আশ্চর্য, বিস্মিত হই আমি, ওই সন্ধ্যায় ফিরোজাকে আমার বেশি আকর্ষণীয়, বেশি আবেদনময় মনে হয়। আমাকে হঠাৎ বাসায় দেখতে পেয়ে প্রথম একটু বিচলিত হয়। সে, কিন্তু জ্বলজ্বল করতে থাকে, মনে হয় ফিরোজার ভেতরে কোনো তীব্র আলো ঢুকেছে, যা তার ত্বক ভেদ করে ছড়িয়ে পড়তে চাচ্ছে। এখন আমি আটনম্বর সড়কের কথা তুললে সমস্ত আলো নিভে যাবে, অন্ধকার নেমে আসবে, তার মাংস আর আত্মা কালো হয়ে উঠবে। কালো হয়ে উঠবে আমার মাংসও। ফিরোজকে বেশ চঞ্চল মনে হয়, সে বাতাসে ভাসছে; একটি বালক তাকে একটি লাল নীল বেলুনের মতো বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছে।
তোমাকে আজ ঝলমলে মনে হচ্ছে, আমি বলি।
তাহলে তুমিও আমার দিকে তাকাও? ফিরোজা বলে, তাকানোর উপযুক্ত মনে করো!
সবাই আজ তোমার দিকে নিশ্চয়ই খুব বেশি করে তাকিয়েছে, আমি বলি।
তাকাক, তাদের ভালো লাগলে লাগুক, ফিরোজা বলে, কারো যদি ভালো লেগে থাকে আমার তাতে আপত্তি নেই।
আমি আপত্তির কথা বলি নি, আমি বলি, তাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
তোমার অভিযোগের কী আছে? ফিরোজা বলে, আর আমার দিকে তির্যক চোখে তাকায়। ফিরোজা সম্ভবত আমার চোখে ঈর্ষা দেখতে চায়।
আমি আর কোনো কথা বলি না, আলো নিভিয়ে দিই; ফিরোজা বিস্মিত হয়। আমি তাকে টেনে এনে জোর করি, এমন জোর কখনো করি নি, কখনো করবো ভাবি নি; কিন্তু জোর করতে আমার আশ্চর্য ভালো লাগে। ফিরোজা প্রথম বাধা দিতে চেষ্টা করে, নখ দিয়ে খামচি দেবে বলে মনে হয়, কিন্তু সে অবিলম্বে সাড়া দিতে থাকে, আমি অবাক হই। আমার আজকের আচরণ সম্পূর্ণ অপরিচিত আমার, ফিরোজার তো অবশ্যই; আমার অদ্ভুত লাগতে থাকে যে ফিরোজা আমার প্রতিটি নতুন উদ্যোগে প্রথম একটু বাধা দিয়ে তারপরই উপভোগ করতে থাকে। আমি রক্তের স্বাদ টের পাই, লবণাক্ত স্বাদ; মানুষের রক্তের আশ্চর্য স্বাদ রয়েছে; বিভিন্ন স্থানের রক্ত বিভিন্ন রকম মনে হয় আমার। আমি এমন সব পথে যাত্রা করতে থাকি যে-পথে কখনো ভ্রমণ করি নি, ফিরোজা প্রথম বাধা দেয়, কিন্তু আমার জোর-ভ্রমণ তার কাছে চমৎকার লাগতে থাকে। দুর্গম দুরূহ দুস্তর পথ, আমি খুঁড়িয়ে চলি, গড়িয়ে চলি, দস্যুর মতো চলি। আমি ফিরোজাকে চিনতে পারি না, মনে হতে থাকে আমি ফিরোজার সাথে নেই, কোনো ক্রীতদাসীর সাথে আছি; কালো, অন্ধকারের মতো কালো, আগুনের মতো প্রচণ্ড ক্রীতদাসী, যাকে হনন করার সমস্ত অধিকার আমার রয়েছে। আমি হনন করতে থাকি, ফিরোজা হননে আনন্দ পেতে থাকে, ক্রীতদাসীর কণ্ঠের রক্তের মাংসের শব্দে গন্ধে রঙে আমার অন্ধকার পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে; আদিম অন্ধকারে আমরা আর বিধিবদ্ধ কাঠামোয় আটকে থাকি না, রক্তাক্ত গলিত উদ্বেলিত পাপবিদ্ধ সুখমৃত প্রভুদাসী হয়ে। উঠি।
