আমরা এখন কী করবো? আমি বলি।
অনন্যা বলে, আপনার কাঁঠালগাছটিকে দেখতে যাবো ভাবছি, কাঁঠালগাছটিকে আমি ভুলতে পারছি না।
আমি বলি, ওটা অসম্ভব কিছু নয়।
অনন্যা বলে, কিন্তু ওর ছায়ায় আমার বসতে ইচ্ছে করছে।
আমি গাড়ি নিই নি, গাড়ি নিয়ে ওর কলেজের গেইটে যেতে আমার খারাপ লাগছিলো, আমি নিঃস্ব হয়ে ওর কলেজের গেইটে যেতে চেয়েছিলাম। আমরা একটি বেবিট্যাক্সি নিই; বহু বছর পর যেনো আমি বেবিতে চড়ছি, গতকালও চড়েছিলাম তা আমার মনে পড়ছে না। অনন্যা আমার পাশে আমি ভাবতে পারছি না, বেবিটাকে আমার ডানামেলা পাখি বলে মনে হয়। ওর শাড়ির একটি পাড় উড়ে এসে আমার নাকে লাগে। অনন্যা ব্যাগ থেকে দুটি গোলাপ বের করে গোলাপ দুটির দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।
অনন্যা বলে, গোলাপ দুটি এখন আমি ছুঁড়ে ফেলে দেবো, ফেলতে আমার একটু কষ্ট হবে।
আমি বলি, ছুঁড়ে ফেলে দেবে কেনো? কষ্টই পাবে কেনো?
অনন্যা বলে, উচ্চমাধ্যমিকের একটি ছাত্র প্রতিদিন আমাকে দুটি করে গোলাপ দেয়, বাসায় ফেরার সময় প্রতিদিন ছুঁড়ে ফেলে দিই।
আমি বলি, তাহলে নাও কেনো?
অনন্যা বলে, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট হয়, না করতে পারি না।
আমি বলি, আপার গভীর প্রেমে পড়েছে বালকটি।
অনন্যা বলে, আমি যখন কলেজে ঢুকি তখন সে দূর থেকে দেখে আমাকে, যখন বেরোই তখন দূর থেকে দেখে আমাকে।
আমি বলি, আজ তাহলে সে বাসায় ফিরে আত্মহত্যা করবে।
অনন্যা বলে, করতে পারে।
আমি বলি, কেমন দেখতে ওই বালক প্রেমিক?
অনন্যা বলে, বয়স বেশি হবে না, কিন্তু বেশ বড়োসড়ো, ওর পাশে আমাকে ওর বান্ধবীই মনে হবে। ক্লাশে আমার দিকে তাকাতে গিয়ে বারবার কেঁপে ওঠে।
আমি বলি, নিষ্পাপ প্রেম!
অনন্যা বলে, কিছুই নিষ্পাপ নয়।
আমি বলি, তুমি কি বোঝো ওই বালক তোমাকে মনে মনে ভোগ করে?
অনন্যা বলে, আমি খুব বুঝি। ঘুমোনোর আগে সে যে আমাকে ভেবে ভেবে। নিজেকে মন্থন করে, তা আমি বুঝি।
আমি বলি, সে হয়তো স্বপ্ন দেখে একদিন তুমি তার কাছে গিয়ে বলছে, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না, তাকে জড়িয়ে ধরছো, সে তোমাকে জড়িয়ে ধরছে, দুজন মিলিত হচ্ছে।
অনন্যা বলে, তা আমি জানি। তবে ও-ই শুধু নয়।
আমি বলি, আর কে?
অনন্যা বলে, বুড়ো প্রিন্সিপালটিও। সে নিজেকে জেসাস ক্রাইস্ট মনে করে।
আমি বলি, অধ্যাপনা তো একরকম আত্মোৎসর্গই!
