ফিরোজা আর আমি তা পারছি না, আমরা স্বামীস্ত্রী, আমরা কেউ কারো কাছে বাল্যকালের গল্প শুনতে চাই না; আমার বাল্যকালের গল্প শুনে ফিরোজার ঘেন্না লাগবে, ফিরোজার বাল্যকালের গল্প আমার বিরক্তিকর মনে হবে, ফিরোজা, গল্প বলতে গেলে। সব কিছু জড়িয়ে ফেলে, কিছু বাদ দিতে চায় না, শেষ করে উঠতে পারে না, আমরা দুই শয্যায় পড়ে আছি। আমি জানি ফিরোজা উঠে আসবে না, মেয়েদের আশ্চর্য সংযম আছে, ওরা মনকে চেপে রাখতে পারে যখন মন চায়, শরীরকে চেপে রাখতে পারে যখন শরীর চায়। আমি পারি না। এর আগেও এমন হয়েছে, ফিরোজা আশ্চর্যভাবে চেপে। রেখেছে নিজেকে, যদিও তারই দরকার ছিলো বেশি; কিন্তু আমি চেপে রাখতে পারি নি, যদিও আমার কোনো দরকার ছিলো না। এখনো আমার খুব দরকার নেই, কিন্তু আমি ঘুমোতে পারছি না, ঘুমোতে না পারা খুবই জঘন্য ব্যাপার।
তুমি কি ঘুমোচ্ছো? আমি অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলি।
ফিরোজা কোনো উত্তর দিচ্ছে না। আমি কি আবার আমার স্বগতোক্তি করবো? আমার কণ্ঠস্বর কি ওই বিছানা পর্যন্ত পৌঁছে নি?
তুমি কি ঘুমোচ্ছো? আমি আবার স্বগতোক্তির মতো বলি।
ফিরোজা এবার সাড়া দেয়, বলে, কেননা, তাতে কী দরকার তোমার?
আমি বিব্রত বোধ করি, বিছানায় উঠে বসি; বলি, আমার ঘুম আসছে না।
ফিরোজা বলে, আমি তার কী করতে পারি?
আমি বলি, একটা রাবার নামও না।
ফিরোজা চুপ করে থাকে, আমি আবার বলি, একটা রাবার নামাও না।
ফিরোজা বলে, আমার সাথে শুধু এটুকুই তো কথা।
আমি আবার বিব্রত বোধ করি, কোনো কথা বলি না। অনেকক্ষণ নীরবতার পর পর ফিরোজা বলে, দরকার হলে তুমিই নামাও।
আমি বলি, কোথায় আছে আমি তো জানি না।
ফিরোজা বলে, যেখানে থাকার সেখানেই আছে।
অন্ধকারে আমি সে-জায়গাটি হাতড়াতে থাকি, প্রচুর কাপড় আর এলোমেলো জিনিশে ঢেকে আছে সব কিছু, যা খুঁজছি তা আমার হাতে লাগছে না। একটি বড়ো। বাক্স থাকার কথা। তাহলে কি সব ফুরিয়ে গেছে? ফুরিয়ে যাওয়ার তো কথা নয়। এক সময় বড়ো বাক্সটিতে হাত লাগে, আমি ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটি ছোটো প্যাকেট বের করে আনতে চাই। ছ-সাতটি ছোটো প্যাকেট, আমার মনে হয়, থাকার কথা; কিন্তু দু-তিনটি প্যাকেট মাত্র পড়ে আছে। বাকিগুলো গেলো কই? আমরা আটাশ-ত্রিশটির মতো ব্যবহার করেছি, এ-কক্ষে, এতো সময় আমরা পেলাম কই? তাহলে ফিরোজা কি বাকিগুলো ব্যবহার করেছে? আমি একটু কেঁপে উঠি। ফিরোজাকে জিজ্ঞেস করবো প্যাকেট এতো কমলো কী করে? সে কি রেগে উঠবে না? কিন্তু প্যাকেট এতো কমলো কী করে? আমাদের তো দশ পনেরো বিশ দিনেও কিছু হয় না। ফিরোজাকে জিজ্ঞেস করবো? একটু হাল্কা ভঙ্গিতে?
এই, আমি বলি, প্যাকেট এতো কম কেনো!