আমাদের খালে বাঁশের পুল, মাঠের পথে ডোবার ওপর ভেঙে পড়া কাঁঠাল গাছ, পাথরের গাঁথনি সেতু, দো-আঁশলা গাঁথনি সেতু, প্রিস্ট্রেসড কংক্রিট, স্টিল ট্রাসেড, ক্যান্টিলিভার সেতু, ঝুলন্ত সেতু, ধারাবাহিক সেতু, খিলান সেতু, পিয়ার, ওপরকাঠামো, অবকাঠামো, পিলপায়া, রওশন, ফিরোজা, মাহমুদা রহমান, আমি, দেবী, বাঁশের পুল, ভেঙে পড়া কাঁঠাল গাছ, পাথরের গাঁথনি, দো-আঁশলা গাঁথনি, ঝুলন্ত, প্রিস্ট্রেসড, খিলান, ক্যান্টিলিভার, কিন্তু আমি কোনো সেতু দেখছি না, আমার সাথে আর কারো কোনো ব্রিজ তৈরি হয় নি, আমি সেতু বাঁধতে পারি নি, কেউ পারে না। মাহমুদা রহমানের বাসায় কয়েক দিন যাই নি, তিনিও এখন দশটা বাজলেই বেজে ওঠেন না; আমি কোনো কোনো দিন ফোন করেছি, অনেকক্ষণ ধরে বাজে, তিনি ধরেন না। বাইরে তাঁর কাজ পড়েছে হয়তো, না কি বাসায় থেকেও ওই সময়ে ফোন ধরেন না, ফোন তাকে বিরক্ত করে। আমি সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবো, নিতে ইচ্ছে করছে আমার; আর মাহমুদা রহমান নয়, দেবী নয়, ফিরোজাও নয়, আমি একা, সম্পূর্ণ একা। আমি বোধ করি আমার সময় বড়ো বেশি বেড়ে গেছে, একঘণ্টা আর ষাট মিনিট নেই, হাজার হাজার মিনিট হয়ে উঠেছে, আমার ওই সময়টা ভরে রাখার মতো কোনো সম্পদ নেই। জীবন আরো নিরর্থক আরো শূন্য হয়ে উঠেছে। আমি যদি আরো তিরিশ বছর বেঁচে থাকি, আমার ভয় লাগতে থাকে, তাহলে এতোগুলো বছর আমি বহন করবো কীভাবে? আমার যা কাজ তা শেষ করে আমি আর কিছু খুঁজে পাই না। মাহমুদা রহমানের কাছে যাচ্ছি না, যাবো না; কিন্তু প্রতি মুহূর্তে আমার তাকেই মনে পড়ছে, আমার এখন পান। করতে ইচ্ছে করছে। আমি বেরিয়ে পড়ি, পাঁচতারা হোটেলটিতে গিয়ে পান করি, পান করতে করতে আমার আরো বেশি মাহমুদা রহমানকে মনে পড়ে; তাঁকে টেলিফোন, করবো না, কিন্তু পানের টেবিলেই যদি একটি টেলিফোন থাকতো তাহলে এখনি তাঁকে ফোন করতাম। পান করতে করতে আমার ক্ষোভটা কেটে যায়, পান করলে আমি অনেক বেশি সরল হয়ে উঠি, দেবতা হয়ে উঠি, মানুষের ঘৃণা ক্ষোভ পাপগুলো থাকে না, আমি শেষ করে উঠে দাঁড়াই। মাহমুদা রহমানকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে ছুঁতে ইচ্ছে করছে; এতো বেশি আর কখনো দেখতে আর ছুঁতে ইচ্ছে করে নি।
