বালকটি কি মুগ্ধ হয়ে শুধু ফিরোজার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর কোনো দিকে তাকায় না, ফিরোজার গলার স্বর শুনে শুনেই বিভোর হয়ে যায়, অন্য কোনো সুর তার শুনতে ইচ্ছে করে না? ফিরোজা আর বালকটির কি এখনো সোনালি রুপোলি গল্পের পর্ব চলছে? সে কি ফিরোজাকে শুনিয়ে যাচ্ছে শুধু প্রশান্ত মহাসাগরের গল্প, ফিরোজা বালিকার মতো শুনে চলছে? না কি তারা পরস্পরের শরীরের কাছাকাছি এসে গেছে? হয়তো এসে গেছে, এসে গেছে বলেই মনে হচ্ছে; ফিরোজা নিজের আর আমার শরীরের প্রতি এতো নিস্পৃহ হয়ে পড়েছে হয়তো সে-জন্যেই, বালকটি তাকে পরিতৃপ্ত করে চলছে বলেই হয়তো এতো নিরাসক্ত হতে পারছে সে আজকাল। তারা। প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিচ্ছে তো, না কি কাকের বাসায় একটি কোকিলের ছানা দেখা দেবে অচিরেই, এবং আমাকে সেটি নিজের বলে মেনে নিতে হবে, যদিও আমি অত্যন্ত সাবধান? আমার তো প্রমাণ করার কোনো ইচ্ছে হবে না যে ওই ছানাটির জন্যে আমি দায়ী নই, অন্য কেউ দায়ী। ছানাটি দেখে এমনও হতে পারে যে আমার ভালো লেগে যাবে, আমার খুব মায়া হবে, অনেক দিন পর একটি বাচ্চার মাংসের ছোঁয়া পেয়ে। আমার ত্বক শিউরে উঠবে, তখন নৃতাত্ত্বিক আর ফিরোজা আমাকে নিয়ে হাসবে। অন্য রকমও হতে পারে, ফিরোজা রক্ত দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে অবতারটির কাছে ছুটে যেতে পারে, তাকে বিয়ে করার জন্যে কান্নাকাটি করতে পারে, তখন অবতারটি। ফিরোজাকে নাও চিনতে পারে; এবং হতাশ ফিরোজা একটি আত্মহত্যার উদ্যোগ নিতে পারে, সে সফল হতে পারে, ব্যর্থও হতে পারে। তখন দোষ হবে আমার, মানবতাবাদীরা সবাই চিৎকার করে বলবে আমার পীড়ন সহ্য করতে না পেরেই ফিরোজা ট্রাকের বা ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েছে; আমার মতো পাষণ্ড দ্বিতীয়টি আর হয় না। রগরগে সাংবাদিকগুলো খুঁজে বের করবে যে আমি একটি অত্যন্ত লম্পট পুরুষ, নারী থেকে নারীতে ছুটে বেড়ানোই আমার কাজ, আমার এক ডজন উপপত্নী রয়েছে, আর সে-শোকেই ফিরোজা আত্মহত্যা করেছে। আমি কি ফিরোজাকে পরামর্শ দেবো সে যা-ই করুক প্রতিরোধের ব্যবস্থাটি যেনো গ্রহণ করে? তবে ফিরোজা যদি আসলেই ঘুমোয় বালকটির সাথে, আর আমি যদি তা নিশ্চিতভাবে জানতে পারি, আমার কেমন লাগবে? …
ফিরোজাকে সন্ধ্যার একটু পরে ধানমণ্ডি আট নম্বরসড়কে দেখতে পাবো আমি ভাবি নি; আমার ধারণা ছিলো সে অর্চির সাথে অংকের মাস্টারের বাসায় আছে; অর্চি অংক শিখছে, ফিরোজা আর দশজন দায়িত্বশীল মাতার মতো মাস্টারের অপেক্ষাগারে বসে হিন্দি ছবি দেখে জীবন সার্থক করছে। দায়িত্বশীল মাতাদের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা না করলে ব্যবসা জমবে না, এটা আজকাল মহৎ মাস্টার দোকানদাররাও বোঝে, আমি। শুনেছিলাম ফিরোজা বিকেলে সেখানেই থাকে, অংক শেষ হলে অর্চিকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। গর্ভবতী হওয়ার কী সুখাবহ পরিণাম। আমি দেখলাম ফিরোজার গাড়িটি। আটনম্বর সড়কের একটি বাড়ি থেকে দ্রুত বেরোলো, হয়তো একটু পরেই