আমি বলি, সত্যিই কি তোমার মনে হয় আমি তোমাকে পীড়ন করতে চেয়েছিলাম?
ফিরোজা বলে, হ্যাঁ, আমি আজো ঠিক মতো হাঁটতে পারি না।
আমি বলি, আমি দুঃখিত, সচেতনভাবে আমি অমন কিছু করতে চাই নি।
ফিরোজা বলে, তাহলে অসচেতনভাবে করতে চেয়েছিলে।
আমি বলি, হয়তো তা হবে, তার জন্যেও আমি দুঃখিত।
ফিরোজা বলে, আমার ভয় হয় অসচেতনভাবে তুমি কোনো দিন আমাকে কিছু একটা করে ফেলতে পারো।
আমি বলি, তুমি কি খুন বোঝাচ্ছো?
ফিরোজা বলে, হ্যাঁ, ও রকমই কিছু একটা।
আমি বলি, আমি কি এতটা ভয়ঙ্কর মানুষ?
ফিরোজা বলে, আমার মনে হয় এরপর সাবধান হতে হবে, খুন না করলেও আমাকে তুমি বিকলাঙ্গ করে দিতে পারো।
আমি বলি, তুমি কি এখন বিকলাঙ্গ বোধ করছো?
ফিরোজা কোনো কথা বলে না, হয়তো সে সত্যিই বিকলাঙ্গ বোধ করছে; আমি তার কোনো খবর নিই নি, দরকার পড়ে নি, ফিরোজার হয়তো দরকার পড়েছে। ফিরোজা কি তার অঙ্গ ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে এর মাঝে, এবং ব্যর্থ হয়েছে। বিকলাঙ্গতার জন্যে কি তার দুটি তিনটি লাল লাল বিকেল অপচয় হয়ে গেছে, যার চম কার ব্যবহার তারা চেয়েছিলো? নৃতাত্ত্বিকটিকে মনে পড়ে আমার। আমি কিছুটা তাপ বোধ করি।
আমি বলি, তুমি কি পরখ করে দেখেছো কোথাও?
ফিরোজা উত্তেজিত হয়ে বলে, সবাইকে নিজের মতো মনে কোরো না।
ফিরোজা এখন নিজেকে দেবী আর আমাকে পিশাচ ভাবছে; শুধু ভাবছে না নিজেকে দেবীর সিংহাসনে বসাচ্ছে, আমাকে নামিয়ে দিচ্ছে পিশাচপাতালে; সে আমার মতো নয়, সে পবিত্র, তার শরীর পবিত্র, আমিই শুধু অপবিত্র, পিশাচের শরীর আমার। আমি কি বলবো যে ধানমণ্ডির আটনম্বর সড়কে সেদিন সন্ধ্যায় তাকে আমি দেখেছি, একটা। পাঁচতলা বাড়ির দরোজা দিয়ে তার গাড়ি বেরিয়ে এলো, আমি দেখলাম? বলবো কি আমি গাড়ির পেছনে ছুটতে পারতাম, কিন্তু আমি ছুটি নি? বলতে আমার ভালো লাগে না, কিন্তু ফিরোজা তাকিয়ে আছে আমার দিকে, আমি নিশ্ৰুপ হয়ে গেছি, আমি। পরাজিত হয়ে গেছি তার দেবীত্বের কাছে, সে তা উপভোগ করছে। কিন্তু দেবীটেবী দেখতে আমার ভালো লাগছে না।
তুমি মাঝেমাঝে ধানমণ্ডির আটনম্বর সড়কের একটি পাঁচতলা বাড়িতে যাও? আমি বলি।
ফিরোজা চমকে ওঠে, কোনো কথা বলে না।
আমি বলি, কোনো কথা বলছে না যে?
