আমি ধার দিই নি, আমি ধার আদায় করছি না; আমি সৃষ্টি করছি, আমিও কিছু ভুলে যেতে চাই, ফিরোজাকে তার দেবর ফোন করেছে কি না, তা ভাবতে চাই না, ভুলে যেতে চাই; আমি দেবীকে সৃষ্টি করতে চাই। এটা আমার সৃষ্টির রাত, আজ রাতে আমি স্রষ্টা। দেবী নিজেকে তুলে দিয়েছেন আমার হাতে, নগ্ন বিষণ্ণ কাতর সুন্দর দেবী, তাঁর। শরীর ধার শোধ করেছে এতো দিন, আজ রাতে ওই শরীর চায় কিছু সৃষ্টি। আমি তাকে আঙুলের ছোঁয়ায় সৃষ্টি করে তুলতে চাই। সুখের জন্যে, যখন আমি সুখ চাচ্ছি না আমি সুখ সৃষ্টি করতে চাচ্ছি অন্যের শরীরে, তখন আমাকে হতে হবে সুরস্রষ্টা, যার হাতের ছোঁয়ায় বেহালা হাহাকার করে, বীণা বেজে ওঠে। আমি দশ আঙুল ছড়িয়ে দিয়ে দেবীর দেহবীণা বাজাতে শুরু করি। তাঁর প্রতিটি তন্ত্রীতে আমার আঙুলের ছোঁয়া লাগে, তিনি বাজতে থাকেন, সুর উঠতে থাকে তার গ্রীবা থেকে, বাহু থেকে, বগলের কৃষ্ণ রোমরাজি থেকে, চাঁদ থেকে, হ্রদ থেকে। দেবীর ডান চাঁদের লাল চক্রে কয়েকটি লাল রোম ঘাসের মতো জড়িয়ে আছে, বাহুতে টিকার দাগদুটি ঘুমন্ত অগ্নিগিরির মতো জ্বলজ্বল করছে। বাজাতে বাজাতে আমার আঙুল গিয়ে পৌঁছে বিশুদ্ধ গোলাপের ওপর, গোলাপের পাপড়ির ওপর, গিয়ে পৌঁছে গোলাপ বেটার ওপর, পাপড়ি থেকে বোটায়। আর বোটা থেকে পাপড়িতে আমার আঙুল বীণাবাদকের আঙুলের মতো সুর তুলতে শুরু করে, পাপড়ির পর পাপড়িতে আঙুল পড়তে থাকে, দেবী বেজে ওঠেন, বাজতে থাকেন, পাপড়ি পেরিয়ে আমার আঙুল গোলাপপেয়ালার ভেতরে প্রবেশ করে, মধু উপচে পড়তে থাকে গোলাপপেয়ালা থেকে। দেবী চৈত্রের বাতাসে আন্দোলিত গোলাপের মতো কাঁপতে থাকেন, গোলাপ ভেঙেচুরে সমস্ত পাপড়ি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আমি শুধু ঝংকার শুনতে থাকি। তখন আমি প্রবেশ করি গোলাপপেয়ালার মধুর ভেতর, আমি মরে যেতে থাকি, আমি বেঁচে উঠতে থাকি, দেবী মরে যেতে থাকেন, দেবী। বেঁচে উঠতে থাকেন, আমরা অনন্ত মৃত্যু আর পুনরুজ্জীবনের মধ্যে দুলতে থাকি।
আমি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছি আজকাল প্রায়ই, প্রায়ই রওশনকে স্বপ্ন দেখছি, আর–পরীক্ষার স্বপ্ন দেখছি। দুটিই অপ্রাসঙ্গিক আমার জীবনে, কিন্তু ওই দুটিই ফিরে ফিরে দেখছি, আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে, আর ঘুমোতে পারছি না। রওশনকে আমি আজকাল মনেই করতে পারি না, তার মুখ মনে করতে পারি না, কিন্তু স্বপ্নে তার মুখ অবিকল আগের মতো দেখতে পাই; শুধু সে আগের মতো বাঁধানো কবরের পাশে দাঁড়ায় না, দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে কোনো পাহাড়ের পাশে বা মাঠের মাঝখানে, আমাকে দেখে দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, আমাকে চিনতে পারছে না, তার সাথে যারা আছে আমি তাদের চিনি না। আবার দেখতে পাই পরীক্ষা দিতে গেছি, অনেক দেরি হয়ে গেছে আমার, পরীক্ষা শেষ হওয়ার বাকি নেই, আমাকে কেউ প্রশ্নপত্র দিচ্ছে না, আমি চিৎকার করে প্রশ্নপত্র চাচ্ছি, আমাকে বলা হচ্ছে আর প্রশ্নপত্র নেই। আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। দুটির কোনোটিই আমি বুঝে উঠতে পারছি না, যা আমার জীবনে সম্পূর্ণ নিরর্থক তার স্বপ্ন আমি কেনো দেখি? আমি কি নিরর্থকতার স্বপ্ন দেখছি, এ-স্বপ্ন দুটি কি আমাকে। মনে করিয়ে দিচ্ছে আমার জীবন নিরর্থক হয়ে গেছে? আমি কি গোপনে গোপনে অনুভব করছি ওই নিরর্থকতা? কিন্তু কী অর্থপূর্ণ? আমি কোনো কিছুতেই কোনো অর্থ খুঁজে পাই না, বেঁচে থাকা আমার কাছে নিরর্থক, বেঁচে-না-থাকাও আমার কাছে নিরর্থক; নদীর ওপর ব্রিজ থাকা আমার কাছে নিরর্থক, না-থাকাও নিরর্থক।
