মাহমুদা রহমান চিৎকার করে বললেন, দেখুন, এই লোচ্চা সৌদি থেকে কী করে এসেছে।
হাফিজুর রহমান সব সময়ই গম্ভীর প্রকৌশলী, তার ভেতরটা মুখে প্রকাশ পায় না; মাহমুদা রহমানের অভিধায় তার ভেতরে কী ঘটলো বুঝতে পারলাম না। মাহমুদা রহমান বারান্দা থেকে টেনে কলাপাতার মতো একটি বালিকাকে আমার সামনে ছুঁড়ে দিলেন। বালিকা মেঝেতে পড়ে গেলো, তারপর উঠে একপাশে বসলো, ঘোমটা দিতে চেষ্টা করলো, তার গাল থেকে একটি মারাত্মক ঝিলিক এসে আমার চোখে ঢুকলো।
আমি বললাম, মেয়েটি কে?
মাহমুদা রহমান বললেন, কে আর, এই লোচ্চার দুই নম্বর বউ, আমার সতিন। লোচ্চাটাকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো।
আমি বলি, কখন বিয়ে করলেন?
মাহমুদা রহমান বললেন, বিয়ে এখনো করেন নি, করার পরের কাজটি করে। এসেছেন, পেট বানিয়ে নিয়ে এসেছেন। এখন আমার কাজ দুজনকে সোহাগে নিয়ে বিয়ে পড়িয়ে আনা।
আমি কিছু বুঝে উঠতে পারি না। সৌদিতে হাফিজুর রহমান কোথায় পেলেন এ-কলাপাতাটিকে? মাহমুদা রহমান চিৎকার করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে সম্পূর্ণ কাহিনী বর্ণনা করলেন, যা তিনি সারা সকাল ধরে উদ্ধার করেছেন হাফিজুর রহমানকে ছিঁড়েফেড়ে। হাফিজুর রহমানের মাস আটেক আগে একবার দেশে আসার কথা ছিলো, কিন্তু আসেন নি; তাঁর কাজ বেড়ে গিয়েছিলো, তাই তিনি তখনকার ছুটি নেন নি (মাহমুদা রহমানের তাতে কোনো আপত্তি হয় নি, বরং হাফিজুর রহমান আসেন নি বলে তিনি কতোটা আনন্দিত ছিলেন, তা আমি জানি)। তখন আরব মরুভূমিতে এ-কলাপাতাটি দেখা দেয়। কলাপাতাটির একটি ভাই হাফিজুর রহমানের অধীনে ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করে, সে খুবই ভক্ত তার মনিবের। প্রভুর থাকতে খেতে খুব অসুবিধা হচ্ছিলো, একটি কাজের মেয়ের খুব দরকার হচ্ছিলো; তাই ইলেক্ট্রিশিয়ানটি হাফিজুর রহমানকে একটি পরিচারিকা এনে দেয় দেশ থেকে। সে নিজের ছোটো বোনকেই নিয়ে যায়, হাফিজুর রহমানই সমস্ত ব্যয় বহন করে; এবং হাফিজুর রহমান কলাপাতাটিকে পেয়ে কাজ বাড়িয়ে দেন, দেশে আসার সময় পান না, চিঠি লেখা কমিয়ে দেন, টেলিফোন করা তো বন্ধই করে দেন। কলাপাতাটির বয়স কতো হবে? মোলো? হাফিজুর রহমান আট মাস ধরে বেহেস্তে ছিলেন, মরুভূমিতে তার জন্যে একটি কলাপাতা সবুজ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো, আমি বুঝতে পারি যখন আমি আরেকবার কলাপাতাটির দিকে তাকাই। কলাপাতাটি কালবিলম্ব না করে গর্ভবতী হয়ে পড়ে-মরুভূমিতে হয়তো রাবার নেই, বা হাফিজুর রহমান জুতো পরে পুকুরে নামতে পছন্দ করেন না। এতো দিন চেপে ছিলেন, এখন তাকে নিয়ে তিনি দেশে ফিরেছেন, হয়তো সেখানে কলমাও পরেছেন, এখানে স্বীকার করছেন না। তিনি কলাপাতাটিকে বিয়ে করবেন, মাহমুদা রহমানকে তিনি একথা জানিয়েছেন, এবং মাহমুদা রহমান তাকে জানিয়েছেন তিনি হাফিজুর রহমানের দ্বিতীয় বিবাহে সম্মতি দেবেন না, তাকে জেলে পাঠাবেন। আমি কীভাবে উদ্ধার করবো মাহমুদা রহমানকে।
হাফিজুর রহমান জানতে চাইলেন, ঢাকায় না কি এমআর করার জন্যে এখন রাস্তায় রাস্তায় ক্লিনিক হয়েছে?
