অনন্যা চমকে পা সরিয়ে নিয়ে বলে, কী করছেন, কী করছেন?
আমি বলি, ঘাসগুলো সোনালি হয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছিলো।
অনন্যা বলে, আপনি কি মাঝেমাঝে হেলুসিনেশন দেখেন?
আমি বলি, আগে কখনো দেখি নি।
অনন্যা বলে, কখন থেকে দেখছেন?
আমি বলি, আজ থেকে, সম্ভবত আজ থেকে।
অনন্যা হেসে বলে, আমার সাথে দেখা হলে প্রত্যেকেরই একটি নতুন রোগ দেখা দেয়, আমার খুব কষ্ট লাগে।
আমি বলি, আমার রোগ দেখা দেয় নি।
অনন্যা বলে, তাহলে কী?
আমি বলি, আমার রোগ সেরে যাচ্ছে।
আমি অনন্যার বা পায়ের পাতাটি আমার ডান হাতের সবগুলো আঙুল দিয়ে স্পর্শ করি; অনন্যা বলে, এ কী করছেন; কিন্তু আমি তার পায়ের পাতায় আঙুল বোলাতে থাকি। আমি একটি কবুতরের পিঠে হাত রেখেছি মনে হয় আমার; আমি তার মুখের দিকে তাকানোর সাহস করি নি, আমি জানি না সে কীভাবে তখন পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে ছিলো, তার পায়ে চুমো খাওয়ার সাধ হয় আমার, আমি তার পায়ের পাতায় চুমো খাই; তার দিকে তাকাই। আমি দেখি সে চোখ খুলে ঘুমিয়ে আছে।
অনন্যা বলে, আমার কাছে মৃত্যুর মতো সুখকর মনে হলো।
আমি বলি, আমার কাছে জন্মলাভের মতো।
অনন্যা হেসে বলে, আমার ইচ্ছে হচ্ছে কাঁঠালগাছটিকে একটি বর দিই, কিন্তু বর দেয়ার শক্তি আমাদের নেই।
আমি বলি, তুমি শুধু একবার গাছটিকে ছুঁয়ে যেয়ো, তাহলে এটি চিরকাল বেঁচে থাকবে।
অনন্যা হাসতে থাকে, আমি দেখি গাছটি আরো সবুজ হয়ে উঠছে।
দু-তিনটি লোক আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেলো; খুব শান্ত নিরীহ গ্রামের মানুষ, মাছ ধরে বা খেত চষে ফিরছে।
অনন্যা বলে, এই লোকগুলো কী ভাবছে জানেন?
আমি বলি, ওরা বোধ হয় ভাবতে জানে না।
অনন্যা বলে, খুব জানে; ওরা ভাবছে আপনাকে খুন করে আমাকে যদি জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া যেতো!
সন্ধ্যায় আমাকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে অনন্যা চলে যায়। আমিই নামিয়ে দিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে উল্টোপথে ফিরতে হবে, তাই সে রাজি হয় নি। আমাকেই সে নামিয়ে দিয়ে যায়। দালানটিকে আমার একটি দশতলা মাণিক্যের খণ্ড মনে হয়। একবার অর্চিকে মনে পড়ে। আমার ঘরে গিয়ে টেবিলে একটি কাগজের। টুকরো পাই;–স্যার, আপনার জন্যে বসে থেকে থেকে ছটায় বাসায় যাচ্ছি, আপনার জন্যে কেমন লাগছে,-আমার সহকারিণী মেয়েটি বোধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, পড়ে মায়া লাগলো ওর জন্যে। ওকে কি টেলিফোন করে জানাবো আমি ফিরেছি? থাক, ওর আরেকটুকু কেমন লাগুক, কেমন লাগার সময়ের মতো সুখের সময় আর হয় না; ও। আরেকটুকু সময় সুখে থাকুক। কাগজের টুকরোটি আমি ড্রয়ারে রেখে দিই। ফিরে। গিয়ে অনন্যার টেলিফোন করার কথা। অর্চিকে কি একবার টেলিফোন করবো? থাক। এমন সময় টেলিফোন বেজে ওঠে।
টেলিফোনে অনন্যা নয়, দেবী কথা বলছেন, আপনাকে দুপুর থেকে খুঁজছি, টেলিফোন করে করে পাগল হয়ে যাচ্ছি।
আমি বলি, হারিয়ে গিয়েছিলাম।
দেবী বলেন, কিন্তু আপনাকে আমার ভীষণ দরকার, এখনি দরকার; ধার চাই না, এখনি আপনাকে চাই।
আমি বলি, কোনো দুর্ঘটনা?
