যদি আমি এখন দেবীর কাছে যাই, মনে করা যাক তিনি একলা আছেন, তিনি যদি আমার কাছে ধার চান, মাত্র দশ হাজার টাকাই ধার চান, আমি কি তাকে দিতে পারবো? আমার উচিত ছিলো বেশ কিছু টাকা, বিশ হাজারের মতো, তুলে অফিসেই রেখে দেয়া; কে জানে কখন দেবী ধার চাইবেন, কে জানে কখন আমার ধার দিতে ইচ্ছে করবে। যেমন এখন আমার ইচ্ছে করছে দেবীকে ধার দিতে। দেবীকে ধার দেয়ার আগ্রহটি আমার ভেতরে তীব্র হয়ে উঠছে, যদিও দেবী আজো আমার কাছে ধার চান নি, কিন্তু আমার ভেতরে ধার দেয়ার তীব্র কামনা জাগছে। আমি ধার দিতে চাই শুধু দেখার জন্যে দেবী কীভাবে ধার শোধ করেন। দেবীর ধার শোধ করার মুহূর্তগুলো আমি অনুভব। করতে চাই, উপলব্ধি করতে চাই, অভিজ্ঞতার মধ্যে পেতে চাই। এখন কি সরাসরি চলে যাবো দেবীর মন্দিরে? দেবীকে কি সরাসরি গিয়ে ধার দেয়া যায় দেবী না। চাইলেও? আর গিয়ে যদি দেখি জমশেদ মোল্লাকে নিয়ে তিনি কাজে যাচ্ছেন, পাঁচ হাজার ডলারের কোনো কিস্তি শোধ করতে যাচ্ছেন, বা তাকে ঘিরে বসে আছেন তাঁর কামনাব্যাকুল স্তবগানরত ব্রাহ্মণবৃন্দ? ফিরোজা কি তার দেবরের টেলিফোন পেয়েছে? তারা কি এখনো কথা বলছে? ফিরোজাও কি মাঝেমাঝে দেবরের কাছে থেকে ধার নেয়? ফিরোজা কীভাবে দেনা শোধ করে? দেবীকে আমি টেলিফোন করি।
ভাবী, আমি মাহবুব, আমি বলি, আমাকে কি চিনতে পারছেন?
আপনাকে চিনবো না তা কি হতে পারে! খিলখিল করে হাসেন দেবী, তাঁর খিলখিল হাসির একটা রঙ দেখতে পাই আমি, তার খিলখিল হাসি শুনে মনে হয় আমি কয়েক মাইল দূর থেকে টেলিফোন করছি না, তার বুকের ওপর শুয়ে আছি, সেখান থেকে খিলখিল হাসিটা উঠছে। তিনি বলেন, আর তো এলেন না।
আসতে তো সব সময়ই ইচ্ছে হয়, আমি বলি। তাহলে আসেন না কেনো? দেবী বলেন। অপেক্ষায় ছিলাম কোনো দিন আপনি আমার কাছে ধার চাইবেন, আমি বলি, তখন আসবো।
আবার খিলখিল হাসেন দেবী, তার হাসির রঙে দিকদিগন্ত ঢেকে যাচ্ছে, আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না, শুধু তার হাসির রঙ দেখতে পাচ্ছি, আশ্বিনের নদীর পারে কাশের। মেঘ দেখতে পাচ্ছি।
আমাকে ধার দিতে কি আপনার খুব সাধ হয়? দেবী বলেন।
অনেক দিন ধরেই ধার দেয়ার স্বপ্ন দেখে আসছি, আমি বলি।
তার সাথে আর কি স্বপ্ন দেখছেন? দেবী বলেন।
আপনি কীভাবে ধার শোধ করেন, আমি বলি।
দেবী আবার খিলখিল হাসেন, শিশির পড়ছে তাঁর গুচ্ছগুচ্ছ হাসির ওপর, শিশিরে ভিজে যাচ্ছে তার হাসি, তিনি বোধ হয় আর হাসতে পারবেন না।
দেবী বলেন, আমাকে সবাই ধার দিতে চায়, আমি না চাইলেও।
আমি বলি, আপনি ভাগ্যবান।
দেবী বলেন, আর সবাই ধার দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে আমি কীভাবে ধার শোধ করি দেখার জন্যে। আমি অবশ্য শোধ করে দিই। আপনি কি আজই আমাকে ধার দিতে চান?
