এর বেশি আর কোনো সাঁকো না থাকা। রফিকের বাবা মাঝেমাঝেই মারতো ওর মাকে, আর রফিকের মা ওর বাবাকে খাইনকার পো বলে গালি দিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার জন্যে বাক্স গোছাতো, কিন্তু তার যাওয়া হতো না। অথচ ওই রফিকের বাবাই আমাদের বাড়ি এসে মাকে ভাবিছার বলে মধুরভাবে ডাকতো, কদবানকে। তামাক সেজে আনতে বলতো, কদবানের হাত থেকে হুঁকো নেয়ার সময় অনেকক্ষণ ধরে তার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকতো। সিরাজের বাবা সকালের খাবার খেয়েই বাজারে চলে যেতো, দুপুরের পর বাড়ি ফিরতো, আবার খেয়েই বাজারে চলে যেতো; আমরা যখনই যেতাম দেখতাম সে চায়ের দোকানে বসে আছে, চা খাচ্ছে গল্প করছে বিড়ি টানছে। সব সময়ই হাসি হাসি তার মুখ। কিন্তু সিরাজের মায়ের সাথে ধমক না দিয়ে সে কথা বলতো না।
তখন থেকেই আমার সন্দেহ হতে থাকে, সন্দেহটা গম্ভীর হতে থাকে যে বাবা ও মা হওয়ার মধ্যে কোনো একটা গভীর সংকট রয়েছে; এ-কাঠামোটি ভেতরে ভেতরে। দুর্বল, বাইরে থেকে তাকালেই শুধু মনে হয় বাবা ও মায়ের মধ্যে একটা শক্ত ব্রিজ। রয়েছে, কিন্তু ভেতরে ঢুকলে দেখা যায় অনেক আগেই ব্রিজটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে কোনো ব্রিজ নেই, তাদের মধ্যে একটা প্রথা রয়েছে। বাবার সঙ্গে মায়েরও কোনো ব্রিজ ছিলো না, কিন্তু ছোটো খালার সাথে বাবার একটা ব্রিজ ছিলো, তা দুজনের মুখ। দেখলেই বোঝা যেতো। মাও তা বুঝতো বলেই মনে হয়, তবে মায়ের তাতে কোনো আপত্তি ছিলো বলে মনে হয় না। আমি আমাদের দোতলার দক্ষিণ দিকের একটি ঘরে থাকতাম, বাবা থাকতেন উত্তর দিকের একটি ঘরে, মা ও আমার ছোটো বোনটি একতলায় থাকতো। দোতলায় আরো একটি ঘর ছিলো, মা তাতে থাকতে পারতো, বাবা তাকে সেখানেই থাকতে বলতো, বা বাবার সাথে একই ঘরে থাকতে পারতো, কিন্তু মা বোনটিকে নিয়ে একতলায় থাকতেই পছন্দ করতো। ব্রিজ তৈরিতে মায়ের কোনো আগ্রহ আমি দেখি নি। খালাকে মা-ই মানুষ করেছে, বিয়েও দিয়েছে, খালাকে মা নিজের মেয়ের মতোই আদর করতো; এবং আমি দেখেছি খালাকে মা বাবার ঘরে পাঠিয়ে দিতো মাঝেমাঝেই কখনো পান হাতে, কখনো বাবার ঘরটি গুছিয়ে দেয়ার জন্যে, কখনো বাবার হাতপা টিপে দেয়ার জন্যে। অবশ্য আমাদের বাড়িটা ছিলো। খালারই বাড়ি, ছোটোবেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে আছে খালা, শুধু বিয়ে হওয়ার পর একটু দূরে সরে গেছে; তাই খালা আমাদের বাড়ির কোথায় যাবে বা যাবে না, সেটা কারো বলে দিতে হতো না; আর সে কোন ঘরে কখন কী করবে, তাও কারো বলার অপেক্ষা করতো না। আর খালার সব কিছুই এতো ঝলমলে ছিলো যে তাকে দেখলে সবাই ঝলমল করে উঠতো। আমি ঘরে ফিরে যখন দেখতাম আমার ঘরটি ঝকঝক করছে, বুঝতাম খালা আমার ঘর ঘুরে গেছে; এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই যে। খালাকে দেখতে পাবো, তাতেও নিশ্চিত থাকতাম। খালা এসে হাজির হতো, হাতে কোনো খাবার।
