মাহমুদা রহমান মারাত্মক রসিকতা করতে পারেন, নিজেকে নিয়েও, টেলিফোনেই অবলীলায় তিনি ভয়ঙ্কর রসিকতা করে চলেন। আমার ভয় লাগে কখন কে আমাদের সংযোগের মধ্যে ঢুকে পড়ে, সব কিছু উল্টেপাল্টে যায়।
টেলিফোন বাজলে আমি ধরে বলি, হ্যালো।
তিনি এখন আর আমি বলেন না, বলেন, আপনার উপপত্নী।
আমি প্রথম প্রথম বিব্রত বোধ করতাম, এখন আর করি না, বরং ভাবতে ভালোই লাগে যে আমার একটি উপপত্নী আছে। আমার পিতার একটি ছিলো, তার পিতার হয়তো দুটি ছিলো, তার পিতার হয়তো একগণ্ডা ছিলো। উপপত্নী কী, কী হলে কেউ উপপত্নী হয়, উপপতি হয়?
আমার বলতে ইচ্ছে হয়, বলুন, উপপত্নী, আপনি কেমন আছেন? কিন্তু আমি বলতে পারি না, মনে মনে ভালো লাগলেও তা উচ্চারণ করার সময় আমার গলা বন্ধ হয়ে আসে; আমি বলি, আপনার রসিকতাবোধ ভয়ঙ্কর।
তিনি আগে বলতেন, আপনি ভাগ্যবান, একটি টাকা ব্যয় না করেও এমন একটি উপপত্নী পেয়েছেন।
আমি বলতাম, আপনি কী যে বলেন!
তিনি বলতেন, আমি সত্যিই বলি, ভাবতে আমার ভালোই লাগে যে আমি আপনার উপপত্নী।
আমি বলতাম, আপনার ভালো লাগা খুবই সাংঘাতিক।
এখন আমিও রসিকতা করি, না করে উপায় নেই, সব কিছু গুরুত্বের সাথে নিলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়বো।
এখন যখন বলেন, কী ভাগ্যবান আপনি! একটি পয়সাও ব্যয় না করে এমন একটি উপপত্নী পেয়েছেন!
আমি বলি, কিন্তু যে-সেবাটি দিই তার দাম?
তিনি হেসে বলেন, মিলিয়ন ডলার?
আমি বলি, তিন মিলিয়ন।
তিনি বলেন, কীভাবে?
আমি বলি, পতির কাছে পেতেন একটি সেবা, আমি গরিব, কিছু দিতে পারি না, তাই আমি দিই তিনটি সেবা, প্রত্যেকটির দাম ভেবে দেখুন।
মাহমুদা রহমান হাসেন, আমি তার শব্দ পাই।
তিনি একদিন বলেন, একটি কথা কি আপনি কখনো ভেবেছেন?
আমি বলি, কী কথা?
তিনি বলেন, উপপত্নীকে পত্নী করে নিলে কেমন হয়?
আমি শিউরে উঠি, কথা বলতে পারি না, ব্রিজ ধসে পড়ছে দেখতে পাই।
তিনি বলেন, ভয় পাচ্ছেন মনে হচ্ছে।
আমি বলি, হ্যাঁ, পাচ্ছি।
তিনি বলেন, ভয় এখন থাক, চলে আসুন।
আমি না করতে পারি না; না করলে তিনি মনে করবেন আমি, একটা আস্ত কাপুরুষ, শুধু ভয়ই পাই নি, পালিয়ে যাওয়ারও পথ খুঁজছি। হঠাৎ তাঁর পত্নী হওয়ার সাধ জাগলো কেনো? তিনি তো একজনের পত্নী হয়ে দেখেছেন, তার সুখ মহত্ত্ব প্রেম কাম সবই দেখেছেন, তাহলে তার এমন সাধ হলো কেনো? তিনি কি মনে করছেন হাফিজুর রহমানের পত্নী হওয়াতেই সব বা অনেকটা গোলমাল হয়ে গেছে, তার বদলে তিনি যদি মাহবুব হোসেনের বিবাহিত পত্নী হতেন বা এখন হন, সব ঠিক হয়ে যাবে, তিনি সুখে আচ্ছন্ন