অনন্যা বলে, সে ওসব জানতোই না। আমি তাকে একদিন বলি কাউকে না কাউকে তো কাঁটার মুকুট পরতেই হয়। সে বলে, কী বললেন? আমি আবার বলি কাউকে না কাউকে তো কাটার মুকুট পরতেই হয়। তখন থেকে সে মনে করে আসছে সে-ই কাঁটার মুকুট পরেছে।
আমি বলি, প্রতিটি বদমাশের ভেতরেও একটি করে জেসাস ক্রাইস্ট রয়েছে।
অনন্যা বলে, কিন্তু ওই বুড়ো জেসাস এখন প্রত্যেক দিনই আমাকে ডেকে নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, বলে, আমি আর আপনে দুইজনই কাঁটার মুকুট পরছি। সেও স্ত্রীসহবাসের সময় স্বপ্ন দেখে।
কখন যে আমরা ওই কাঁঠালগাছটিকে পেরিয়ে গেছি, খেয়াল করি নি; খেয়াল করলেও আমি চিনতে পারতাম না। আমি এক সময় বেবিঅলাকে থামতে বলি, বেবি থেকে নেমে সবুজ ঘাস আর কাঁঠালবনের দিকে আমরা হাঁটতে থাকি। অনন্যা হাঁটতে থাকে আগে আগে, এটাই আমার ভালো লাগে; মেয়েদের আগে আগে হাঁটতে আমার ভালো লাগে না। আমি হঠাৎ দেখতে পাই অনন্যার স্যান্ডলের নিচে মাটির আর ইটের টুকরো ঝিলিক দিয়ে উঠছে। একেকটি মাটির টুকরোকে ইটের টুকরোকে আমার। মাণিক্য বলে মনে হচ্ছে। আমি একটি টুকরো হাতে তুলে নিই, হাতে তুলে নেয়ার সাথে সাথে তা আবার মাটিতে পরিণত হয়, আবার ইটে পরিণত হয়; কিন্তু অনন্যা। যেখানেই পা রাখে সেখানেই আমি মাণিক্যের দ্যুতি দেখতে পাই। আমি দুটি টুকরো। আমার বুকপকেটে রাখি।
অনন্যা পেছনে ফিরে জিজ্ঞেস করে, আপনি মাঝেমাঝে কী তুলছেন?
আমি বলি, মাণিক্য।
অনন্যা বলে, দেখি।
আমি টুকরোটি তার হাতে তুলে দিই, সে হেসে উঠে বলে, এ তো মাটির টুকরো।
আমি বলি, একটু আগেই এটি মাণিক্যের টুকরো ছিলো।
অনন্যা অদ্ভুতভাবে হাসে আমার দিকে চেয়ে।
রাস্তার বাঁ পাশেই একটি কাঁটাগাছ দাঁড়িয়ে ছিলো, একটু দূর থেকে আমি ওর। কাঁটাগুলো দেখেছি, একটিও পাতা নেই, কাঁটাতারের মতো কাঁটায় আবৃত গাছটি; এখন অনন্যার শাড়ির আঁচল উড়ে গিয়ে ওই কাটার ওপর পড়েছে, আমি দেখতে পাচ্ছি। সেখানে লাল লাল ফুল ফুটে উঠছে। আমি হাত বাড়িয়ে ফুল কুড়োতে যাই।
অনন্যা চিৎকার করে ওঠে, করছেন কী, করছেন কী, কাঁটায় আপনার হাত ছিঁড়ে যাবে।
আমি বলি, কাটা কোথায়, লাল লাল ফুল।
অনন্যা বলে, গাছে নয়, অন্য কোথাও।
আমরা একটি কাঁঠালগাছের ছায়ায় বসি; সবুজ রত্নের মতো ছায়া ঝরে পড়ছে। অনন্যার মুখে, আমার চুলে, অনন্যার শাড়িতে, আমার মুঠোতে। অনন্যা স্যান্ডল খুলে পা দুটি একটু সামনের দিকে বাড়িয়ে বসেছে, গম্বুজের মতো হাঁটুর ওপর রেখেছে হাত দুটি, আমি তার পাঁচটি সোনালি আঙুল দেখতে পাচ্ছি। তার আঙুল থেকে কী ঝরছে? জ্যোৎস্না? এখন রাত হলে ঘাসের ওপর আলো পড়তো, আলো দেখা যেতো; এখন আলো দেখা যাচ্ছে না, তবে আলোতে ঘাসগুলো আরো সবুজ হয়ে উঠছে। অনন্যার পায়ের পাতার নিচের ঘাসগুলো সোনালি হয়ে উঠছে মনে হচ্ছে, এমন সোনালি ঘাস আমি কখনো দেখি নি; আমি একবার হাত বাড়িয়ে তার পায়ের নিচ থেকে একগুচ্ছ ঘাস। তুলে আনি।