ফিরোজা বলে, যাই, কিন্তু আমি তোমার মতো নই; কাউকে দেহ দিতে আমি সেখানে যাই না।
আমি বলি, আমার মতো তুমি নও, তা জানি; আর তুমি সেখানে কাউকে দেহ দিতে যেতে না পারো, তবে কেউ তো তোমাকে দেহ দিতে পারে।
ফিরোজা কোনো কথা বলে না। ফিরোজা আমার থেকে শুদ্ধ, সব সময়ই; সে দেহ দেয় না, দেহকে সে অপূর্ব রীতিতে শুদ্ধ রাখে, পুরুষের সভ্যতা তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে; দেহ দিলেও সে অশুদ্ধ হবে না, দেহ সামান্য বস্তু, অসামান্য হচ্ছে মন হৃদয় আত্মা, সেগুলো সে দেবে না, পবিত্র রাখবে, আমার সে-শক্তি নেই, আমি পারি শুধু। অশুদ্ধ হতে। এ-মুহূর্তে আমাদের মধ্যে একটি সংঘর্ষ হয়ে যেতে পারতো, ওসব আমার ভালো লাগে না; আমি ফিরোজার দেহ নিয়ে উদ্বিগ্ন নই, দেহে আমি পবিত্রতা অপবিত্রতা কিছুই দেখি না, দেহ হচ্ছে দেহ, যা বিষাক্ত হতে পারে, মধুর হতে পারে, কঠিন হতে। পারে, গলতে পারে। দেহ আমার চোখে সুন্দর, আকর্ষণীর বস্তু, যদিও এখন ঘেন্নার বোধ জাগাচ্ছে আমার, তবু দেহের থেকে সুন্দর কিছু আমি দেখি নি। এ-দেহ শুধু মানুষের নয়, সব কিছুরই; বেড়ালের দেহের দিকে আমি সারা সকালবেলা তাকিয়ে থাকতে পারি, যেমন পারি ইঁদুরছানার দেহের দিকে তাকিয়ে থাকতে; ছেলেবেলায় আমি আমাদের শাদা গাভীটির দেহের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম, ঘুরতে ঘুরতে যে-ষাড়টি আমাদের গোয়ালের পাশে এসে হাঁক দিত, তার দেহের সৌন্দর্য তো অবর্ণনীয়। আমার যদি অমন একটি দেহ থাকতো, অমন অণ্ড অমন অজগর। মানুষের শরীর আমার চোখে সুন্দর, সবেচেয়ে সুন্দর নারীশরীর। আমি ওই সৌন্দর্যে বারবার মুগ্ধ হয়েছি, চিরকাল মুগ্ধ হবো; ওই শরীরের দিকে তাকিয়ে আমি সৌন্দর্য বুঝেছি; ওই। শরীর ছোঁয়ার সাথে সাথেই আমি ভালোবাসতে পেরেছি, চিরকাল পিরবো; ওই অপূর্ব বস্তুকে ভালোবাসার জন্যে কোনো পূর্বভালোবাসার দরকার আমার কখনো পড়ে নি। আমি যাকে ঘেন্না করি, তার দেহকেও তীব্রভাবে ভালোবাসতে পারি; যেমন ফিরোজাকে আমার ঘেন্না লাগছে, কিন্তু তার দেহকে ঘেন্না লাগছে না; যদি ওই দেহের সাথে আজ রাতে আমি জড়িয়ে পড়ি, পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তবে আমি তার প্রতিটি খণ্ডকে ভালোবাসতে পারবো। শরীরই আমার কাছে স্বর্গ আর নরক, আমি অবশ্য স্বর্গেটর্গে বিশ্বাস করি না; তবে শরীর আমাকে স্বর্গের অভিজ্ঞতা দিয়েছে, নরকের অভিজ্ঞতা দিয়েছে; শরীর আমাকে বেঁচে থাকার অমৃত দিয়েছে মৃত্যুর বিষও পান করিয়েছে। আর আমি শরীরের সীমাবদ্ধতায় সব সময়ই পীড়িত বোধ করেছি; আমি যতোটা উপলব্ধি। করতে চাই, আমি দেখেছি আমার শরীরের, আমার ইন্দ্রিয়গুলোর সে-শক্তি নেই; আমার শরীর আমার ইন্দ্রিয়গুলো খুবই সীমাবদ্ধ। আমার ওষ্ঠ একটি নির্দিষ্ট সীমার পর আর কাজ করে না, আর অনুভব করে না; আমি যখন ওষ্ঠ দিয়ে চরমতমকে উপলব্ধি করতে চাই, তখন ওষ্ঠ নির্বোধ ত্বকমাংসের সমষ্টি থেকে যায়; আমি যখন গভীর থেকে গভীর থেকে গভীরতমে পৌঁছে ভেঙে যেতে চাই ফেটে পড়তে চাই পরমতমকে ছুঁতে চাই, তখন আমি সীমাবদ্ধ একটি মাংসের ফলক রয়ে যাই। শরীর শরীর চায়, এবং একটি শরীর শুধু আরেকটি শরীর নিয়েই চিরকাল সজীব থাকতে পারে না, তার সীমাবদ্ধতা আরো বাড়তে থাকে; ওই অবস্থায় মরে যেতে থাকে, আর বেঁচে থাকার জন্যে ভিন্ন শরীরের জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ফিরোজা ভিন্ন শরীর চায়, যদিও সে স্বীকার করছে না; আমার শরীরের থেকে নৃতাত্ত্বিকটির শরীর তার শরীরকে বেশি: আলোড়িত করছে এখন; যেমন ফিরোজার শরীরের থেকে দেবীর আর মাহমুদা রহমানের শরীর আমার শরীরকে বেশি আলোড়িত করে। শরীর পুরোনো হয়ে যায়, তা নতুন হয়ে উঠতে পারে নতুন শরীরের স্পর্শে; তা আমার ফিরোজার মাহমুদার দেবীর ও অন্য সবার জন্যেই সত্য, কারো জন্যেই মিথ্যে নয়। সমাজ চায় শরীর পুরোনো হয়ে যাক, তার সজীবতা লুপ্ত হয়ে যাক, কিন্তু শরীর তা চায় না।