হয়ে যাবেন? আমার তা মনে হয় না; ফিরোজার সাথে জড়িয়ে গেছি বলে আমার গোলমাল হচ্ছে আমার মনে হয় না, মাহমুদা রহমানের সাথে বিয়ে হলেও একই গোলমাল হতো। তিনি ভাবছেন ব্যক্তিই মূল সমস্যা, যদি ঠিক লোকটিকে পাওয়া যেতো, সব ঠিক হয়ে যেতো, সব ঠিক থাকতো, অর্থাৎ আমি হাফিজুর রহমানের থেকে। বেশি ঠিক মানুষ,–অন্তত এখন তাঁর মনে হচ্ছে, আমার সাথে বিয়ে হলে তিনি আরো বেশি ঠিক থাকতেন; আমি ভাবছি অন্যরকম, আমার কাছে কাঠামোই মূল সমস্যা, ব্যক্তি গৌণ। নিকৃষ্ট ব্যক্তির সাথে থাকা সম্ভব নয়, এটা ঠিক; কিন্তু সমস্যা হচ্ছে উৎকৃষ্ট। ব্যক্তির সাথেও থাকা অসম্ভব, কিন্তু আমরা থাকছি। এ-কাঠামো আমার সমস্ত কিছু হরণ করে নিজেকে টিকিয়ে রাখে। আমি বোধ করি আমাদের কোথাও একটা ব্যাপার আছে যে আমরা একে অন্যের প্রতি টান বোধ করবো কাম বোধ করবো প্রেম বোধ করবো, এটা চমৎকার ব্যাপার; তবে আরেকটা ব্যাপারও আছে আমাদের, সেটা চমৎকার নয়, বেশ খারাপই, তা হচ্ছে আমরা একে অন্যের প্রতি টান বেশি দিন ধরে রাখতে পারবো না। হাতপা বেঁধে সাঁতার দেয়া সম্ভব নয়, বিবাহ হচ্ছে হাতপা বেঁধে সাঁতার দেয়ার। অসম্ভব চেষ্টা, যা কেউ পেরে ওঠে না। মাহমুদা রহমান আর আমি সাঁতার দিই, তিনি। ভাবছেন যদি আমরা একটি কাঠামো তৈরি করে ফেলি, বিবাহের কাঠামো, তাহলেও আমরা সাঁতার দিতে পারবো; কিন্তু আমি জানি তখন আমরা সাঁতার দিতে পারবো না। তিনি হাফিজুর রহমানের সাথে সাঁতার কাটার সুখ পান নি, আমি ফিরোজার সাথে পাই না, ফিরোজা আমার সাথে পায় না; ফিরোজা যদি মাহমুদা রহমান হলো আমার। সাঁতারে সুখের শেষ থাকতো না।
তিনি বলেন, উপপত্নী থাকতে আমার ভালোই লাগছিলো, কিন্তু এখন আর ভালো লাগছে না।
আমি বলি, আমি কখনো আপনাকে আমার উপপত্নী মনে করি নি। তাহলে আপনাকে গুলশানে বাড়ি ভাড়া করে দিতাম, মাসে বিশ হাজার টাকা দিতাম। ভরণপোষণের জন্যে।
ওসব আমার দরকার ছিলো না, তিনি বলেন, আগে আমাদের মাঝেমাঝে দেখা হলেই আমার হতো, এখন আমার সব সময় দেখার ইচ্ছে হয়। আমি শুধু আপনাকে পালিয়ে সকালবেলা পেতে চাই না, রাতভর পেতে চাই।
আমি বলি, এমন হলো কেননা আপনার?
তিনি বলেন, গোপনে মিলিত হয়ে হয়ে এখন আমার মনে হচ্ছে আমি দেহ দিচ্ছি, এটা আমার ভালো লাগছে না; আমি একসাথে বেড়াতে যেতে চাই, দুপুরে বাসায়। দেখতে চাই, রাতে একসাথে ঘুমোতে চাই।
আমি বলি, আপনার মধ্যে চিরন্তন নারীত্ব জেগে উঠেছে মনে হচ্ছে, ওটিকেই আমি ভয় পাই বেশি।
তিনি বলেন, আমি আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী হতেও রাজি আছি।