দেবী বলেন, অনেকের জন্যে।
কিন্তু অনন্যার টেলিফোন? আমি তার স্বর শুনতে চাই, তার স্বর দেখতে চাই, আরেকটুকু সেরে উঠতে চাই। টেলিফোন করে আমাকে না পেলে সে কি ভয় পাবে না? সে তো সব কিছুতেই ভয় পায়। ভাববে না আমি লিফটে আটকে গেছি, আমার লিফট, উঠছে আর নামছে, আমি চিৎকার করছি; কেউ শুনতে পাচ্ছে না? আমি বেরিয়ে পড়ি, দেবী আমাকে ডেকেছেন, ধার চাইছেন না, অনেকের জন্যে দুর্ঘটনা, আমি বেরিয়ে পড়ি। দেবীর বাসায় গিয়ে আমি অবাক হই। সরাসরি আমাকে তার শয্যাকক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়, আগে যা কখনো হয় নি। দেবী ভয়ঙ্কর সাজে সেজেছেন, মনেই হচ্ছে না তাঁর বয়স আটচল্লিশ, তাঁকে তনী দেবীই মনে হচ্ছে। তার পাশে এক স্বাস্থ্যবান যুবক বসে আছে। দেবী আমাকে দেখে দেবীর মতো হাসেন।
এ হচ্ছে শমশেদ মোল্লা, দেবী যুবকটির সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, জমশেদ মোল্লা সাহেবের পুত্র; আজ আমরা বিয়ে করছি।
জমশেদ মোল্লা সাহেব কোথায়? একটু চমকে একটু দুঃখ পেয়ে একটু বিবেচকের মতো আমি বলি।
তিনি সিঙ্গাপুর আছেন, দেবী বলেন, তাঁকে দরকার নেই। আপনাকে ডেকেছি আপনি সাক্ষী হবেন।
জমশেদ মোল্লা সাহেব, আমি বলি, ফিরে এসে গোলমাল করবেন না তো?
শমশেদ মোল্লা বলে, বাবারে আমি তাইলে ছিডুড়া ফালামু না? ভয় পাইয়েন না, বাবায় আমারে যমের মতন ডরায়।
যুবক খুবই বলিষ্ঠ, পিতার থেকেও, আমার সামনেই দেবীকে জড়িয়ে ধরে, দেবীর হাড় ভাঙার শব্দ যেনো আমি শুনতে পাই; দেবী তার বাহুর ভেতরে প্রজাপতির মতো পড়ে থাকে। কোনো ডানা ভেঙে গেছে কি না আমি বুঝতে পারি না; কিন্তু আমার অত্যন্ত সুন্দর লাগে ওই দৃশ্য। আবর্জনার ওপর চন্দ্রমল্লিকা পড়ে আছে দেখতে আমার। খুব ভালো লাগে। দেবীকে সে বাহু থেকে মুক্তি দেয় না, দেবী তার বাহুর ভেতর ভাঙতে থাকে; শমশেদ মোল্লা দেবীর গালে একটি কামড় দেয়ার চেষ্টা করে। কামড়টি দিতে। পারলে দেবীর গাল থেকে একশো গ্রাম মাংস উঠে আসতো। শমশেদ মোল্লা খুব উত্তেজিত, আজ রাতেই দেবীকে পাঁচ-সাতবার গর্ভবতী করে ছাড়বে।
এখন ছাড়ো, দেবী বলেন, অনেক সময় পাবে কামড় দেয়ার।
শমশেদ মোল্লা দেবীকে মুক্তি দেয়; দেবী আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, শমশেদ একটু জংলি, ওর জংলামোই আমার ভালো লাগে। দেখতে ইচ্ছে হয় গণ্ডারের নিচে কেমন লাগে।