আমি বলি, আমি ঠিক জানি না।
মাহমুদা রহমান বলেন, রাস্তায় বের হও, তাহলে নিজেই খুঁজে পাবে।
এমআর কথাটি এই আমি প্রথম শুনি, এর পুরোটা কী তাও জানি না, তবে হাফিজুর রহমানের প্রশ্ন থেকে কাজটি বুঝতে পারি, উত্তরও দিই; হাফিজুর রহমান। তাতে সুড়ঙ্গের পরপারে কোনো আলো দেখতে পান না। আমি কীভাবে উদ্ধার করবো এদের? আমাকে কি বালিকাটিকে নিয়ে ক্লিনিকে ছুটতে হবে, একটা চমৎকার সহৃদয়। তলপেটের ডাক্তার খুঁজে বের করতে হবে? গিয়ে যদি বলি আমার এক বন্ধু কাজটি করে ফেলেছেন, তাকে উদ্ধার করুন; ডাক্তার কি আমার দিকে তাকিয়ে সুস্পষ্ট অর্থপূর্ণ হাসি হাসবে না? কিছু উপদেশ দেবে না, শেলফ থেকে দু-চারখানি ধর্মগ্রন্থ (আজকাল না কি এগুলোই থাকে তাদের শেলফে) বের করে পড়ে শোনাবে না? তারপর রারার ব্যবহারের উপকারিতা ব্যাখ্যা করবে না? আমার আর ভালো লাগছে না, আমার আর এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আমার বেরিয়ে পড়তে। ইচ্ছে করছে। কলাপাতাটির দিকে চোখ পড়তেই আবার একটি ঝিলিক অনুভব করি, হাফিজুর রহমান একে হারাতে চাইবেন না; কিন্তু তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখন তিনি এটিকে হারাতে প্রস্তুত। আমি মেয়েটির মুখের দিকে আবার তাকাই, তার মুখে এবার আমি মৃত্যুর উজ্জ্বল উদ্ধারের ছায়া দেখতে পাই। আমি কাউকে উদ্ধার করতে পারবো না, নিজেকেও না, আমি বেরিয়ে পড়ি। ড্রাইভারকে বিদায় করে দিয়ে আমি পথে হাঁটতে থাকি। অনন্যার কলেজ কতো দূর? এখন তার ছুটি হয়ে গেছে। আমি কি হাঁটতে হাঁটতে সেখানে গিয়ে উঠতে পারি? কতোক্ষণ লাগবে যদি আমি হাঁটতে থাকি। তাকে কি আমি সেখানে খুঁজে পাবো? গেইটে দাঁড়িয়ে থাকবো? শিক্ষকদের বসার ঘরে গিয়ে তার খোঁজ করবো? সে কি আমাকে চিনতে পারবে? এখন আমি হাঁটছি, আমাকে কেউ চিনতে পারবে না।
নিজেকে আমার অচেনা মনে হচ্ছে, শহরটাকে অচেনা মনে হচ্ছে। অনেক বছর ধরে আমি শহরটাকে উঁচু থেকে বসা থেকে কাঁচের জানালার ভেতর দিয়ে দেখে আসছি, দাঁড়িয়ে হেঁটে দেখি নি, সরাসরি দেখি নি; আমার ভালো লাগছে। কেউ আমাকে চিনতে পারছে না, আমিও চিনতে পারছি না, একটা পানের দোকান থেকে একটি মোটা লোক, চমকার ঘন পিক ছুঁড়েছে, আমার গায়ে এসে পড়তে পড়তে নিচে পড়ে গেলো, লোকটি আর আমি হাসলাম। গায়ে পড়লে কেমন লাগতো