মাহমুদা রহমানের বাসায় গিয়ে
মাহমুদা রহমানের বাসায় গিয়ে আমি কলিংবেল বাজাই; আমি নিজেই অবাক হই। এখানে আমার আসার কথা ছিলো না, আমি আসতে চাই নি, ইচ্ছে ছিলো ব্রিজ দেখতে যাবো, কাজ কেমন হচ্ছে দেখবো বা নদী দেখবো; তার বদলে আমি মাহমুদা রহমানের ফ্ল্যাটের কলিংবেলে আঙুল রেখে দু-বার চাপ দিই। আমি মাতাল হই নি, কখনো হই না, অতোটা আমি কখনোই খাই না; শুধু একটু গন্ধ ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না একটু আগে আমি পান করেছি। মাহমুদা রহমান আমাকে দেখে অবাক হন, বিব্রতও হন; আমি বুঝতে পারি তিনি বিব্রত, তাতে আমি অবাক হই; এ-সময়ে আমাকে দেখে তার শুধুই অবাক হওয়ার কথা ছিলো, বিব্রত হওয়ার কথা ছিলো না। অন্য দিন হলে তিনি আমাকে সরাসরি শয্যাকক্ষে নিয়ে যেতেন, সেটাই আরামদায়ক ও অন্তরঙ্গ, আজ ড্রয়িংরুমে ঢুকতে হলো তাঁর সাথে, ঢুকে আমি একটু আহত হলাম সেখানে যুগ্ম জিল্লুর রহমানকে দেখতে পেয়ে। আমি জানি না তিনি জিল্লুর রহমান কি না, তিনি যুগ্মসচিব, কি না, মাহমুদা রহমান তাঁর এ-পরিচয়ই দিলেন; পরিচয়টি ঠিকই হবে, আমার কাছে তাঁকে লুকোতে চান নি মাহমুদা রহমান, আমার যে-পরিচয় দিলেন তাঁর কাছে, সেটা ঠিকই। যুগ্ম শব্দটি সব সময়ই আমার অদ্ভুত কিম্ভুত লাগে, প্রথম যখন পেয়েছিলাম তখন থেকেই, শব্দটি শুনলেই লেগে থাকার গেথে থাকার সেঁটে থাকার ভাব মনে। আসে, আর আমি দু-একটি যুগু দেখেছি, সেগুলো অদ্ভুতভাবে লেগে থাকতে গেঁথে থাকতে পারে; আমি বুঝতে পারি এ-যুগটি লেগে আছেন গেঁথে আছেন মাহমুদা রহমানের পশ্চাতে। তার কোনো উপসচিবের বাসায় থাকার কথা ছিলো, তিনি এখন। মাহমুদা রহমানের বাসায়। আজই কি তিনি প্রথম মাহমুদা রহমানের যুগ্ম হয়েছেন? না কি কয়েক দিন ধরেই হয়েছেন, আসছেন? তিনি খুব টানটান হয়ে আছেন, তার সারা দেহখানি দাঁড়িয়ে আছে; কোনো শিথিলতা ক্লান্তি নেই তাঁর শরীরে চোখেমুখে, মনে। হচ্ছে এখনি ফেটে পড়বেন; তাহলে তিনি লেগে থাকার পুরস্কার পান নি এখনো। আমি কি চলে যাবো, তাঁদের কথা আর কাজে অসুবিধা হচ্ছে সম্ভবত, আমি কি চলে যাবো? মাহমুদা রহমান আমাদের দুজনকে নিয়ে কী করবেন? একটি যুগ আরেকটি ক্যান্টিলিভার তার একসাথে দরকার পড়বে না। মাহমুদা রহমানই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার ভার নিলেন, তিনি আমাকে এখনো পরিত্যাগ করেন নি।