হাসান ভাই সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলতো, মেয়েদের কথা না ভাবলে ভাত খেতে ইচ্ছে করে না, রাতে ঘুম হয় না।
হাসান ভাইয়ের সিগারেটের গন্ধটা আমার ভালো লাগতো। এখন আমি প্রচুর সিগারেট খাই, দামি বিদেশি সিগারেট ছাড়া খাই না, কিন্তু সিগারেটে আমি কোনো স্বাদ পাই না; যখন আমার সিগারেটে স্বাদ পেতে ইচ্ছে করে তখন আমি ভাবতে থাকি হাসান ভাই নদীর পারে বসে সিজর্স সিগারেট খাচ্ছে, আমি পাশে বসে আছি, তার সিগারেটের ধোয়ার অদ্ভুত গন্ধে আমার বুক ভরে যাচ্ছে। হাসান ভাই শেফালির গল্প করছে, নুরজাহানের গল্প করছে, বকুলের গল্প করছে, আমার রক্ত ঝিরঝির করছে। শেফালির গল্পটা তার প্রিয় ছিলো–শেফালি অর্থাৎ রবি সাহার মেয়ে শেফালি, যে হাসান ভাইয়ের সাথে পাশ করে বসে আছে, হাসান ভাই যাকে ইচ্ছে করলেই বিয়ে করতে। পারে, যে হাসান ভাইয়ের সাথে পালিয়ে যেতে চায়। শেফালিকে আমি দেখেছি, তাকে দেখতে আমারও ভালো লাগে, কার ভালো লাগে না শেফালিকে দেখতে? স্যারদেরও ভালো লাগে শেফালিকে দেখতে। হাসান ভাই শেফালির গল্প বলতে শুরু করে। শেফালি একদিন সন্ধ্যায় হাসান ভাইকে তাদের বাড়িতে যেতে বলেছে, হাসান ভাই গিয়ে দেখে বাড়িতে আর কেউ নেই-পুজো দেখার জন্যে সবাই বাজারের মন্দিরে গেছে; শেফালি হাসান ভাইয়ের জন্যে উঠোনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শেফালি চুল আঁচড়ে। বুকের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। হাসান ভাই যেতেই শেফালি তার হাত ধরে তাকে ঘরে নিয়ে যায়, হাসান ভাই বুঝতে পারে শেফালি কী চায় হাসান ভাইয়ের কাছে। হাসান ভাই শেফালিকে জড়িয়ে ধরে, শেফালির ব্লাউজ খুলে ফেলে, দুধে হাত দিয়ে দেখে মাখনের মতো নরম। আমার চোখ তখন সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গেছে, কান বধির হয়ে গেছে; হাসান ভাইয়ের কোনো কথা আমি শুনতে পাচ্ছি না। অন্ধকারের ভেতর কী। যেনো আমার চোখের সামনে ধবধব করছে, অন্ধকারের মধ্যে এক অসহ্য কোমলতা আমাকে ঢেকে ফেলছে।
হাসান ভাইকে আমার হিংসে হয়; আমি একবার শেফালিদির পেছনে পেছনে ইস্কুলে গিয়েছিলাম, মাথা নিচু করে হাঁটছিলাম, শেফালিদির ধবধবে পা মাটিতে পড়ছে আর উঠছে দেখে দেখে আমার চোখ দুধের রঙে ভরে গিয়েছিলো। শেফালিদির আর কিছু দেখার কথা ভাবার আমার সাহস হয় নি, কিন্তু হাসান ভাই সব দেখেছে, সব ছুঁয়েছে, আমার হিংসে হতে থাকে। কিন্তু তখনও মেয়ে আমার রক্তের মধ্যে ঢোকে নি; কোনো মেয়ের কথা ভাবার থেকে তখনও আমি বেশি সুখ পাই মেঘের কথা ভাবতে, যে-পাখিটি গতকাল আম গাছের ডালে এসে বসেছিলো, দুটি বড়ো হলদে ডানা। ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে উড়ে গিয়েছিলো, তার ডানার হলদে রঙের কথা ভাবতে। আমার, কোনো কষ্ট নেই, কিন্তু হাসান, ভাইয়ের খুব কষ্ট, আমি বুঝতে পারি; এবং আমার ভয় লাগতে থাকে একদিন আমারও এমন কষ্ট হবে। আমি দেখতে পাই আমাদের গ্রামের সবাই খুব কষ্টে আছে; বাবা কষ্টে আছেন, হাসান ভাই কষ্টে আছে, সিরাজের রফিকের বাবারা কষ্টে আছে, আমাদের শক্ত চাকরটি আর বুড়ো চাকরটি কষ্টে আছে। হাসান ভাইয়ের সাথে আমার আর বেরোনোর সাহস হয় না; বেরোলেই আমি হয়তো আরো। ভয়ঙ্কর কথা শুনতে পাবো, তাতে আমারও কষ্ট হবে। শেফালির কথা শোনার পর থেকে আমিও যেনো কষ্ট পেতে শুরু করেছি, সে-রাতে ঘুমোতে আমার দেরি হয়ে গিয়েছিলো।
আমি বড়ো হতে থাকি, একের পর এক ঘটনা দেখতে পাই; ওই ঘটনাগুলো আমাকে প্রস্তুত করতে থাকে। আমি বুঝতে পারি জীবন স্তরে স্তরে সাজানো, আর ওই স্তরগুলোর মধ্যে বাইরের স্তরগুলো হচ্ছে প্রথাগত সত্য, ভেতরের স্তরগুলো আরো সত্য, যা আমরা স্বীকার করতে চাই না। আমাদের বাড়ির উত্তরে গভীর জঙ্গল, অনেক বড়ো বড়ো গাছ–আম, শিমুল, নিম, তেঁতুল, গাব, নারকেল, আর লম্বা লম্বা ঘাস, তার পর ছিলো একটি মাঠ। ওই মাঠে অনেকেই গরু চরাতো, আম্বিয়াও সেখানে গরু চরাতে। মেয়েটা একেবারেই অন্য রকম ছিলো, ওর বাবার সাথে আমাদের বাড়ি কখনো দুধ কখনো চিংড়ি মাছ বেচতে আসতো। ওর বাবা ছিলো একেবারে বুড়ো, খালে চিংড়ি ধরে বেচতো, দুধও বেচতো; গরু চরানোর দায়িত্ব ছিলো আম্বিয়ার। কাউকে দেখলেই
সে ফিকফিক করে হাসতো, ঠিকমতো কথাও বলতে পারতো না। একটা ছেঁড়া কাপড় পরতো সে, তার বুক পিঠ সবই দেখা যেতো। আমার সমান বয়সই তার, আমার। বয়সের মেয়েদের বুক উঁচু হয়েছে সারা গ্রাম ভরে, তারা যত্নের সাথে বুক ঢেকে রাখছে, কিন্তু আম্বিয়ার কোনো বুক ছিলো না; তাই ঢাকার কথাও সে ভাবে নি। তার মুখটা বাঁকা। তার দিকে তাকাতেও ইচ্ছে হতো না। এক দুপুরে আমি ওই মাঠে গেছি, গিয়ে দেখি আমাদের গ্রামের কয়েকটি বড়ো বড়ো ছেলে, যাদের আমি দাদা বলি, আম্বিয়াকে কোলে করে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আম্বিয়া চিৎকার করছে না, গালি দিচ্ছে মাঝেমাঝে। তারা আম্বিয়াকে নিয়ে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, কোনো চিৎকার শুনতে পেলাম না। কিছুক্ষণ পর ওই ছেলেরা আর আম্বিয়া জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। আমি ভেবেছিলাম সে কাঁদতে থাকবে, কিন্তু। দেখি সে খলখল করে হাসছে। আমাকে দেখে বললো, তুই আইলি না ক্যান, তর। ইচ্ছা অয় না? সে খলখল করে হাসতে হাসতে তার গরুটাকে নতুন জায়গায় গোছর। দিতে দিতে বলে, কাইল তুইও আহিছ।