আমার ভাবতে ইচ্ছে হলো। বজ্রপাতের মতো একটা বাস এসে দাঁড়ালো আমার পাশেই, ওপরেও দাঁড়াতে পারতো, ছোট্ট ছাই দিয়ে তৈরি হেল্পারটি আমাকে ধরে টানাটানি শুরু করলো তার গেইট লক। সিটিং সার্ভিসে ওঠার জন্যে, আমি উঠে পড়লাম। পেছনের দিকে একটি সিটে বসলাম। আমি। আমি মাছের গন্ধ পাচ্ছি, আমার পাশের লোকটির গেঞ্জি থেকে সুন্দর একটা আঁশটে গন্ধ পাচ্ছি, একবার তার গেঞ্জিতে নাক লাগিয়ে শুকতে ইচ্ছে হলো আমার। বাস চলছে আর থামছে, থামছেই বেশি, আমার ভালো লাগছে। অনন্যা কি এ-বাসে উঠতে পারে? এ-বাসে উঠে তার যাওয়ার কখনো দরকার পড়ে না? আজই দরকার পড়তে পারে না? আমার মতো উঠে বসতে পারে না? সামনের দিকে যে-মেয়েটি বসে। আছে, সে কি অনন্যা? একটি লোক তার পলিথিনের ব্যাগটি আমার উরুর ওপর রেখেছে, ভেতর হয়তো আখের গুড় রয়েছে, আমি আখের গুড়ের গন্ধ পাচ্ছি, আমার ভালো লাগছে। অনেক দিন ধরে আমি আখের গুড় খাই না, আখের গুড়ের গন্ধ পাই না। বাস এখন চলছে না, একটি গে সেলুন দেখতে পাচ্ছি, গে লর্ড সেলুন? ঢাকায় গেদের জন্যে নিজস্ব সেলুনও রয়েছে? নাপিতগুলোকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার, ওদের ঠোঁটে লিপস্টিক আছে কি না, ওরা বক্ষবন্ধনি পরে কি না দেখতে ইচ্ছে করছে। বাস বোধ হয় আর চলবে না, এখানেই থেমে থাকবে। আমি কি নেমে যাবো? এবার বাস চলতে শুরু করেছে। ব্রিজ, এ-ব্রিজটা একদিন ভেঙে পড়বে, ভেতরে ভেতরে এর ভাঙার কাজ চলছে, আজই ভেঙে পড়বে না, ভেঙে পড়বে, শব্দ শুনছি। বাস কি এখন ঝাঁপিয়ে পড়বে ডানের পানিতে বাঁয়ের পানিতে? যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে আমার লাশ পাওয়া যাবে। কেউ বুঝতে পারবে না আমি কোথায় যাচ্ছিলাম। আমি একটি রহস্য হয়ে উঠবো। ড্রাইভার বলবে স্যার তাকে মাহমুদা রহমানের বাসা থেকে বিদায় দেয়, তারপর আর কিছু সে জানে না। আমার লিমিটেড একটা প্রকল্প নেবে আমি কোথায়। যাচ্ছিলাম বের করার জন্যে। ফিরোজা ভাববে গ্রামে আমার একটি উপপত্নী আছে, তার বাড়িতেই যাচ্ছিলাম। অনন্যা কী ভাববে? মাহমুদা রহমান? দেবী? সাংবাদিকগুলো? তারা কোনোদিন জানবে না আমি কোথায় যাচ্ছিলাম, আমি নিজেও জানি না। আমার ওপাশের সিটে দুটি মেয়ে, ওরা বোধ হয় দেহ বিক্রি করে, সিগারেট টানছে, ওদের কর্কশ ধুয়োর গন্ধ পাচ্ছি, বেশ লাগছে; ওরা গালি না দিয়ে কথা বলছে না, বেশ লাগছে আমার। বাস এবার থামলো, ছাদের ওপর থেকে জেলেভাইদের চাঙারি পড়ে গেছে, তুলতে হবে। এবার একটা ব্রিজ, বেশি দিন টিকবে না, নিচে নদী, খালের মতো। কী নাম? মেঘবতী? মেঘেশ্বরী? সামনের চাকা খুলে বাস এবার হুমড়ি খেয়ে পড়লো একটা গাছের গায়ে। খালে পড়ে যেতে পারতো, পড়ে নি, আমি নিচে নেমে আসি।
হাঁটতে ইচ্ছে করছে আমার
হাঁটতে ইচ্ছে করছে আমার, খালি পায়ে হাঁটতে ইচ্ছে করছে; জুতো খুলে লাল মাটি আর ঘাসের ওপর দিয়ে আমি হাঁটতে থাকি, জুতো জোড়া আর বইতে ইচ্ছে করছে না, রাস্তার পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিই। অনেক বছর আমার পায়ের নিচে ঘাস পড়ে নি, মাটি পড়ে নি, এখন আমার পায়ের নিচে ঘাস, আমার পায়ের নিচে মাটি; আমার ভালো লাগছে। কাঁঠালগাছগুলো সবুজ হতে হতে কালো হয়ে উঠেছে, কলাপাতাটিকে আমার মনে পড়ছে, মৃত্যুর সুন্দর মুখ মনে পড়ছে, সব কিছু ভালো লাগছে। আমি একটি কাঁঠালগাছের নিচে বসি, গাছটিকে ঘিরে সবুজ ছায়া, গাছের ছায়ার বাইরে পানীয়ের মতো সুন্দর রৌদ্রের আগুন। আমি একবার এমন ছায়ায় এমন আগুনে নিজের ভেতর থেকে সুখ বের করেছিলাম, আমি সেই সুখ অনুভব করছি। আমি ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ি, আমার ঘুম পাচ্ছে। একটি হলদে কাঁঠালপাতা ঝরে পড়লো আমার মুখের ওপর, আমি হাতে নিয়ে দেখি পাতাটিকে, রওশনের হাতের তালুর মতো পাতাটি, মেহেদিপরা হাতের মতো। অনন্যার হাত কেমন? আমি এখন কোথায়, কেউ জানে না, আমি জানি না। আমার ঘুম পাচ্ছে, রওশনের মতো ঘুম, অনন্যার মতো ঘুম, কাঁঠালপাতার মতো ঘুম, কলাপাতার মতো ঘুম। আমি ঘুমিয়ে পড়ি, বহুদিন আমি ঘুমোই নি। যখন ঘুম। ভাঙে আমার মনে হয় ভোর হলো, মা এখনি আমাকে ইস্কুলে যাওয়ার জন্যে ডাকাডাকি করবে; কিন্তু এখন ভোর হলো কি না আমি কার কাছে জিজ্ঞেস করবো? ভোর কি হলো, না সন্ধ্যা হচ্ছে। একটু পরেই আমি বুঝতে পারি সন্ধ্যা হচ্ছে, ভোর হচ্ছে না। আমার পায়ে জুতো নেই, আমি কী করে ফিরবো শহরে? বাসে উঠতে ইচ্ছে করছে না, আমার, কিন্তু মনে পড়ছে বাসে করে আসতে আমার ভালো লাগছিলো, মাছের গন্ধ। পাই আমি, আমার বমি আসে। আমি বাসে উঠতে পারবো না। আমি একটি বেবিট্যাক্সি নিই, শহরে এসে একটি জুতোর দোকানে ঢুকি, আমার অফিসে যাই।