এখনো সেই কাজের মেয়েটিকে নিয়েই থাকেন? না কি বদল করেছেন? বউ মারা যাওয়ার পর তিনি আরো ভালো আছেন; বছর বছর কাজের মেয়ে বদলাচ্ছে। তিনি আর বিয়ে করবেন না, প্রিয়তমা স্ত্রীর শোক ভুলতে পারছেন না, কাজের মেয়ে বদলাচ্ছেন, কাজের মেয়ে বদলাচ্ছেন।
এখন যে-ফোনটি বাজছে
এখন যে-ফোনটি বাজছে, সেটি অনন্যার, শব্দ শুনেই বুঝতে পারছি; কিন্তু আমি। ধরতে এতো দেরি করছি কেনো? আমি কি ফোন ধরবো না? অথচ আমি আজ অফিসে এসেছি শুধু অনন্যার ফোনেরই জন্যে। কিন্তু আমি ফোন ধরছি না কেনো? ফোন একবার থামলো, আবার বাজতে শুরু করলো; অনন্যা অনেকক্ষণ ফোন ধরে রাখতে পারে, আবার থামলো, বাজতে শুরু করলো আবার। আটটা চল্লিশ বেজে গেছে, তবু অনন্যার ফোন বাজছে, সে কি তার নটার ক্লাশ ধরবে না? আজ তার নটার ক্লাশ নেই? কেননা নেই? তার কি অসুখ করেছে? সে কি যাবে কোথাও? তার কতোটুকুই আমি। জানি, আসলে কিছুই জানি না, জানতেও চাই না। তার ছাত্রটি তাকে কতোগুলো গোলাপ দিয়েছে এ-পর্যন্ত গোলাপ দিতে গিয়ে ছেলেটা অনন্যার হাত ছোঁয় না? অনন্যার তখন কেমন লাগে? অনেকক্ষণ আঙুল লেগে থাকে? ঘাস কি সত্যিই সোনালি হয়ে উঠেছিলো? আমি কি হেলুসিনেশন দেখি? আমি এবার ফোন ধরি।
আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, অনন্যা বলে, আপনি ফোন ধরছেন না দেখে। আধঘণ্টা ধরে রিং করছি।
তুমি আজ কি কলেজে যাচ্ছো না? আমি বলি।
না, আজ আর যাবো না; বুক কষ্টে ভরে গেছে, অনন্যা বলে।
তোমার ছাত্রটি গোলাপ কাকে দেবে তাহলে? আমি বলি।
আপনি কি ওকে ঈর্ষা করেন? অনন্যা বলে।
একটু ভেবে দেখতে হবে, আমি সম্ভবত মিথ্যা বলি।
আপনার কি অসুখ করেছে? অনন্যা বলে।
না তো, আমি বলি।
কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি আপনার অসুখ করেছে, অনন্যা বলে।
তুমি কি আমাকে সারিয়ে তুলতে পারো? আমি বলি।
নিজেকেই আমি সারাতে পারি না, আপনাকে কীভাবে সারাবো? অনন্যা বলে।
কিন্তু আমার মনে হয় তোমার আঙুলে আরোগ্য আছে, আমি বলি।
অনন্যা হাসে, আমি তার হাসি দেখতে থাকি; সে বলে, তাহলে আপনি আপনার সিংহাসনে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করুন, আমি ম্যাসাজ করে দিই।
আমি অনন্যার স্পর্শ অনুভব করতে থাকি; দশটি স্বর্ণচাপা আমার চুলের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে, আমার চোখের পাতার ওপর দিঘির ওপর কালো ছায়ার মতো স্থির হয়ে আছে, স্বর্ণচাপা বয়ে চলছে আমার নাকের ওপর দিয়ে মুখের ওপর দিয়ে আমার গ্রীবার ওপর দিয়ে বুকের ওপর দিয়ে পিঠের ওপর দিয়ে আমার মাংসের ভেতর দিয়ে আমার রক্তের ভেতর দিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ছি স্বর্ণচাপা বয়ে চলেছে নদী বয়ে চলেছে ছায়া। স্থির হয়ে আছে আমি ঘুমিয়ে পড়ছি আমি স্বর্ণচাপা দেখছি ঘাস সোনালি হয়ে উঠছে পায়ে চুমো খাচ্ছি আমি অনুভব করছি আমার বুকের ওপর কে যেনো মাথা রাখছে অনন্যার শরীরের গন্ধ পাচ্ছি অনন্যার শাড়ির গন্ধ পাচ্ছি স্বর্ণচাপার গন্ধ পাচ্ছি।
একটু কি ভালো লাগছে। অনন্যা বলে।
খুব ভালো লাগছে, আমি বলি।
আমাকে কি আপনার দেখতে ইচ্ছে করছে না? অনন্যা বলে।
আমি তো তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, আমি বলি।