আমি বিপদগ্রস্ত, আমার পকেটে ছ-সাত হাজারের বেশি হবে না; কিন্তু দেবী কি এতো কম ধার নেবেন, তাকে কি এতো কম ধার দেয়া যায়?
আমি বলি, ভাবী, আজই ধার দেয়ার মতো অবস্থা আমার নেই, দশের নিচে। কেমনে আপনাকে ধার দিই!
দেবী আবার খিলখিল হাসেন বলেন, আপনি তো জমশেদ মোল্লা নন যে পাঁচ হাজার ডলার ধার চাইবো, চলে আসুন, আজ আমার মনে ভালো নেই।
দেবীর মন ভালো নেই, মন ভালো না থাকলেই দেবীদের বেশি ভালো দেখায়, বেশি ভালো লাগে; বিষণ্ণতা মুখের ত্বককে কোমল করে তোলে, আজ দেবীকে আমার আরো বেশি ভালো লাগবে। আমি আর দেরি করি না, ড্রাইভার প্রথম ভেবেছিলো বাসায় যাবো, তারপর মনে করেছে লালমাটিয়া যাবে, তাকে আমি জিগাতলা যেতে বলি; দেবীর সত্যিই মন ভালো নেই, তিনি তৈরি হয়ে দরোজার পাশে দাঁড়িয়েই ছিলেন। গাড়ি গিয়ে থামতেই তিনি আমার পাশে উঠে বসেন, তাঁর ডান হাতটি আমার বাঁ। হাতের ওপর এসে পড়ে, একবার তাকান আমার দিকে, সত্যিই বিষণ্ণতায় তিনি আরো রূপসী হয়ে উঠেছেন। দেবীকে নিয়ে এখন কোথায় যাই? আমি সব সময়ই এতো। অপ্রস্তুত। দেবী আমাকে উদ্ধার করেন এক পাঁচতারা হোটেলের নাম বলে।
মন ভালো না থাকলে এই হোটেলটি আমার ভালো লাগে, দেবী বলেন, দশ তলায় উঠলে মনে হয় আমি আবর্জনার মধ্যে নেই।
আপনি কি আবর্জনার মধ্যে আছেন? আমি বলি।
আপনি বুঝতে পারেন না? দেবী বলেন। তাঁর হাতটি খুব উষ্ণ মনে হচ্ছে আমার, রওশনের হাতের মতো, মুঠোতে ধরতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ধরি না।
দশতলায় আমরা একটি কক্ষ নিই, কক্ষে প্রবেশ করি, দেবী আমার পাশে, দেবী। আমার সাথে, এখানে কোনো আবর্জনা নেই। দেবীর বিষণ্ণ শরীর থেকে আমি বিষণ্ণতার সুগন্ধ পেতে থাকি, ভেজা কাঁঠালচাপার গন্ধ, আমি বুঝে উঠতে পারি না দেবীকে নিয়ে আমি কী করবো? আমি কি আমার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত দেখতে পাওয়াকে সহ্য করতে পারবো, আমি কি পেরে উঠবো, যেমনভাবে পেরে ওঠে জমশেদ মোল্লা? আমাকে কি। এখন জমশেদ মোল্লা হয়ে উঠতে হবে? দেবী আমার থেকে কোনো ধার নেন নি, আমি কি করে তার কাছে থেকে ধার আদায় করে নেবো? দেবী গিয়ে বিছানার ওপর কাত। হয়ে শুয়েছেন, আমি এখনো দূরে দাঁড়িয়ে আছি, তার বিছানার পাশে যেতে আমার ভয় লাগছে, যেনো আমি এক পনেরো বছরের বালক, আমি ভয় পাচ্ছি। আমি কিছু পেরে উঠবো না। কিন্তু দেবী কি তা পছন্দ করবেন? তার কি মনে হবে না জমশেদ মোল্লারাই ভালো এই সব ইঞ্জিনিয়ারটিঞ্জিনিয়ারের থেকে? দেবী আমার দিকে স্মিত হেসে তাকিয়ে আছেন। আমি সামনের দিকে পা বাড়াতে পারছি না।