কয়েক দিন ধরে ভোরে ঘুম ভাঙছে আমার, ভোর হওয়ার অনেক আগেই চোখের ওপর একটা স্বপ্নের মতো কী যেনো টের পাচ্ছি, খুব হাল্কা লাগছে, অনেকক্ষণ ধরে। একটা সুখের মধ্যে পড়ে থাকছি। পাশের বিছানায় ফিরোজার কেমন লাগছে, আমি জানি না; সেও তার বিভোরতার মধ্যে থাকতে পারে, সেটা তার ব্যক্তিগত; আমার ব্যক্তিগত বোধ এক হাল্কা আচ্ছন্নতার। রওশনের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার সময় এমন হয়েছিলো, এখন তেমনি হচ্ছে, মাঝেমাঝে মনে রাখতে পারছি না আমি কোথায় শুয়ে আছি, ঢাকা শহরে না গ্রামে, আমার বয়স কতত, পনেরো না পঁয়তাল্লিশ, আমি মনে রাখতে পারছি না; বেশ কিছুটা সময় ভাবার পর আমি আমার বাস্তবতা স্থির করতে পারছি। হয়তো শরীরের বয়স বাড়ে, মনের বয়স বাড়ে না, অন্তত ভোরগুলোতে আমার তা-ই মনে হচ্ছে। বেশ একটা ভার আমি বোধ করছিলাম কয়েক মাস ধরে, ওই ভারটা কেটে গেছে; ফিরোজার সাথে আমার ভারী সম্পর্কটির কথাও মনে থাকছে না। আমি আরো সজীব হয়ে উঠছি, নতুন মাটিতে একটি নতুন কলাগাছের চারা মনে হচ্ছে নিজেকে। আমি এতো দিন বুঝতে পারি নি যে আমি বয়স্কদের দলে পড়ে গেছি, আমি যাদের সাথে জীবন যাপন করছি, ঘুমোচ্ছ, তাঁদের চমৎকার শরীর আর মুখাবয়ব থাকলেও তাঁরা বয়স্ক; তাঁদের জগত ভিন্ন তরুণ জগত থেকে। আমার গাড়ির সামনেই ঘটনাটি ঘটে, তরুণীটির রিকশা উল্টে পড়ে বেবিট্যাক্সির ধাক্কায়; তরুণীটি নিচে পড়ে যায়, তার ভাগ্য ভালো পেছনের গাড়িগুলো থামে, কিন্তু কেউ তাকে টেনে তোলার সাহস করে না; মৃত্যুর থেকে নৈতিকতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে সম্ভবত মনে হয় তাদের। আমি লাফিয়ে নামি গাড়ি থেকে, রিকশা সরিয়ে তরুণীটিকে দু-হাতে জড়িয়ে দাঁড় করাই; একটু ভয় ছিলো আমার স্পর্শে তার সতীত্ব ছিঁড়ে যাওয়ার ভয়ে সে ক্ষেপে উঠতে পারে, কিন্তু সে ক্ষেপে না, ভয় পেয়ে আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে; আমি তার শক্ত জড়ানোর কোমলতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই। আমি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাই, সে হাসপাতালে যেতে চায় না; তার বেশি কিছু হয় নি, সে বাড়ি যেতে চায়। গাড়িতে উঠে সে আমার থেকে একটু দূরে সরে বসে, কিন্তু আমার মনে হতে থাকে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। তাকে আমার ভালো লাগে;–সে সুন্দর, সজীব, তরুণ, সপ্রতিভ; এবং ভেতরে তার একটি সুন্দর শরীর রয়েছে।
আমার নাম অনন্যা, অনন্যা আহমেদ, সে বলে, আপনাকে কি আমি ধন্যবাদ জানাবো?–আমি বুঝতে পারছি না।
আমি বলি, না, না, এখন ধন্যবাদের দরকার নেই; পরে কখনো জানাবেন।
সে পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের একজোড়া চোখ মেলে বলে, অদ্ভুত লাগছে আপনার কথা, অদ্ভুত লাগছে আমার।
আমি বলি, অদ্ভুত লাগছে কেনো?
