আপনি ধার আদায় করতে জানেন না, দেবী স্মিত হেসে বলেন, আপনাকে আমার ছেলেবেলার সেই বালকটির মতো মনে হচ্ছে, সেও ধার আদায় করতে জানতো না।
আমি তো এখনো ধার দিই নি, আমি বলি, যা দিই নি তা আদায় করবো কীভাবে?
আপনি কি এখন ধার দিতে পারবেন, দেবী বলেন, যদি আমি বলি আমার পঞ্চাশ হাজার টাকার খুব দরকার? আমি দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, আর দেবী বলেন, মনে করুন আপনি ধার দিয়েছেন, আমি নিয়েছি।
দেবীকে আমি ধার দিয়েছি, এমন একটা বোধ হয় আমার, দেবী তা তুলে নিতে বলছেন, আমি দেবীর দিকে এগিয়ে যাই, আমি আর বালক নই, আমিও পারি, ধার। আদায় করে নিতে পারি, যা জমশেদ মোল্লা পারে আমাকে তা পারতে হবে, আমাকে হতে হবে জমশেদ মোল্লা। না, আমি হয়ে উঠবো শিল্পী, স্থপতি, কবিও হয়ে উঠবো আমি, এমন কিছু আমি আজ সৃষ্টি করবো যা এ-বিষণ্ণ করুণ সুন্দর রূপসী শরীরে আর কেউ সৃষ্টি করে নি। অন্যরা ঋণ আদায় করে নিয়েছে আমি ঋণ আদায় করবো না, তার কোনো অধিকার আমার নেই, আমি আমার ঋণ শোধ করবো এমন কিছু সৃষ্টি করে যা কখনো এ-শরীরে কেউ সৃষ্টি করে নি। আমি প্রথম দেবীর পদতল স্পর্শ করি, পদ্মের। মতো দুটি পদতল, ওষ্ঠ দিয়ে চুম্বন করি, দেবী শিউরে ওঠেন, হয়তো কেউ এর আগে এখানে ওষ্ঠ রাখে নি; আমি তাঁর প্রতিটি পদাঙ্গুলিকে জিভ ও ওষ্ঠের সাহায্যে পুজো করতে থাকি। তিনি আমার পুজো গ্রহণ করেন। আমি ধীরে ধীরে ওষ্ঠ ও জিভ দিয়ে পুজো করতে করতে পবিত্র দুটি জানু পাই, দুটি প্রবাল দ্বীপের মতো জানু, সেখানে আমি অনেকক্ষণ বাস করি। দেবী বারবার কেঁপে উঠতে থাকেন। আমার মনে হতে থাকে। জাহাজডুবির পর আমি খড়কুটোর মতো ভাসতে ভাসতে দেবীর জানুদ্বীপে এসে আশ্রয় পেয়েছি। এক সময়, অনন্ত কাল পরে যেনো, আমি দেবীর মন্দিরের দ্বারে পৌঁছেই, ছায়াচ্ছন্ন মন্দির, বিশুদ্ধ তার জ্যামিতি, আমি মুগ্ধ হই, তার দরোজার পর দরোজার। রঙিন আভায় আমার চোখ ভরে যায়। আমি মন্দিরের দ্বারে এক পরম পুজোরীর মতো সাষ্টাঙ্গে অবনত হই, এ-দরোজা দিয়ে অনেক আদিম জন্তু প্রবেশ করেছে আর বেরিয়ে এসেছে, কোনো গোলাপ পাপড়ি পড়ে নি। আমি আমার ওষ্ঠের আর জিভের গোলাপ। ফোঁটাতে থাকি, গোলাপের পর গোলাপ ফোঁটাতে থাকি, ওষ্ঠ আর জিভ দিয়ে মন্দিরের দরোজা খুলতে থাকি, ভেসে যেতে থাকি দেবীর অনন্ত ঝরনাধারায়। পৃথিবীতে কি। তখন ভূমিকম্প হয়েছিলো, হোটেলটি কি তখন চুরমার হয়ে গিয়েছিলো? দেবী গলে সম্পূর্ণ অমৃতধারায় পরিণত হয়ে যান। আরো ওপরে, আরো ওপরে, আরো ওপরে; দেবীর যুগল চাঁদের জ্যোৎস্নায় আমার মুখ আলোকিত হয়ে ওঠে। এখন আমার সামনে সম্পূর্ণ উন্মোচিত দেবী। রওশনকে মনে পড়ছে, দেবীর চাঁদ নিয়ে আমি খেলা করি, খেলা করি, খেলা করি; দেবী আর আমি একাকার হয়ে যাই। অনন্ত ঢেউ উঠতে থাকে, মহাজগত তরঙ্গিত হয়ে উঠতে থাকে, প্লাবনে সূর্যাদতারা ডুবে যায়, দেবী আর আমি চরম অন্ধকারের জ্যোতিতে মিশে যাই।
এতো সুখ আছে, দেবী অনেকক্ষণ পর চোখ মেলে বলেন, আমি জানতাম না। দেবী লতার মতো পেচিয়ে আছেন আমাকে।
আমি তো ঋণ আদায় করি নি, সুখ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলাম, আমি বলি। আপনার কি মনে হয় আমি সত্যিই ধার চাই? দেবী বলেন, সত্যিই কি আমার টাকার খুব দরকার?