ফিরোজা একটু রেগে ওঠে, আমি বসে বসে খেয়েছি।
আমি বলি, মাঝেমাঝে বাইরেটাইরে নিয়ে যাও না তো।
ফিরোজা রাগে না, বলে, দরকার হলে তো নিইই।
আমি বিব্রত হই, বলি, মাঝেমাঝেই নাও মনে হয়।
ফিরোজা বলে, এরপর একটি খাতা বানিয়ে হিশেব লিখে রেখো।
আমি একটু হাসার চেষ্টা করি, বলি, একটা সেক্রেটারি নিয়োগ করতে হবে এর জন্যে।
ফিরোজা বলে, একটা চেস্টেটি বেল্টও কিনে আনতে পারো।
আমি বলি, আজকাল বাজারে কি চেস্টেটি বেল্ট পাওয়া যায়?
ফিরোজা বলে, পাওয়া না গেলে ব্রিজট্রিজ রেখে তুমি একটা কারখানা খুলতে পারো। তোমার তো কোটিপতি হওয়ার সাধ আছে।
ফিরোজার প্রস্তাবটি চমৎকার; রিয়াদ, তেহেরান, ভাটিকান বা মতিঝিলের ধার্মিক ব্যাংকটির সাথে যোগাযোগ করলে খারাপ হয় না, তারা এ-প্রকল্পে মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে উৎসাহের সঙ্গে। সুদমুক্ত ঋণ পাওয়া যাবে। কিন্তু আমি কি ফিরোজাকে চেস্টেটি বেল্ট পরাতে পারবো? উল্টো দেখা যাবে মাহমুদা রহমানকে তার আলহজ স্বামী খান দুই চেস্টেটি বেল্ট পরিয়ে গেছে, এমনকি জমশেদ মোল্লা আমারই কারখানায় উৎপাদিত চেস্টেটি বেল্ট পরিয়ে দিয়েছে দেবীর কোমরে।
ফিরোজা ভেঙেচুরে যাচ্ছে, আমাকে ঘেন্না করে সে শক্ত হয়ে থাকবে বলে আমি ভয় পাচ্ছিলাম, এখন সে এতো ভাঙছে যে আমি ভয় পাচ্ছি, ফিরোজা কি এখনো মনে করে আমি ঠিক পারি না? আমি কি ফিরোজাকে জিজ্ঞেস করবো, ফিরোজা কি উত্তর দেবে? এটা কি উত্তর দেয়ার সময়? ঘেন্নাটোর মতো বিশ্রী ব্যাপারগুলো এ-সময় মনে থাকে না, ঘেন্নার কথা মনে থাকে আগে; এ-সময় মানুষ দেবতা হয়ে ওঠে; মানুষের। মন ঘেন্না করতে পারে, ঘেন্না করে, ঘেন্না করে নানা সমস্যা তৈরি করে; কিন্তু শরীর ঘেন্নার উর্ধ্বে, শরীর কোনো ঘেন্না জানে না, ধর্ম জানে না, দর্শন জানে না, রাজনীতি জানে না; শরীর জানে জলের মতো ঝরতে মোমের মতো গলতে ফুলের মতো ফুটতে। শরীরের কাজ শেষ হয়ে গেলে আবার মন কাজ করতে শুরু করে, মনের কাজ সব সময়ই সমস্যা তৈরি করা, খুব ভেতর থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে খুব মারাত্মক কিছু বের করা। আমি মনের কাজকে দমিয়েই রাখতে চাই, তবে ফিরোজা মনের কাজ ছাড়া বেঁচে। থাকতে পারে না বলেই মনে হয়।
আমাকে দরকার তোমার শুধু এটুকুর জন্যে, ফিরোজা বলে।
একে শুধু এটুকু বলছো কেনো?
আমি বলি। এটুকু ছাড়া আর কী?
ফিরোজা বলে। এটাই তো বড়ো কাজ জীবনের, আমি বলি।
আমার তো তা মনে হয় না, ফিরোজা বলে।
তোমার ভালো লাগে না? আমি বলি। ফিরোজা কোনো উত্তর দেয় না। সে ঘুমিয়ে পড়তে চায়, আমি আমার শয্যায় এসে শুয়ে পড়ি, এবার আমার ঘুম আসে, ফিরোজারও এসে গেছে মনে হয়।