শদশেদ মোল্লা বলে, তোমারে আইজও আমি পুরা পাই নাই। আইজ রাইতেই পাইতে চাই।
দেবী বলেন, পাইবা।
অর্চি আজ চলে যাচ্ছে, আমি অফিসে যাই নি, যেতে ইচ্ছে করে নি; ওকে বারবার দেখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না, ওর ঘরে যেতে আমার সাহস হচ্ছে না, দেখে যদি আমার খুব কষ্ট লাগে, যদি ওর খুব কষ্ট লাগে। ও একবার আমাকে দেখে অবাক হয়েছে, বলেছে, তুমি অফিসে যাও নি? আমি বলেছি, আজ যাবো না; ও বলেছে, আলু, অফিসে যাও, বাসায় থাকলে তুমি কাঁদবে। আমি কাঁদি নি, অনেক বছর কাদি নি; কিন্তু ফিরোজা মাঝেমাঝে কাঁদছে।
অর্চি বলছে, আম্মু, তোমার কান্না দেখে আমার হাসি পাচ্ছে।
ফিরোজা বলছে, তোমার কান্না দেখেও একদিন কেউ হাসবে।
অর্চি কোমল হয়ে বলছে, আম্মু, কেঁদো না, আমার সাথে চলল।
ফিরোজা বলছে, যাবো।
ফিরোজা আরো কাঁদছে, অর্চিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, আমি ঈর্ষা করছি। ফিরোজাকে, কেঁদে সে সুখী হয়ে উঠছে, আমি সুখী হতে পারছি না। ফিরোজা আর আমি কথা বলছি না, আমাদের কথা বলার কিছু নেই; অর্চি চলে যাচ্ছে তাতে কষ্ট আমাদের ব্যক্তিগত, ফিরোজারটা ফিরোজার আমারটা আমার, দুঃখটা আমাদের মিলিত নয়। আমরা অনেক দূরে সরে গেছি, দুঃখেও আমরা এক হতেপারছি না। ফিরোজা আর সবই স্বাভাবিকভাবে করছে, অর্চি আর আমাকে খাওয়াচ্ছে, দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে, তার কান্নাভরা মুখটিকে আমার সুখের মুখ মনে হচ্ছে। বিকেলে অর্চির প্লেন, আমরা অনেকেই এসেছি, আমার অফিসের সবাই এসেছে, অর্চির নানুবাড়ির সবাই এসেছে, চাচারা এসেছে। অর্চি চলে যাওয়ার সময় আমি শুধু একটি চুমো খেলাম ওর গালে, জড়িয়ে ধরতে পারলাম না, অর্চি হেঁটে হেঁটে বান্ধবীদের সাথে বিমানে গিয়ে। উঠলো। অর্চির বিমান আমার চোখ ছিদ্র করে আমার শেষ দীর্ঘনিশ্বাসের মতো পশ্চিম আকাশের দিকে উড়ে মেঘে মিলিয়ে গেলো। অর্চি কি এখন ভয় পাচ্ছে? অর্চির কি এখন ফিরে আসতে ইচ্ছে করছে? আমি একবার অন্ধকার দেখি।
আমি গাড়ির পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম ফিরোজা আসবে মনে করে। আমি আজো এমন মনে করি? অন্যরা আমার কাছে আসছে না, বুঝতে পারছি তারা সাহস পাচ্ছে না, তারা আমার বেদনাটুকু আমাকেই অনুভব করতে দিচ্ছে, সবাই ফিরোজাকে ঘিরে আছে; সে কাঁদছে, তাকে জড়িয়ে ধরে আছে কেউ কেউ। ফিরোজা খুব সুখী। আমার সহকারিণী মেয়েটি একবার এসে দাঁড়িয়েছিলো, কিছু বলতে পারে নি। আমার একটু শূন্য মনে হচ্ছে নিজেকে। সবাই যদি আমাকে ঘিরে দাঁড়াতো, আমি কেঁদে ফেলতাম, তারা আমাকে জড়িয়ে ধরতো, আমি হাল্কা হয়ে উঠতাম; কিন্তু আমাকে ঘিরে কেউ দাঁড়াচ্ছে না, জড়িয়ে ধরছে না। আমি বোধ হয় ফিরোজার জন্যে অপেক্ষা করে আছি। আমি কি গাড়িতে উঠে চলে যাবো? আমি চলে যাচ্ছি না; আমি বোধ হয় ফিরোজার জন্যে অপেক্ষা করে আছি।
তুমি যাও, আমি তোমার সাথে যাবো না, ফিরোজা বলে।