তা আমি জানি না, আমি বলি।
আমার টাকার বেশি দরকার নেই, কিন্তু আপনি তো দেখেছেন আমাকে ঘিরে সব সময়ই ওরা আছে, দেবী বলেন, আপনি তো বোঝেন ওরা আমার কাছে কী চায়?
তা আমি বুঝি, আমি বলি।
ওরা আমার জন্যে সব করতে প্রস্তুত, দেবী বলেন, যদি আমি শুধু দেহখানি দিই। আমি তো সবাইকে দেহ দিতে পারি না। আমি যদি বিয়ে করে ফেলতাম ওরা আসতো, ওরা আমার জন্যে কিছু করতো না, ওরা আমাকে বিখ্যাত করে তুলেছে, বিখ্যাত হতে আমার ভালোই লাগে। আমি আবার বিয়ে করলে ওরা আমাকে বিখ্যাতও করতো না, ওরা আমাকে বেদনার দেবীরূপে দেখতে চায়, আমিও তাই হয়ে উঠেছি। আমার একটি দেবর তো লেগেই আছে আমাকে বিয়ে করার জন্যে, কিন্তু দেবরের সাথে ঘুমোচ্ছি ভাবতেই আমার ঘেন্না লাগে।
আপনি ধার কেনো নেন? আমি জানতে চাই।
ওদের ঠেকানোর জন্যে। পঁয়ষট্টি বছরের এক নামকরা বুড়ো আমাকে ভাবী ডাকে, আর ঘুমোতে চায় আমার সাথে। তার সাথে আমি কেনো ঘুমোবো? জমশেদ মোল্লা। আমাকে ভাবী ডাকে, আর ঘুমোতে চায় আমার সাথে। তার সাথে আমি কোনো ঘুমোবো? সেজন্যেই আমি ধার চাই। বুড়ো বেশি টাকা দিতে পারবে না, আমি তার কাছে চল্লিশ হাজার ধার চাই, একবার সাধ মেটানোর জন্যে সে চল্লিশ হাজার ধার দেয়, পরে আর তার সাধ থাকে না। কিন্তু জমশেদ মোল্লার টাকা আছে, সাধেরও শেষ নেই। তার থেকে আমি পাঁচ হাজার ডলারের কম ধার নিই না, আর তা শোধ করি দু কি তিনবারে।
আপনার ভক্ত অনেক, অনেককে তৃপ্ত রাখতে হয় আপনাকে, আমি বলি।
আমি ওদের স্বভাব বুঝি, দেবী বলেন, একেকজনের স্বভাব অনুসারে আমি খাদ্য দিই। একটি ভক্ত আছে দেশি কুকুরের মতো, ও বেশি কিছু চায় না, ওকে আমি ডান। পায়ের বুড়ো আঙুলটি চুষতে দিই, চুষতে পেরে ওর সুখের শেষ থাকে না। দেবী চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ, তাঁর গভীর ঘুম পেয়েছে, তার চোখ বুজে আসছে, চোখ বুজতে বুজতে বলেন, আরো কিছু সৃষ্টি করুন, যাতে আমি আবর্জনার কথা ভুলে যেতে পারি।