অংককষা। শেষ হবে অর্চির, শেষ হওয়ার আগেই সে গিয়ে অপেক্ষাগারে বসবে, অর্চি বেরিয়ে। দেখরে মা বসে আছে। সে বুঝতে পারবে না তার জননী ধামণ্ডির আটনম্বর সড়কে একটু ভ্রমণে গিয়েছিলো। আমি যে এ-সময় এ-পথ দিয়ে যাবো ফিরোজা ভাবে নি; আমি ড্রাইভারকে দ্রুত গাড়ি চালাতে বলতে পারি, গিয়ে উঠতে পারি অর্চির অংকের মাস্টারের বাসায়, কিন্তু আমি তা করবো না; তা ছাড়া অংকের মাস্টারের বাসাটা কোন দোজগে তা আমি জানি না। এ-সড়কে ফিরোজার কোনো আত্মীয় আছে বলে আমি শুনি নি, তবে কোনো পরমাত্মীয় থাকতে পারে, যার ঠিকানা আমি জানি না। নৃতাত্ত্বিক অবতারটি কি এখানে থাকে? অর্চি যখন অংক শেখে তখন কি ফিরোজা নৃতত্ত্ব শেখে? দুজনের ঘনিষ্ঠ একান্ত নগ্ন নৃতত্ত্ব? আমি ভালো করে ফিরোজাকে দেখতে পাই নি, তার চুলের অবস্থা বা শাড়ির ভাজ দেখতে পাই নি, পেলে আমি একটা ধারণা করতে। পারতাম তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে; হয়তো তাও পারতাম না। আমি রক্তের উষ্ণতা টের পাই আমার, কিন্তু বেশি উষ্ণ হতে দিই না; অবতারটির যদি একটা বউ থাকতো আমি কিছুটা প্রতিশোধ নিতে পারতাম, পারার কথা ভাবতাম। ফিরোজাকে যে আমি আটনম্বর সড়কে দেখেছি, তাও আমি বলবো না, অন্তত আজই বলবো না, বললে নিজেকে আমার ছোটো মনে হবে, নিজেকেই আমি ঘৃণা করবো।
ফিরোজা ঘুমিয়েই থাকে যদি বালকটির সাথে আমি কেনো উত্তেজিত হবো (আমি একটু উত্তেজিত), কেনো আমার রক্ত বলক দিয়ে উঠবে (আমার রক্ত একটু ফুটছে), পায়ের নিচের মাটি কাঁপতে থাকবে (একটু কাঁপছে)? আমি কি ঘুমোই না অন্য নারীর সাথে? আমি কি দু-গোলার্ধের নারীশরীরসংস্থান জানি না? আমি কি ব্যাংকক, তোকিও, লন্ডন, নিউইঅর্ক, মাদ্রজ যাই নি? আমি কি মঙ্গোলীয় মসৃণতা, জাপানি গন্ধ, শ্যামদেশীয় বর্তুলতা, মার্কিন মুখমন্দারতা, কৃষ্ণাঙ্গিনী পেশলতা, আর তামিলিনী কৃষ্ণ আগুনের স্বাদ পাই নি; এবং পাই নি মাহমুদা রহমান আর দেবীর শরীরের প্রসাদ? আর রওশনের স্বর্গখণ্ড? আমি যখন আমার জীবনের দিকে তাকাই ব্যাংকের হিশেব, উত্তরার। বাড়ি, নদীর ওপর ব্রিজগুলোর কথা মনে পড়ে না, ঝিলিক দিতে থাকে ওই সব শরীর, ওই সব জ্যোতির্ময় বাঁক উচ্চতা গভীরতা, ওই সব হিরণয় অবসাদ, যা আমাকে সুখে আনন্দে পরিপূর্ণ করে তুলেছে। আমি জানি সবই নিরর্থক, ওই ব্রিজ নিরর্থক, সূর্য। নিরর্থক, সব কাঠামোই ধসে পড়বে, আমি মাটিতে মিশে যাবো, মাটি শূন্যতায় মিশে যাবে। এর মাঝে অর্থপূর্ণ হচ্ছে ওই সব জ্যোতির টুকরোগুলো। আমার ইদ্রিয়গুলো। প্রখর, আমার কোনো একটি ইন্দ্রিয় মাত্র একটি কাজ করে না, প্রত্যেকটি অসংখ্য কাজ করে, আমি করতে শেখাই। চোখ দিয়ে আমি শুধু দেখি না, চোখ দিয়ে আমি ছুঁই, চোখ দিয়ে আমি খাই, পান করি, এমনকি চোখ দিয়ে আমি মিলন করি। নিরর্থক। এভাবে আমার কাছে হয়ে ওঠে অর্থপূর্ণ। ফিরোজা অন্য কারো সাথে মিলিত হলে আমি কাপবো কেনো? সে আমার স্ত্রী বলে? তার দেহের ওপর আমার সমস্ত অধিকার বলে, তার সমস্ত বাক সমস্ত রন্ধ্র আমার বলে? সেখানে অন্য কেউ হাত দিলে আমার পুরুষতায় আঘাত লাগে বলে? কিন্তু আমি কি কপি না?