তিনি বললেন, আপনাকে কয়েক দিন ধরেই ফোন করছি (সত্য নয়), পাচ্ছি না (সত্য নয়), আপনাকে আমার খুব দরকার (হয়তো সত্য নয়)।
আমি কী বলব, বলবো কি আমি ঢাকায় ছিলাম না, তাই পান নি; আমি তা বলতে পারি না, কী বলতে হবে বুঝতে পারি না, শুধু বলি, আজ আমি যাই, আরেক দিন আসবো।
মাহমুদা রহমান আরো বিব্রত হয়ে পড়েন, আমার চলে যাওয়া সুন্দর দেখাবে না বলে আমার মনে হয়, এবং তারও মনে হয় বলে আমার মনে হয়।
তিনি বলেন, আপনাকে আমার খুব দরকার (সত্য নয়), দয়া করে একটু বসুন।
তিনি এভাবে কথা বলছেন কেনো? আমি চলে গেলে তার কী আসে যায়?
আমি মাহমুদা রহমানের দিকে তাকাই, আমার মনে পড়ে কিছুক্ষণ আগে তাঁকে দেখতে আমার খুব ইচ্ছে করছিলো, ছুঁতেও খুব ইচ্ছে করছিলো; এখন আমার কিছুই ইচ্ছে করছে না, দেখতেও ইচ্ছে করছে না, ছুঁতেও না; পান করার সময় তাকে আমার কবুতর মেঘ টুনটুনি জলপাই মনে হচ্ছিলো, এখন তাকে মিসেস রহমান মনে হচ্ছে, যাকে দেখার কিছু নেই হেয়ার কিছু নেই। যুগ্মটি সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন আজ আর কোনো কাজ হবে না, একটা বাজে গ্রহ দেখা দিয়েছে; তিনি উঠে দাঁড়ান, ভাবীকে আশ্বাস দিতে থাকেন শিগগিরই আবার আসবেন, তাঁর আজ অনেক কাজ, নইলে আরো কিছুক্ষণ থাকতেন; মাহমুদা রহমান তাঁকে দরোজা পর্যন্ত দিয়ে আসেন। আমি মাহমুদা রহমানকে আবার দেখি, তাকে আমার কবুতর মনে হয় না মেঘ মনে হয় না টুনটুনি। মনে হয় না জলপাই মনে হয় না, তাঁকে দেখার কিছু নেই হেয়ার কিছু নেই। তিনি হয়তো আমার চোখ দেখে তা বুঝতে পারেন, তাকে এতো অসহায় দেখাতে থাকে যে এবং এমন অসহায়ভাবে আমার পাশে এসে বসেন যে আমার মায়া হয়। তাঁর মুখটি। অত্যন্ত ছোটো দেখায়, তাতে রক্ত নেই বলে মনে হয়।
তিনি বলেন, যুগ্মসচিব আমাকে বিয়ে করতে চান, পরিচয়ের পর থেকেই প্রস্তাব দিচ্ছেন, আংটিও কিনেছেন, বিয়ের জন্যে পাগল হয়ে উঠেছেন।
আমি তার মুখের দিকে তাকাই, কিছু বলি না।
তিনি বলেন, প্রথম দিন থেকেই আমার রূপের খুব প্রশংসা করছেন, বাহু গাল ঠোঁটও বাদ দিচ্ছেন না, দ্রতা করে হয়তো বুকটাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন, খুব শুতে চেয়েছিলেন, আমি রাজি হই নি; এখন বিয়ে করেই শুতে চান।
আমি বলি, প্রেম ও ধর্ম দুটিই কাজে লাগাতে চান, যেটিতে কাজ হয়। আমাদের আমলারা বেশ নীতিপরায়ণ পরহেজগার মানুষ, এখনো বিয়েশাদিতে তারা বিশ্বাস হারান নি।
তিনি বলেন, দ্রলোকের বউ অতিরিক্ত সচিবের সাথে পালিয়েছে কয়েক মাস আগে। শোকেদুঃখেঅপমানে কাতর হয়ে আছেন, আমাকে বিছানায় তুলে শোকদুঃখঅপমান ভুলতে চান।
আমি বলি, তার কোনো উপসচিব নেই?
