অনেকক্ষণ ধরেই ভাবছি শুয়ে পড়বো, কিন্তু বুঝতে পারছি না শুয়ে পড়বো কি না; ফিরোজাও বুঝতে পারছে না বলে মনে হচ্ছে; টিভি থেকে ভিসিআরে যাচ্ছি, ভিসিআর থেকে টিভিতে যাচ্ছি, ফিরোজা কিছু বলছে না, আমি কিছু দেখছি না, ফিরোজাও কিছু দেখছে না বলেই মনে হচ্ছে, নইলে টিভি থেকে ভিসিআরে আর ভিসিআর থেকে টিভিতে যাওয়া আসায় সে বাধা দিতো, বিরক্ত হতো, বাধা দিচ্ছে না, বিরক্ত হচ্ছে না, আমি বুঝতে পারছি না শুয়ে পড়বে কি না। টিভির মেয়েগুলোর মেদের দাপাদাপি। বিরক্তিকর লাগছে, বাসি মনে হচ্ছে, কিন্তু বন্ধ করে দিতে পারছি না, আমি জানি না বন্ধ করে দেয়াটা ফিরোজার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি না। বন্ধু করে দেয়ার একটি ভয়ানক পরিণতি হচ্ছে আমাদের পৌঁছোতে হবে এক অভিন্ন সিদ্ধান্তে যে আমরা দুজনই ঘুমোতে চাই, বিছানায় শুয়ে পড়তে চাই। আমরা কি অমন অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পিরবো? আমি অমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাহস পাচ্ছি না। আজ অবশ্য ফিরোজাকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় লাগছে, সে অন্যের বউ হলে সারা সন্ধ্যা আমি হয়তো অনবরত কথা বলে যেতে পারতাম, নিজের বউ বলে কিছুই বলতে পারছি না, তার সাথে আমি তো নদী, ব্রিজ, ঝড়, বা জীবন নিয়ে আলোচনা করতে পারি না। বাস্তবতা নিয়ে আর কতোক্ষণ। কথা বলা যায়? চা খাবো, চিনি লাগবে কি না, আজ রাতে কী খাবার, অর্চির পড়াশুনো কেমন এগোচ্ছে ধরনের কথা ছাড়া অন্য কোনো কথাই হয় নি সারা সন্ধ্যা, এখন আর কথাই পাচ্ছি না। ফিরোজাকে আকর্ষণীয় লাগছে, তার ঠোঁট বেশ ভেজা দেখাচ্ছে, আমি তাতে আরো ভয় পাচ্ছি, ফিরোজা মনে করতে পারে আজ তাকে আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। বলে আমি লম্পটের মতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছি। না, আমি লম্পট নই। আমি টিভি থেকে ভিসিআরে ভিসিআর গ্রেকে টিভিতে যাতায়াত করতে থাকি, এক সময় গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। ফিরোজার হাতে এখন রিমোট কন্ট্রোল, ফিরোজা ভিসিআর থেকে টিভিতে টিভি থেকে ভিসিআরে যাতায়াত করতে থাকে, কিছুই তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। আমি চোখ বোজার চেষ্টা করি, চোখ বুজে থাকি; চোখ বুজলে আমি। সাধারণত অনেক কিছু দেখতে পাই, কিন্তু আজ কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ফিরোজা টিভি আর ভিসিআর বন্ধ করে তার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। আলোটা নেভায় না, আলোটা নেভানোর সাহস তার হচ্ছে না মনে হচ্ছে; আলোটা নেভালেই মনে হবে আমরা অভিন্ন সিদ্ধান্তে এসে গেছি যে এখন ঘুমোতে হবে।
আলোটা কি নিভিয়ে দেবো? আমি এক সময় জিজ্ঞেস করি।
না, ফিরোজা বলে।
উঠে গিয়ে সে আবার ভিসিআর থেকে টিভিতে যাতায়াত করতে থাকে, যাতায়াত করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সে শুয়ে পড়তে চায়।
