নাশিন কি তোমার বন্ধু? আমি জিজ্ঞেস করি।
হু, অর্চি বলে।
শুনে আমি আরো ভয় পাই, এমন ভয়ঙ্কর বন্ধুদের মধ্যে আছে অর্চি!
নাশিনকে তুমি আর বন্ধু মনে কোরো না, আমি বলি।
আমার যে আর বন্ধু নেই, অসহায়ভাবে অর্চি বলে।
সে তোমাকে কোনো দিন ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিতে পারে, আমি বলি।
তাহলে আমি আর বন্ধু পাবো কোথায়? অর্চি কেঁদে ফেলে।
অর্চি কি আজো ওই বন্ধুদের সাথেই আছে? না কি তার কোনো বন্ধু নেই? সম্পূর্ণ। একাই আছে? ওর ঘরে সব সময় উচ্চ আওয়াজ হয়, মহাজাগতিক গোলমাল চলে, ক্যাসেট বেজেই চলে, ইংরেজি হিন্দি, চিৎকার ওঠে, ওগুলো অর্চি সহ্য করে কেমনে? ও কি আওয়াজের মধ্যেই থাকতেই পছন্দ করে, ওর মতো অন্যরাও? আমি আমার এক প্রিয় গায়িকার, যখন আমি গান শুনতাম, যখন আমি ছাত্র ছিলাম, একটি ক্যাসেট অনেক খুঁজে অর্চির জন্যে নিয়ে এসেছিলাম। অর্চি তার নাম শোনে নি, তার নাম শুনেই বমি করে ফেলতে চায়, শোনার মতোই ওর মনে হয় না, আর বাজনোর সাথে সাথেই। যেনো বমি করে ফেলে; আমার মনে হয় অর্চি আমার মুখের ওপরই বমি করে দিচ্ছে। দূরে কোথাও রেকর্ড বাজতো, কোনো বিয়ে বাড়িতে, ওই সুর কতো সন্ধ্যায় কতো রাতে গাছপালার ভেতর দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমার ভেতরে এসে ঢুকতো, আমার রক্ত কাঁপতে থাকতো; অর্চির রক্ত কাঁপে না, অর্চির রক্ত ঝা ঝা করে।
এ নিয়ে দুবার হলো, দিন সাতেক আগে একবার হয়েছিলো, আজ আবার হলো, ফোনটা আমি ধরলাম; ফোনটা আমার নয়, ফিরোজার; ফিরোজা বাথরুমে বলে আমি ধরলাম, ছেলেটি বেশ গভীর কণ্ঠে বলছে, ভাবী, আমি। ছেলেটি নিশ্চিত যে ফিরোজাই। ফোন ধরবে, আমি এ-সময়ে বাড়ি থাকি না, তাই সে হ্যালো বলেও সময় নষ্ট করে নি, ভাবীর কাছে তার এককতা জানিয়েছে, একটা ঝলমলে সাড়া প্রত্যাশা করেছে। আমি কি এখন বলবো, কাকে চান? বলাটা কি, শোভন হবে, বললে কি সে আমাকে–বলবে কাকে সে চায়? সে কি বলবে না, আমি দুঃখিত, রং নাম্বার। আমি বলি, ফিরোজা বাথরুমে আছে, আপনি একটু ধরুন। শুনেই টক করে ছেলেটি ফোন রেখে দেয়; একটু বোকাই দেখছি ছেলেটি বা একটু বেশি ঘাবড়ে গেছে, আমাকে একটু ভুল। নাম্বারও বলতে পারতো। বাথরুম থেকে কি ফিরোজা ফোনের শব্দ শুনেছে? যদি। ফিরোজা বুদ্ধিমান হয়, আমি আজো জানি না সে বুদ্ধিমান কি না, এবং ফোনের শব্দ শুনে থাকে, তাহলে ফিরোজা একটু দেরি করেই বেরোবে বাথরুম থেকে, যেনো আমি বুঝতে না পারি সে একটি ফোনের জন্যে উৎকণ্ঠিত ছিলো। ছেলেটি নিশ্চয়ই পরে ফোন করবে, আমাকে নিয়ে একটু হাসাহাসিও করবে হয়তো, কীভাবে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে বলতে বলতে দুজনে হাসবে; কিন্তু ফিরোজা বাথরুম থেকে বেরোলে আমি কী বলবো? বলবো কি তার একটি ফোন এসেছিলো, আমার এক অচেনা অনুজ ফোন করেছিলো? ফোনটা যে নিশ্চিতভাবে ফিরোজারই তা আমি প্রমাণ করবো কীভাবে, আর না বলেই থাকবে কী করে? তার ফোন এসেছিলো, আমি ধরেছিলাম, এটা চেপে যাওয়া কি অসৎ কাজ হবে না, নিজেকে কি আমার একটা খুব ঈর্ষাকাতর স্বামী মনে। হবে না? ফিরোজা বেশ দেরি করেই বেরোয় বাথরুম থেকে। আমি কি ধরে নেবো। ফিরোজা ইচ্ছে করেই দেরি করে বেরিয়েছে বাথরুম থেকে, মুখ বারবার সাবান দিয়ে ধুয়েছে যাতে মুখে উৎকণ্ঠা উদ্বেগের কোনো ছাপ না থাকে?