হাসান ভাই, মেজো কাকার ছেলে, পড়তো কলেজে, তাকে আমি তখন আমার। স্বপ্নের নায়ক মনে করতাম। তার চুল আঁচড়ানোর ভঙ্গি আমাকে মুগ্ধ করতো, হাঁটার সময় বাঁ হাতে যেভাবে লুঙ্গি ধরে হাঁটতো, তাতে মুগ্ধ হতাম। আমি তার মতো চুল আঁচড়ানোর স্বপ্ন দেখতাম, আর ঠিক করে রেখেছিলাম যখন লুঙ্গি পরবো, তখন হাসান ভাইয়ের মতো বাঁ হাতে লুঙ্গি ধরে হাঁটবো। হাসান ভাই তৃতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পাশ করেছিলো, তখন আমি তৃতীয় বিভাগ কাকে বলে বুঝতে পারি নি; ভেবেছিলাম আমি যেমন ক্লাশে থার্ড হয়েছি, হাসান ভাইও তেমনি থার্ড হয়েছে। আমাদের বাড়িতে। যে-আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিলো, তাতে আমার সন্দেহ ছিলো না যে হাসান ভাই থার্ড হয়েছে। হাসান ভাই মুনশিগঞ্জ থেকে ফিরে এসে পাগল করার মতো গল্প শোনাতে লাগলো আমাকে। একটি মেয়ের ছবি দেখিয়ে বললো, এর নাম সুচিত্রা, সিনেমার নায়িকা। জানিস চাইলে এই মেয়েটিকে আমি বিয়ে করতে পারি। মেয়েটির মুখ দেখে। আমার বুক কাঁপছিলো, অতো সুন্দর মুখ আমি আর দেখি নি, আমার একটু ঈর্ষা হলো; কিন্তু হাসান ভাইকে আমি অবিশ্বাস করতে পারলাম না, আমার খুবই বিশ্বাস হলো যে হাসান ভাই চাইলেই ওই মেয়েটিকে বিয়ে করতে পারে। হাসান ভাই বললো, তবে সিনেমার নায়িকা আমি বিয়ে করবো না, কলেজের কতো ভালো ভালো মেয়ে আমার পেছনে ঘোরে। আমার রক্ত ঝলক দিয়ে উঠলো। তখন থেকে হাসান ভাই ঘর থেকে বেরোলেই আমাকে ডাকে, আমি তার পেছনে আর পাশেপাশে হাটি; হাসান ভাই। আমাকে একের পর এক মেয়ের গল্প শোনাতে থাকে। হাসান ভাই আমার বুকের ভেতরে মেয়ের পর মেয়ে ঢুকিয়ে দেয়, মেয়েদের মুখ ঠোঁট চুল বাহু আমার চোখে। নতুনভাবে রূপ ধরতে শুরু করে। তখন হাসান ভাইয়ের জগত মেয়েতে ভরে গেছে, মেয়ে ছাড়া তার আর কোনো কিছুতে স্বাদ নেই, কোনো কথা বলে সুখ নেই; আমিও তার কথা শোনার জন্যে ব্যাকুলতা বোধ করতে শুরু করেছি। বিকেল হলেই আমাকে বলতো, চল। কখনো সড়ক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, কখনো নদীর পারে বসে হাসান, ভাই আমাকে তার বুক বোঝাই মেয়েদের গল্প শোনাতো।
হাসান ভাই, আপনি সব সময় মেয়েদের গল্প করেন কেনো? আমি কখনো জিজ্ঞেস করতাম।
তুই বুঝবি নারে মেয়েরা কী জিনিশ, হাসান ভাই বলতো, এই বয়সে মেয়ে ছাড়া আর কিছু ভালো লাগে না।