তিনি বলেন, তা আমি জানতে চাই নি। আমি তাঁকে একটি অবিবাহিত মেয়ে বিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছিলাম, চারপাশে মেয়েগুলো বিয়ে করতে না পেরে শুকিয়ে মরছে, এমএ পাশ মেয়েগুলো রিয়াদের ঝাড়ুদার বিয়ে করছে, কিন্তু তিনি অবিবাহিত মেয়ে। বিয়ে করতে চান না, বিধবা বিয়েও করতে চান না, কারো বউ ভাগিয়ে বিয়ে করতে চান মনে হয়।
আমি বলি, কারো বউ ভাগিয়ে বিয়ে করায় গৌরব আছে, আর তাতে দ্রুত পদোন্নতি হয়।
তিনি বলেন, আমার একটি স্বামী আছে, একটি উপপতি আছে, আমি কেনো তাঁকে বিয়ে করতে যাবো। আমি আমার ধরনে সৎ থাকতে চাই।
মাহমুদা রহমান তার বাচ্চাদের ইস্কুল থেকে আনতে যাবেন, তার শুধু প্রেম করলে চলে না, শুধু নিজের শরীরের কথা ভাবলে চলে না, শরীরের ভেতর থেকে যাদের বের করেছেন তাদের কথাও ভাবতে হয়। আমার এসব ভাবতে হয় না, ফিরোজা ভাবছে। এসব। ফিরোজা যদি এখন নৃতাত্ত্বিকটির সাথে থাকে, সেও এখন উঠছে, তার পক্ষেও আর নৃতত্ত্ব চর্চা সম্ভব হচ্ছে না, শরীরের ভেতর থেকে যাকে বের করেছে তার কথা ভাবতে হচ্ছে। ফিরোজও নিজের ধরনে সৎ থাকছে; কিন্তু আমি কি সৎ থাকছি আমার নিজের ধরনে? সততা কাকে বলে আমি বুঝতে পারছি না, কারো প্রতি একনিষ্ঠ থাকাই কি সততা? দুজনের প্রতি একনিষ্ঠ থাকা সততা নয়? তিনজনের প্রতি একনিষ্ঠ থাকা। সততা নয়? আমি বুঝি না। আমি ব্রিজের দিকে বেরিয়ে যাই, ব্রিজ দেখি, নদী দেখি; বিকেলে অফিস শেষ হওয়ার একটু আগে অফিসে ফিরি, দেখি আমার ব্যক্তিগত সহকারিণী খুব উদ্বেগের মধ্যে আছে, আমাকে দেখে সে আলোকিত হয়ে ওঠে। বেশি দিন হয় নি সে আমার ব্যক্তিগত সহকারিণী হয়েছে, ভালো করে দেখিও নি, আজ দেখে মনে হয় সে একটা ছোটোখাটো আগুন লাগাতে পারে, আমাকে ঘিরেও তা লাগতে পারে। তার এ-জ্বলে ওঠার মধ্যেই আমি একটা বিপথে ছুটে যাওয়া আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখতে পাই।
সে বলে, স্যার, যা উদ্বেগের মধ্যে ছিলাম; কোথায় গেলেন কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না।
মেয়েটি উদ্বেগ উচ্চারণ করতে পারে, অর্থ বোঝে! তার কথা শুনে আমার বেশ। ভালোই লাগে, তার কণ্ঠস্বরে একটা কবুতরের ওড়ার আর পাখা ঝাঁপটানোর শব্দ আছে, আমার ভালো লাগে, তবে আমার জন্যে উদ্বেগবোধের অধিকার তাকে এতো তাড়াতাড়ি কী করে দিই।
আমি বলি, উদ্বেগবোধ কি আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? আমাকে নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে থাকার জন্যে সম্ভবত আপনাকে নিয়োগ করা হয় নি।
মেয়েটি নিষ্প্রভ হয়ে যায়, মাথা নিচু করে থাকে; বলে, আমার ভুল হয়ে গেছে, স্যার।