তোমার একটা ফোন এসেছিলো, আমি বলি।
ফিরোজা বিব্রত হচ্ছে, ফোনের শব্দ সে শুনেছে মনে হয়। আসলেই কি বিব্রত হচ্ছে ফিরোজা? না কি তা আমার বোঝার ভুল? ফিরোজা কোনো আগ্রহ দেখায় না।
এ-ফোনটি আসবে বলে, ধরতে গিয়ে বিব্রত হবে বলেই কি ফিরোজা বাথরুমে। ঢুকেছিলো? আমি ফিরোজার মুখ পড়তে পারি না, তার মুখটি আমার কাছে এক অচেনা লিপিখচিত পৃষ্ঠা মনে হয়।
তোমার একটা ফোন এসেছিলো, আমি আবার বলি।
কে করেছিলো? ফিরোজা খুব আগ্রহহীন হতে চেষ্টা করে।
তোমার কোনো দেবর করেছিলো, আমি বলি।
বাজে কথা বোলো না, ফিরোজা বলে।
বাজে কথা বলছি না আমি, আমি বলি, ভাবীকে চাচ্ছিলো সে।
দেখো সবাইকে নিজের মতো মনে কোরো না, ফিরোজা বলে, তোমরা তো অফিসে গণ্ডা গণ্ডা মেয়েলোকের সাথে ফোন করেই সময় কাটাও।
তুমি রেগে যাচ্ছো, আমি বলি, আর ধরা পড়ে যাচ্ছো।
ধরা পড়ার কী আছে, ফিরোজা বলে, যাদের কাছে স্বামীরা ফোন করে না তাদের কাছে দেবররা তো ফোন করবেই।
আমি আর কোনো কথা বলি না, আমাকে বেরোতে হবে; বেরোনোর আজ ইচ্ছে ছিলো না, কিন্তু বেরোতেই হবে, আমার রক্ত এলোমেলো কাজ করতে শুরু করছে। বেরিয়ে কোথায় যাবো? অফিসে? অফিসেই যাবো। আমি তো রাত দশ এগারোটা পর্যন্ত অফিসেই থাকি, আজ বাসায় থাকবো ভেবেছিলাম, কিন্তু এখন আমাকে বেরোতে হবে। আমি অফিসে চলে যাই। ফিরোজাকে হয়তো তার দেবর আবার ফোন করেছে, আমি কি একবার বাসায় ফোন করে দেখবো ফোন অ্যানগেজড কি না? না, অ্যানগ্যাজড থাকলে আমার রক্ত আরো এলোমেলো হয়ে যেতে পারে; হয়তো অর্চি ফোনে কথা বলছে, আজকাল ওর খুব ঘন ঘন ফোন আসছে, তবু আমার মনে হবে ফিরোজা দেবরের সাথে কথা বলছে। নিজের কাছে নিজেকে ছোটো মনে হবে। না, আমি বাসায় ফোন করবো না; ফিরোজা কথা বলুক তার দেবরের সাথে। ফিরোজা কি দেবরের সাথে বেড়াতে যায়? কখন যায়? কোথায় যায়? কতো দিন ধরে যায়? কী করে? দেবরটি দেখতে কেমন? ফিরোজার সাথে বেশ মানায়? যেখানে ইচ্ছে যাক, যা ইচ্ছে করুক; আমি এখন কী করি? ফিরোজাকে কি এরই মধ্যে তার দেবরটি দেখেছে, সম্পূর্ণ দেখে ফেলেছে? ফিরোজা দেখতে দিয়েছে? মাঝেমাঝেই দেখে, আজো কি দেখার ইচ্ছে। আছে? ফিরোজা কীভাবে সাড়া দেয়? আমি রওশনকে দেখতে পাচ্ছি, একটি হাত। রওশনকে খুলছে, রওশনের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, রওশন কেঁপে কেঁপে উঠছে, রওশন শব্দ করে নিশ্বাস নিচ্ছে।