সে বলে, আপনি এখন ধন্যবাদ চাচ্ছেন না, কিন্তু পরে কখনো চাচ্ছেন।
আমি বলি, সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পরই ধন্যবাদ জানানো ভালো।
সে বলে, কিন্তু আপনার সাথে আর নাও তো দেখা হতে পারে।
আমি বলি, হবে।
সে বলে, আপনি এতো নিশ্চিত কেনো?
আমি বলি, আমি কখনো কখনো সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারি।
আমার এভাবে কথা বলা উচিত হয় নি; আমি বয়স্ক মানুষ, পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি এসে গেছি, তার আব্বা আমার পরিচয় পেলে হয়তো সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়াতে, আঠারো বছর বয়সে যদি আমি সংসার শুরু করতাম তরুণী আমার কন্যাও হতে পারতো, আমার এভাবে কথা বলা ঠিক হয় নি। তাকে নামিয়ে দিয়ে এসে আমার বারবার মনে হতে থাকে আমার এভাবে কথা বলা ঠিক হয় নি; নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ দেখানো উচিত ছিলো আমার, এমনভাবে কথা বলা উচিত ছিলো যাতে গাড়ি থেকে নামার সময় সে আমাকে পা ছুঁয়ে সালাম করতো। আমি কেনো গম্ভীর হতে পারি নি, কেনো আমি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারি নি? আমার কি ইচ্ছে হচ্ছিলো ওই তরুণীর সহপাঠী হওয়ার? আমি তাকে আমার কার্ড দেয়ার পর সে প্রায় কোলাহলের মতো ঝলমল করে উঠেছিলো, বলছিলো সে বুঝতে পারছে না আমি কতো বড়ো, সব দিকেই, যদিও আমাকে দেখে তার অমন বড়ো কিছু মনে হয় নি। অনেক দিন পর আমি কোনো তরুণের পাশে অর্থাৎ তরুণীর পাশে বসেছি বলেই কি আমার অমন হয়েছে? কার। পাশে বসছি, তার একটা চাপ পড়ে আমাদের ওপর; কয়েক বছর আগে আমি একটি বুড়োর সাথে বসে ব্রিজের পর ব্রিজ পরিকল্পনা করেছি, এক দিন আমি টের পাই। বুড়োটি ব্রিজের থেকে বেশি পছন্দ করে আমার সঙ্গ, আমার সঙ্গ তাকে শীত থেকে তুলে আনে, সে আমার তাপ শোষণ করে, তখন আমি তার সঙ্গ ছেড়ে দিই। বুড়োটি তারপর আর বেশি দিন বাঁচে নি। না, আমি তরুণীর শরীরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করি নি, ওই মুহূর্তেই আমার মনে তার শরীর ভোগের কোনো পরিকল্পনা জেগে ওঠে নি; বরং উল্টোটিই ঘটে, ওই প্রথম আমি কোনো নারীর পাশে বসি, কিন্তু আমার ভেতর কেনো ক্ষুধা দেখা দেয় না। অনন্যাকে কি আমি নারী মনে করি নি, অবচেতনায় তাকে কি। আমি অর্চিই মনে করেছি, মনে করেছি সে আমার কন্যাই? তাও মনে হয় না, কোনো সম্পর্ককেই আমি জৈবিক আত্মীয়তার সম্পর্কে দেখতে পছন্দ করি না, এবং দেখি না; আমার কোনো কোনো বন্ধু একেকটি ব্রিজ বানিয়ে বলেন এটা তাঁর সন্তান, খুব সুখ পান ব্রিজকে সন্তান মনে করে, তার ঔরস কোনো বিশাল নারীর গর্ভে জন্ম দিয়েছে সন্তান, যদিও ব্রিজ আমাকে মনে করিয়ে দেয় আড়াআড়িভাবে পড়ে থাকা শিশ্ন ও যোনিকে, যাদের কখনো মিলন ঘটবে না; জৈবিকভাবে তারা জড়িয়ে পড়েন তাঁদের সৃষ্ট বস্তুর সাথে, আমি তা করি না। জৈবিক সম্পর্ক থেকে আমি অনেক দূরে সরে গেছি, বংশানুক্রম আমার কাছে মূল্যবান নয়। আমি ওই তরুণীকে নারীই মনে করেছি, কন্যা মনে করি নি, তবে তার দেহ আমার মাংসে কোনো ভোগপিপাসা জাগায় নি, যদিও তা কেউ বিশ্বাস করবে না।