আম্মু আজ রাতে ফিরবে না, খাবার টেবিলে অর্চি বলে; আমি অবাক হই অর্চি আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে বলে; তার আম্মু ফিরবে না, তাতে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না, জানতেও ইচ্ছে করে না কেনো ফিরবে না, সে বোধ হয় আমার জীবনে আর উদ্দীপকরূপে কাজ করে না।
নানুর বাসায় থাকবে, অর্চি অতিরিক্ত ও প্রয়োজনীয় সংবাদটুকু দেয়।
আমি বলি, তুমি তো আগেই খেয়ে নিতে পারতে।
অর্চি বলে, আজ তোমার সাথে খেতে ইচ্ছে হলো, কতো দিন খাই না।
আমি বলি, কেননা এমন ইচ্ছে হলো তোমার?
অর্চি বলে, আমি স্টেটসে চলে যাবো যে। আমি একটু চমকে উঠি।
আমি বলি, সব কাগজপত্র পেয়ে গেছো?
অর্চি বলে, সব পেয়ে গেছি, আমরা তিন বান্ধবী এক সাথে যাবো।
আমি বলি, কবে যাবে?
অর্চি বলে, মাত্র সাত দিন সময় দিয়েছে, এর মাঝেই সব কিছু শেষ করতে হবে-ভিসা, টিকেট।
আমি বলি, ঠিক আছে, দু-তিন দিনের মধ্যেই করে দেবো।
অর্চি বলে, আমি যাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে আছি।
আমি বলি, কেননা এতো পাগল হয়ে আছো?
অর্চি বলে, দেশে আমার একদম ভালো লাগছে না।
আমি বলি, পড়া শেষ করে দেশে ফিরবে তো?
অর্চি বলে, না, আমি আমেরিকান হতে চাই; সেখানেই থাকতে চাই। আমার বান্ধবীরাও ফিরবে না।
আমি বলি, তোমার আম্মুকে বলেছে?
অর্চি বলে, না, তোমাকেই আগে বললাম।
অর্চি চলে যাবে, আমার একটু কষ্ট লাগছে; ওকে মাঝেমাঝে দেখতে পাই, সাত। দিন পর পাবো না, ওর ঘরে তখন যখন ইচ্ছে যেতে পারবো, ও রেগে উঠবে না, বলবে না, আমাকে ডিস্টার্ব কোরো না। ওর মুখটি আমি মনে করতে পারবো না; শুধু ওর। ঝাঁকড়া চুলগুলোর কথা মনে পড়বে, ওর কণ্ঠস্বর বাজবে, হঠাৎ হয়তো গাড়ির হর্ন শুনে মনে হবে অর্চির কণ্ঠ শুনছি। এ-ঘরে ফিরোজা ছিলো, সে আজ রাতে ফিরবে না, মায়ের কাছে থাকবে; হয়তো নৃতাত্ত্বিকটির সাথে থাকবে, হয়তো সারারাত থাকবে না, নৃতাত্ত্বিকটি তাকে মাঝরাতে নামিয়ে দিয়ে যাবে। ফিরোজা কি এখন নৃতাত্ত্বিকের সাথে শয্যায়? ঘরটি বেশ শূন্য লাগছে, এমন শূন্য আর কখনো লাগে নি। ফিরোজা হয়তো কাল ফিরে আসবে, পরে হয়তো আর ফিরবে না। শূন্যতা থাকবে আমার জন্যে, অসীম শূন্যতা, সহ্য করতে হবে আমাকে। কিন্তু ফিরোজার জন্যে আমার কষ্ট লাগছে না, অর্চির জন্যে লাগছে, অর্চিকে আরেকবার আমার দেখতে ইচ্ছে করছে। একবার কি। অর্চির ঘরে গিয়ে অর্চিকে দেখে আসবো? অর্চি কি বিরক্ত হবে? অর্চি কি ভাববে আমি কাঁদছি? অর্চি কি আমাকে করুণা করবে? না, অর্চিকে এখন আমি দেখতে যেতে পারি না, অর্চি আমাকে দেখে কষ্ট পাবে।
অনন্যা ফোন করে বলে, জানেন, এখন পর্যন্ত আমার মাথা ঘোরাচ্ছে।
আমি বলি, তোমার বোধ হয় হাই-সিকনেস লি-সিকনেস আর ক্লসট্রোফোবিয়া রয়েছে।
অনন্যা বলে, কোন রোগ যে আমার নেই, তাই ভাবি; আমি বেশি দিন বাঁচবো না। বেশি দিন না বাঁচতে আমার খুব ভালো লাগবে।
আমি বলি, সুন্দরের আয়ু সব সময়ই কম, সকাল থেকে দুপুর।
অনন্যা বলে, আমি তো সুন্দর নই।
আমি বলি, তুমি তা জানো না, তোমার চারপাশ জানে।
অনন্যা বলে, চারপাশ তাহলে অন্ধ।
আমি বলি, গতকাল তুমি কলেজ থেকে বেরোনোর সময় যদি দেখতে আমি গেইটে দাঁড়িয়ে আছি, তোমার কেমন লাগতো?