আলোটা কি নিভিয়ে দেবো? ফিরোজা আমাকে জিজ্ঞেস করে।
না, আমি বলি।
উঠে গিয়ে আমি আবার টিভি থেকে ভিসিআরে ভিসিআর থেকে টিভিতে যাতায়াত করতে থাকি, যাতায়াত করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমার শুয়ে পড়ার ইচ্ছে হয়।
বাতিটা নিভিয়ে দিই? আমি জিজ্ঞেস করি।
দাও, ফিরোজা বলে।
আমি গিয়ে আমার বিছানায় শুয়ে পড়ি। এখন আমার একটি বড়ো দায়িত্ব ঘুমিয়ে পড়া, এখন ফিরোজার বড়ো দায়িত্ব ঘুমিয়ে পড়া; কিন্তু আমরা কি ঘুমিয়ে পড়তে। পারবো? অন্ধকারে আমি ঠিক দেখতে পাচ্ছি না ফিরোজা কীভাবে শুয়েছে, চোখ বন্ধ করেছে কি না, আমাকেও সে দেখতে পাচ্ছে না নিশ্চয়ই, হয়তো দেখার চেষ্টা করছে। আমি কীভাবে ঘুমাচ্ছি, যেমন আমিও দেখতে চাচ্ছি। ফিরোজাকে কি আমি ডাকবো? ডাকা কি ঠিক হবে? সে তো উঠে এসে আমার পাশে শুতে পারতো। আমি কি গিয়ে তার পাশে শুয়ে পড়বে, সেটা কি নিজেকে ছোটো করা হবে না? পাশে শুয়ে পড়লেই কি আমি তাকে ছুঁতে পারবো? ফিরোজা যদি পছন্দ না করে? ফিরোজা কি চাচ্ছে আমি তার পাশে গিয়ে শুই, তাকে জড়িয়ে ধরি, আমার যা ইচ্ছে করি? ঘড়িটা তার অদ্ভুত সুন্দর আওয়াজ করছে, এখন রাত কতো হলো, কততক্ষণ ধরে আমি ঘুমোনোর চেষ্টা করছি? ফিরোজা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? সে একবার এদিক আরেকবার ওদিক ফিরে শুলো মনে হয়, সেও কি ঘুমোচ্ছে না? ফিরোজা কি জানে আমি মাহমুদা রহমানের সাথে। মাঝেমাঝে ঘুমোই, আর দু-একবার ঘুমিয়েছি দেবীর সাথে? তার জানার কথা নয়, তবে সে সন্দেহ পোষণ করে আমার সম্বন্ধে, যেমন আমি সন্দেহ পোষণ করি। আমি কি একটু উত্তেজিত? ফিরোজও? আমার কি একটু প্রশমন দরকার? ফিরোজারও? আমি জানি না। মনে করা যাক ফিরোজা আর আমার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই, সে অন্য কারো স্ত্রী, দিনাজপুর থেকে ট্রেনে এসেছে, আমি অন্য কারো স্বামী, ট্রেনে এসেছি। সিলেট থেকে, মধ্যরাত, কোনো রেলস্টেশনে একই ঘরে ঘুমোতে বাধ্য হচ্ছি, তাহলে। এখন আমরা কী করতাম? নিজ নিজ বিছানায় ঘুমিয়ে পড়তাম? যদি আমরা একই ঘরে ঘুমোভে রাজি হতাম তাহলে আমরা ঘুমোতাম না, মুখোমুখি বসে চা খেতাম, সে আমাকে দিনাজপুরের গল্প শোনাতো, আমরা চা খেতাম, আমি তাকে সিলেটের গল্প শোনাতাম, আমরা চা খেতাম, অদ্ভুত লাগতো আমাদের চা আর গল্প; সে আমার কাছে আমার বাল্যকালের গল্প শুনতে চাইতো, আমাকে বাক্স থেকে বিস্কুট বের করে দিতে, আমি তার কাছে তার বাল্যকালের গল্প শুনতে চাইতাম, বাক্স থেকে তাকে চকোলেট বের করে দিতাম। তারপর যদি আমাদের একটু শীতশীত লাগতো, যদি আমাদের একটু ঘুমঘুম লাগতো, আমরা প্রথমে একজন আরেকজনের আঙুল ছুঁতাম, পরে গাল। চিবুক ছুঁতাম, ঠোঁট ছুঁতাম, একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর সব ভাষা ভুলে গিয়ে কেউ কাউকে জিজ্ঞেস না করে বাতি নিভিয়ে দিতাম, আমরা মাত্র একটি শয্যা ব্যবহার করতাম, আরেকটি শয্যা শীতে কাতর হয়ে একলা পড়ে থাকতো।