আজই, না কি কখনো যাবে না? আমি বলি।
তা পরে দেখা যাবে, ফিরোজা বলে।
আমি গাড়িতে উঠি, কিন্তু আমি কোথায় যাবো? গাড়ি চলতে শুরু করেছে, ড্রাইভার যখন শহরে ঢুকে জানতে চাইবে কোথায় যাবো, আমি কী বলবো? তাকে আমি কোথায় যেতে বলবো? আমার একটু পান করতে ইচ্ছে করছে, আমি পান করবো না, মনে হবে। আমি কাতর হয়ে পড়েছি, কাতর আমাকে দেখতে আমি পছন্দ করি না। পান করলে আমি খুব সৎ হয়ে উঠি, সরল হয়ে উঠি, নিজেকে খুলে ফেলি, আমি পান করবো না। শহরে ঢুকে আমি ড্রাইভারকে ছেড়ে দিই, হাঁটতে থাকি। সন্ধ্যা বেশ গভীরভাবে নেমেছে, সন্ধ্যা কি এভাবেই নামে সব সময়, না কি আজ অন্যভাবে নেমেছে। প্রতিটি আলোর রেখাকে রহস্যময় মনে হচ্ছে। কোথায় যেতে পারি আমি এখন? অর্চির কি কষ্ট লাগছে? অর্চির কি ফিরে আসতে ইচ্ছে করছে। অর্চির মুখটি কেমন? অর্চি কতো বড়ো? ওর চুল কি ঝাঁকড়া, ঢেউখেলা, পিঠের ওপর ছড়ানো? ও কি কোনো দিন ফিরে আসবে? ফিরোজা কি আজ নৃতাত্ত্বিকটির সাথে থাকবে অনন্যা এখন কী করছে? তাকে প্রতিদিন দুটি গোলাপ দেয় তার এক ছাত্র। আমি একটি পানশালায় ঢুকে পড়ি; একটু পান করি। পান করতে আমার ইচ্ছে করছে না, চারপাশের সবাই খুব কষ্টে আছে। আমি কারো « মুখ দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু মনে হচ্ছে তারা খুব কষ্টে আছে, আমার থেকে অনেক কষ্টে আছে। একটি লোক বারবার কেঁদে উঠছে। তার কি মেয়ে মারা গেছে, একমাত্র মেয়ে? একটি কবি এসেছে বোধ হয় পানশালায়, সে বারবার সবার পা ধরে মাফ চাচ্ছে, তাকে ক্রুশবিদ্ধ করার জন্যে আবেদন জানাচ্ছে, কেউ তাকে ক্রুশবিদ্ধ করছে না বলে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি কি তাকে ক্রুশবিদ্ধ করার ভারটি নেবো? তার কোনো ভক্ত নেই, যে ওই কাজটি করতে পারে? লোকটিকে আমার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে, সে কততগুলো পচা পদ্য লিখেছে আমি জানি না, তাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। আমি বেরিয়ে পড়ি। একটি রিকশা নিই আমি, রিকশাটি অনন্যাদের বাড়ির রাস্তায় এসে উপস্থিত হয়, রিকশাটি বোধ হয় অনন্যার ঠিকানা জানে, অনন্যার গন্ধ শুকে শুকে এখানে এসে। গেছে। আমি রিকশা থেকে নেমে পড়ি। এখানেই তাকে নামিয়ে দিয়েছিলাম আমি? আমি রাস্তার এক কোণে দাঁড়াই, আমার একটু সুখ লাগছে, তাহলে এখানেই কোথাও অনন্যা থাকে, আমি দাঁড়িয়ে থাকি। মানুষের মুখগুলো আমার অদ্ভুত লাগতে থাকে। শহর কি দেবতায় ভরে গেছে, দেবীতে ভরে গেছে? সবাইকে আমার দেবতা আর দেবী মনে হচ্ছে। একটি লোক আমাকে সালাম দেয়, তাকে আমি চিনতে পারি না; লোকটি অবাক হয়ে সরে পড়ে। আমি রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে হাঁটতে থাকি। আমি। দেখতে পাই অনন্যা হাতের ঘড়ি দেখতে দেখতে একটি রিকশায় চলে গেলো, আমি তাকে ডাকতে চেষ্টা করি, আমার গলা থেকে কোনো শব্দ বেরোয় না।