অনন্যা বলে, আমি একটুখানি পাগল হয়ে যেতাম, একটুখানি পিছলে পড়তাম, একটুখানি অন্ধ হয়ে যেতাম। তবে একটি কথা কী জানেন?
আমি বলি, না তো।
অনন্যা বলে, গতকাল আমার বারবার মনে হচ্ছিলো আপনাকে যদি বোরোনোর সময় দেখতে পাই, যদি আপনাকে বরোনোর সময় দেখতে পাই, আপনাকে কলেজ থেকে বেরোনোর সময় দেখতে পাই যদি!
আমি বলি, এমন মনে হচ্ছিলো কেনো?
অনন্যা বলে, মাঝেমাঝে আমার অসম্ভবকে পেতে আর দেখতে ইচ্ছে করে।
আমি বলি, আমি অসম্ভব নই।
অনন্যা বলে, অসম্ভব ছাড়া আমার কিছুই ভালো লাগে না। যা আমার ভালো লাগে, তাই অসম্ভব; আপনাকে আমার ভালো লাগে, তাই আপনি অসম্ভব।
আমি বলি, খুব ভালো লাগছে শুনতে।
অনন্যা বলে, আমি অসম্ভবকে ঘিরে ঘুরতে ভালোবাসি। গতকাল কলেজ থেকে ফেরার সময় আমি চারবার রিকশা নিয়ে আপনার অফিসের চারদিকে ঘুরেছি, কী যে ভালো লেগেছে।
আমি বলি, আমি তখন সাভারে একটি কাঁঠালগাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে ছিলাম।
অনন্যা বলে, অসম্ভব!
আমি বলি, সত্য।
অনন্যা বলে, তাহলে আপনি বোধ হয় আমার থেকেও বেশি অসম্ভবকে পেতে চান।
আমি বলি, আমি কিছু পেতে চাই না।
অনন্যা বলে, আপনি বোধ হয় অনেক পেয়েছেন।
আমি বলি, তোমার কলেজ কখন শেষ হয়?
অনন্যা বলে, দুটোয়।
আমি বলি, তুমি আজ কলেজের গেইটে এক ক্ষুদ্র অসম্ভবকে দেখতে পাবে।
অনন্যা বলে, আমার সুখের শেষ থাকবে না।
আমি কলেজের গেইটে গিয়ে দাঁড়াই, পাঁচ মিনিটকে আমার পাঁচবার মহাজগত ধ্বংস আর সৃষ্টির সমান দীর্ঘ বলে মনে হয় আমার মুজো ঘেমে ওঠে, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না বলে হয়; একটি ছেলে আমার কাছে দেশলাই চায়,–পাঁচ-সাত বছরেই সে হয়তো একটা দুর্দান্ত মাননীয় মন্ত্রী হবে,-আমি দেশলাই বের করে তার সিগারেট ধরিয়ে দিই, সিগারেট চাইলেও পকেট থেকে সিগারেট বের করে দিতাম। ছেলেটির মুখ থেকে ধুয়ো এসে আমার মুখে লাগে। অনন্যা বেরিয়ে আসছে দেখতে পাই, আমি একটু কেঁপে উঠি, কিন্তু অনন্যা এমনভাবে আসে যেনো সে চারদিকের কিছুই দেখছে না, শুধু আমাকে দেখছে, দেখে দেখে সুস্থ হয়ে উঠছে। আমরা একটু। হাঁটি, হাঁটতে হাঁটতে একটু দাঁড়াই, আমাদের ঘিরে শুধু রিকশা আর বেবিট্যাক্সি জটলা পাকাতে থাকে।