ফিরোজার একটি দেবর জন্ম নিয়েছে
ফিরোজার একটি দেবর জন্ম নিয়েছে, ফিরোজা আমার স্ত্রী, ধরে নিচ্ছি তারা মাঝেমাঝে ঘুমায়, আমি কি এখন তাদের দুজনকে খুন করতে বেরোবো, রক্তে বিবাহকে পবিত্র করবো? বিয়েতে আমরা কোনো শপথ করেছিলাম পরস্পরের প্রতি? আমার মনে পড়ছে না; মৃত্যু আমাদের পৃথক না করা পর্যন্ত আমরা একে অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবো, এমন কোনো শপথ আমরা করি নি, অন্তত আমার মনে পড়ছে না, বিয়েতে আমি কী বলেছিলাম তা-ই আমার মনে পড়ছে না। আমি বিশ্বস্ত নই, ফিরোজা বিশ্বস্ত নয়; কে কখন বিশ্বস্ত ছিলো? বিশ্বস্ত থাকতে হয় কেনো? আমি বাসায় ফিরে আসার পর আমার শরীরে কি মাহমুদা রহমানের ছাপ থাকে; ফিরোজা যদি আজ রাতে তার দেবরের সাথে মিলিত হয়, আমি ফিরে গিয়ে ফিরোজার শরীর তন্নতন্ন করে পরখ করি, তাহলে কি দেবরের কোনো ছাপ খুঁজে পাবো? আমি এখন কোথায় যাবো? মাহমুদা রহমানের কাছে যেতে পারি, রাত বারোটা পর্যন্ত থাকতে পারি, তাঁর বাচ্চা দুটি সারাক্ষণ পাশে বসে থাকবে আমার, ওদের জন্যে আইস্ক্রিম কিনতে হবে, যেতে ইচ্ছে। করছে না; পবিত্র সুন্দরী মহীয়সী বিধবাটিকে মনে পড়ছে, অনেক দিন ধরেই মনে। পড়ছে, বিধবা আমার মনে ঝিলিক দিচ্ছেন মাঝেমাঝে, অনেক দিন তার বাসায় যাওয়া হয় নি, তাঁর বাসায় যাবো? এখন কি তিনি বাসায় থাকবেন তার বাসায় কি খুব ভিড় থাকবে? যে-কয়েকবার গেছি খুব বিখ্যাত মানুষদের সাথে দেখা হয়েছে, এক সোফায়। অততগুলো বিখ্যাত আমি কখনো দেখি নি, অতো বিখ্যাতদের পাশে আমাকে মানায় না; আর বিখ্যাতদের মুখ থেকে কেমন বিশ্রী একটা গন্ধ বেরোয়, পাশে বসে কথা–বলতে থাকলেই আমি ওই গন্ধটা পেতে থাকি, সহ্য করা বেশ কষ্টকর হয়ে ওঠে। সৌন্দর্যের পাশে ওই বিখ্যাত লোকগুলোকে আমার চাঁড়ালের মতো ঘিনঘিনে মনে হয়। তাঁরা অবশ্য স্তবগান জানেন, অসংখ্য স্তবগান তাঁদের মুখস্থ, তাঁরা রূপসী বিধবাটিকে দেবী করে তুলতে চাচ্ছেন, আর চাচ্ছেন দেবীর সঙ্গে একটু-আধটু ঘুমোনোর। দেবী চাইলে তারা না করবেন না। আমি তাকে দেবী করে তুলতে পারবো না, স্তবগান। কখনো শিখি নি, কিন্তু তিনি দেবী দেবী বোধ না করলে কারো ডাকে সাড়া দেন না মনে হয়। আমি কি সেই পবিত্র সুন্দরী মহীয়সীর কাছে যাবো, তাঁর করুণা চাইবো; তিনি কি আমাকে উদ্ধার করবেন উদ্দেশ্যহীনতা থেকে?