এক বন্ধুর সাথে প্রথম গিয়েছিলাম তার বাসায়, বন্ধুটি কোনো পূর্বধারণা দেয় নি। আমাকে, শুধু বলেছিলো আমাকে সে একটি অপূর্ব বিধবা দেখাবে; তরুণী, রূপসী, করুণাময়ী বিধবা, যা আমি আগে দেখি নি, পরেও দেখবো না। তাকে দেখে আমি মুগ্ধ হই, তাঁর রূপ আর করুণা অপার বলেই মনে হয় আমার। খুব দামি সৌন্দর্য আর বিষণ্ণতা তাঁকে আচ্ছন্ন করে ছিলো; তিনি একটি দামি শাড়ি পরেছিলেন, তবে তিনি যে-বিষণ্ণতা আর সৌন্দর্য পরে ছিলেন, তার দাম আরো অনেক বেশি, কোটি মুদ্রার বেশি। আমি তার থেকে বেশ দূরেই বসা ছিলাম, তিনি আমাকে মাঝেমাঝে দয়া করে দেখছিলেন, দূরকেও তিনি অবহেলা করেন না, স্মিত হাসিও বিলোচ্ছিলেন আমার দিকে তাকিয়ে, যেমন অন্যদের দিকেও তিনি তাঁর করুণা বিতরণ করছিলেন। অনেক ভক্ত এসেছিলো তার স্লিপারের তলে।
ভাবী, আপনাকে যতো দেখি ততোই মুগ্ধ হই, এক ষাট-বছর-পেরোনো বিখ্যাত ওই তরুণী বিধবাটির স্তব করছিলেন, কী করে যে আপনি এমন বেদনার মধ্যে এমন স্থির থাকতে পারছেন। আপনাকে দেখা মানে স্বৰ্গকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়া। একে আমরা ভাগ্য বলে মানি।
কিন্তু এই রাষ্ট্র, আরেক ষাট-ছোঁয়া বিখ্যাত বলছিলেন, ভাবীকে তার প্রাপ্য দিচ্ছে না। দাদা দেশের জন্যে যা করে গেছেন, তার জন্যে আমরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঋণী হয়ে থাকবো তার কাছে, ভাবীর কাছে। অথচ ভাবীকে জিগাতলার এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে (আট কামরার) পড়ে থাকতে হচ্ছে। ভাবীকে একটি ভবন বরাদ্দ করা উচিত। ছিলো বনানী কি গুলশানে (দাদা দুটি বাড়ি রেখে গেছেন বনানী আর গুলশানে); আমি অবশ্য এর জন্যে লড়াই করে যাবো।
আর, ভাবী বলছেন, আমি একটু জাতিসংঘের বৈঠকে সরকারি প্রতিনিধি হয়ে যেতে চেয়েছিলাম, নিউইঅর্ক শহরটা আমার ভালো লাগে বলে, কিন্তু তারা আমাকে দলে রাখতে চাচ্ছে না, এর আগে আমি মাত্র দু-বার গেছি বলে।
এজন্যেই দেশটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, আরেক স্বনামখ্যাত বলছেন, দাদার কাছে। দেশের যা ঋণ, তাতে ভাবী দু-বার কেনো দুশো বার যাবেন, তাতে কার কী বলার থাকতে পারে।
আমি দেখতে পাচ্ছিলাম তাঁদের জিভ থেকে লালা ঝরছে, জিভ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, স্তবগানের সাথে তারা উপভোগ করে চলছেন বিধবাটিকে; বিধবাও জানেন আর জানাটা উপভোগ করেন যে কিছুটা পরোক্ষ সম্ভোগের সুযোগ না দিলে ভক্তরা তাকে দেবী করে তুলবেন না। তবে এ-ভক্তরা শুধু চরণতলে থাকার মতো নয়, আরোহণের কামনা। তাদের চোখেমুখে জ্বলজ্বল করছে, সে-ই ভাগ্যবান যাকে দেবী নিজের বক্ষে স্থান দেন। আমার ওই দেবীকে মনে পড়ছে, আমার রক্তনালি জুড়ে যে-কর্কশ একটা আগুন জ্বলছে, তা স্নিগ্ধ হয়ে উঠতে পারে শুধু ওই দেবীর বিষণ করুণায়। কিন্তু আমাকে কি, যে একান্ত ভক্ত হয়ে ওঠে নি দেবীর, যে পদতলে গিয়ে দাঁড়িয়েছি মাত্র কয়েকবার, তার করুণা বিলোবেন? তিনি কি এতো অপার করুণাময়ী হয়ে উঠতে পেরেছেন? একবার গিয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবান বোধ করেছিলাম, তিনি আমাকে বসার ঘর থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন বারান্দায়, ছায়াঘেরা সেই বারান্দা, আমি কয়েক মিনিট একান্ত একলা তাঁর মুখোমুখি বসার অধিকার পেয়েছিলাম; আমার মনে আরো অধিকার পাওয়ার সাধ জন্ম নিতে যাচ্ছিলো। তখন এক বলিষ্ঠ পুরুষ প্রবেশ করেন, তাঁর জুতোর শব্দও বলিষ্ঠতা প্রকাশ করে, বুঝতে পারি এ-বলিষ্ঠ পুরুষ সরাসরি প্রবেশাধিকারপ্রাপ্ত দেবীর কাছে। বলিষ্ঠের পাশে দেবীকে মনে হচ্ছিলো পৌরসভার ট্রাকের চাকার পাশে বসা এক প্রজাপতি বলে, চাকা যখন ঘুরতে শুরু করবে প্রজাপতি তখন কংক্রিটে মিশে যাবে। দেবী আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন বলিষ্ঠ পুরুষ জমশেদ মোল্লার সাথে, নাম শুনে তাকে চিনতে পারি। দেশের এক প্রধাম কালোবাজারির পাশে নিজেকে আমার খুবই অসহায় লাগতে থাকে।
দু-তিন সপ্তাহ দেশে ছিলাম না, জমশেদ মোল্লা বললেন, তবে আপনার কথা সব সময়ই মনে হয়েছে। জমশেদ মোল্লা পকেট থেকে একটি প্যাকেট বের করে দেবীর হাত দিতে দিতে বললেন।
দেবী হেসে সেটি গ্রহণ করতে করতে বললেন, ড, না ট?
জমশেদ বললেন, ড।
দেবী জানতে চাইলেন, কতো?
জমশেদ বললেন, পাঁচ।
দেবী হাসলেন, বললেন, এ-ধারটা শোধ করতে বছরখানেক লাগবে।
জমশেদ বললেন, কেনো? আপনি অন্য কোথাও ধার করেন না কি?
দেবী বললেন, না করলে কি চলে?
জমশেদ একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, দরকার হলে আমার কাছেই ধার করবেন, অন্য কোথাও আপনি ধার করেন আমার ভালো লাগে না।
দেবী আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, মাঝেমাঝে ধার করতে হয়, জমশেদ ভাইর কাছেই বেশি ধার পাই। আপনার কাছেও চাইবো কোনো দিন।
আমি দেবীর খানিক করুণা লাভ করি; তিনি আমার কাছেও ধার চাইবেন, আমাকেও ধন্য করবেন দেবী, আমিও তার বিবেচনার বাইরে নই। দেবী বাইরে যাবেন, জমশেদ মোল্লার সাথে বাইরে একটা কাজ আছে দেবীর; না, দেবী আমাকে বিদায়। করে দিয়ে কাজটি বাসায়ই সম্পন্ন করবেন না, দেবীর বিবেচনা রয়েছে, জমশেদ
মোল্লার সাথে তিনি কাজ করতে চলে গেলেন, আমার দিকে তাকিয়ে করুণায় আমাকে সিক্ত করে দিলেন। দেবী বোধ হয় আজ রাতেই তার ধারের অংশবিশেষ শোধ করবেন, জমশেদ মোল্লাকে যেমন দেখাচ্ছে তাতে তিনি ধারের কিছুটা না তুলতে পারলে রাস্তায়। গিয়ে গোটা কয়েক মানুষ খুন করবেন। দেবী সবচেয়ে বেশি ধার পান জমশেদ মোল্লার কাছে, পাঁচ হাজার ডলার শোধ করতে তার বছরখানেক সময় লাগে, কেননা তিনি অন্যদের কাছেও ধার করেন, সেগুলো শোধ করতে হয় তাঁকে, সবার ধার এক সাথে শোধ করা যায় না। তবে কয় কিস্তিতে তিনি শোধ করেন পাঁচ হাজার ডলার? এক। কিস্তিতেই? না কি ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কিস্তি কম-বেশি হয়? মাসে দেবী একজনের কয় কিস্তি শোধ করেন? জমশেদ মোল্লার পাঁচ হাজার ডলার কি দেবী পাঁচ কিস্তিতে শোধ করবেন? তার মানে আড়াই মাসের কিস্তি? আমার কাছে যদি দশ হাজার টাকা ধার চান, দেবী আমার অবস্থা জানেন, তিনি নিশ্চয়ই আমার কাছে এর বেশি ধার চাইবেন না, তাহলে তিনি তা কয় কিস্তিতে শোধ করবেন? এক কিস্তিতেই? এক কিস্তিতেই দশ হাজার টাকা? আমার মতো ব্রিজ বানানো ইঞ্জিনিয়ার কি বারবার ধার দিতে পারবে?