ফিরোজার সাথে দেখা হচ্ছে না, অর্চির সাথে দেখা হচ্ছে না, যদিও আমরা একই। ফ্ল্যাটে আছি, আমি অবশ্য বেশি সময় থাকার সুযোগ পাচ্ছিনা; আমাদের সম্পর্ক পিতা, স্বামী, মাতা, স্ত্রী, কন্যার, কিন্তু দেখা হচ্ছে না। যতোটুকু দেখা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি দেখা হয় আমাদের অন্যদের সাথে। আমি যখন দুপুরে বাসায় ফিরি তখন অর্চি বাথরুমে, সে আর বাথরুম থেকে বেরোয় না। আমি ভেবে পাই না অর্চি বাথরুমে কী করে, একজন মানুষের কেনো গোসল করতে এতোটা সময় দরকার হয়? অর্চি কি বাথরুমের ঝরনার নিচে থাকতেই পছন্দ করে? ওর শরীর জুড়ে কি ক্লান্তি নেমেছে, ঝরনাধারার নিচে থেকে থেকে কি অর্চি আবার তার শক্তি ফিরে পায়? আমি ওকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করতে সাহস করি না। চারপাশের ময়লা ওর শরীরে হয়তো জমছে, অর্চি হয়তো ময়লা থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্যে বাথরুমের ঝরনার নিচে চিরকাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে চাচ্ছে।
অর্চিকে আমি জিজ্ঞেস করি, অর্চি, তোমার কী ভালো লাগে?
আমার কিছু ভালো লাগে না, অর্চি বলে, কিচ্ছু ভাল্লাগে না।
নদী বা সমুদ্র দেখতে তোমার ইচ্ছে করে না? আমি জিজ্ঞেস করি।
না, ইচ্ছে করে না, অর্চি বলে, আমার কিছুই ইচ্ছে করে না।
আমাদের মহাপুরুষদের কথা তুমি কখনো ভাবো? আমি বলি।
হাহাহা করে ওঠে অর্চি, আমি ভয় পাই; অর্চি অবলীলায় বলে, ওদের কথা ভাবার আমার সময় নেই, ওরা বড়ো অকওআর্ড পিপল, ওদের থেকে পপ সিংগারস আর মাচ মোর অ্যাট্রাকটিভ, আই অ্যাডোর দেম।
ফিরোজাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে, অর্চির সাথে ইস্কুলে যাচ্ছে আসছে, প্রাইভেটে যাচ্ছে আসছে, খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ছে মনে হয়। উদ্দেশ্যহীনতার ক্লান্তিতে ভুগছে ফিরোজা? অর্চির কিছুই ভালো লাগে না, তবে তার একটা উদ্দেশ্য আছে, অনেক লেটারফেটার তাকে পেতে হবে, পাবেই, না পেলে তার চলবে না, বা ফিরোজার চলবে না; ফিরোজার কিছু পাওয়ার নেই। অর্চির লেটারগুলো কি সার্থক করে তুলবে ফিরোজাকে? আমাকে করবে না, ফিরোজাকে কি করবে? করবে বলে মনে হচ্ছে। সে চাকুরিটা করতে পারতো। আমি আজ ইস্কুল থেকে অর্চিকে আনতে গিয়ে ইস্কুলের সামনে রাশিরাশি সারিসারি ফিরোজাকে দেখে চমকে উঠি। অর্চির ছুটি হওয়ার বেশ আগেই আমি ইস্কুলে হাজির হই, দেখি সারিসারি ফিরোজা বসে আছে সামনের ফুটপাতে, মাঠের গাছের নিচে, অনেকে পাজেরোতে, আর ঝকঝকে টমোটায়-আমার ভয় লাগতে থাকে। তারা অপেক্ষা করে আছে তাদের কন্যা আর পুত্রদের জন্যে। প্রতিটি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই তারা ক্লান্ত; তারা এসব সোনালি বাচ্চাদের গর্ভে ধারণ করেছে, গর্ভে নিয়ে বারবার ক্লিনিকে ছোটাছুটি করেছে, তারপর চিৎ হয়ে প্রসব করেছে, এখন বছরের পর বছর ইস্কুলের সামনে বসে আছে। একটি মহিলা দু-পা ছড়িয়েই বসেছে, যেমন ছড়াতে হয় বিয়োনোর সময়; বিয়োনোর অভ্যাসটি তার যায় নি মনে হয়, হয়তো তার পেটে আরেকটি এসেছে, হায়রে রাত্রির ক্ষৎকালীন উন্মাদনা, তাই ঠিক মতো। বসতে পারছে না। ওইটিকে নিয়েও তার এখানে আসতে হবে বছরের পর বছর। আমি এদের শরীরে জং দেখতে পাচ্ছি, শ্যাওলা দেখতে পাচ্ছি। ক্লান্ত, খুব ক্লান্ত এরা। অনেক বছর ধরে হয়তো একটা ভালো পুলকও বোধ করে নি, কেঁপে ওঠে নি; নিয়মসম্মতভাবে নিচে শুয়েছে। এদের স্বামীরা ঝকঝকে অশ্বের মতো বিচরণ করে চলছে নিশ্চয়ই, আমিও বিচরণ করছি; তারা ক্লান্ত নয়, না কি তারাও ক্লান্ত?