আমি আপনার উপপত্নী, তিনি হেসে বলেন।
আমি চমকে উঠে বলি, কেনো?
নিজেকে উপপত্নী ভাবতে ভালো লাগছে, তিনি বলেন, পত্নীর থেকে ভালো।
কারো উপপতি হতে আমার ভালো লাগবে না, আমি বলি, আমি পতি আর পত্নীর সম্পর্কের বাইরে থাকতে চাই।
তাহলে আমাদের সম্পর্কটি কী? তিনি বলেন, প্রত্যেক সম্পর্কেরই একটি নাম থাকা দরকার।
আমি নামহীন সম্পর্ক চাই, আমি বলি।
আমি নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম, ফিরোজা বলেছে আমি ঠিক মতো পারি না, এখানেও পারবো না, মাহমুদা রহমানও বিরক্ত হয়ে উঠবেন, আমাকে আর। টেলিফোন করবেন না, অন্য কাউকে করবেন, এমন একটি ভীতি আমার ছিলো। আমাকে পারতে হবে, এ-ব্রিজটির ভিত্তিকূপ শক্তভাবে স্থাপন করতে হবে আমাকে, যাতে কোনো বন্যায় ভেসে না যায়। আমি বিস্ময়করভাবে দক্ষ হয়ে উঠি, নদীর ওপর ব্রিজ বাঁধতে যেমন তেমনি শরীরের সাথে ব্রিজ বাঁধতে; আমার মনে হতে থাকে আবেগ হচ্ছে বন্যার মতো, তার কাজ কাঠামোর ওপর আকস্মিক অভাবিত চাপ প্রয়োগ করা, যার জন্যে কাঠামোটি প্রস্তুত নয়, তার কাজ কাঠামোকে বিপর্যস্ত করা; সম্পর্কের কাঠামোর বেলাও তা সত্য, তাই আবেগের সমস্ত চাপকে পরিহার করতে হবে। আমাকে হতে হবে দক্ষ প্রকৌশলী, কুশলী স্থপতি; নিরুত্তাপ, ঠাণ্ডা, লক্ষ্যের দিকে স্থির। আমি তা-ই হয়ে উঠি। আগে আমার ধারণা ছিলো শরীরের সাথে শরীরের সম্পর্ক একটি প্রত্যঙ্গের সাথে আরেকটি প্রত্যঙ্গের সম্পর্ক, এখন আমি আবিষ্কার করি ওই সম্পর্ক একটির নয়, সর্বাঙ্গের, যা ফিরোজার সাথে আমার হয় নি, হবে না কখনো। ফিরোজার সাথে আমার যে-সম্পর্ক, আমরা যে বিবাহিত, এটাকেও আমার একটি বাধা মনে হয়; বিবাহ সব কিছু খুলে ফেলতে দেয় না, একটা সীমার মধ্যে আটকে রাখে। আমাকে। মাহমুদা রহমানের সাথে সে-সীমাটুকু নেই, আমরা সীমাহীনভাবে অসভ্য। হয়ে উঠতে পারি, যা আমি পারি না ফিরোজার সাথে, তার সাথে আমার সভ্য থাকতে হয়। অর্চির সাথে দেখা হচ্ছে না আজকাল। অর্চি, আমার মেয়ে, বিস্ময়করভাবে বেড়ে উঠেছে যে কয়েক বছরে, যাকে দেখলে আমি প্রথম চিনতে পারি না, চিনতে পেরে বিস্মিত হই, তার সাথে এখন আমার দেখাই হচ্ছে না। ওকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে। বাসায় ফিরলে দেখি সে রজ্জব স্যারের বাসায় গেছে, নইলে আক্কাস আলি স্যারের বাসায় গেছে, নইলে পন্টু স্যারের বাসায় গেছে, নইলে গোপাল স্যারের বাসায় গেছে, স্যারদের দোকান থেকে মালের পর মাল কিনছে, ওই মাল না কিনলে চলবে না; অংক কেনার জন্যে দৌড়োচ্ছে হাতির পুলে, ইংরেজির জন্যে মগবাজারে, বাঙলার জন্যে আজিমপুরে, ইসলামিয়াতের জন্যে মক্কা না মদিনায়; অর্চি শুধু দৌড়োচ্ছ আর দৌড়োচ্ছে। ফিরোজা হুইশল দিচ্ছে, অর্চি দৌড়োচ্ছে; ফিরোজাও খুব খাটছে। আমার মেয়ে, অর্চি, দৌডুক; অনেক দৌড়োতে হবে ওকে, অনেক ইঁদুর দৌড়ে ওকে অংশ নিতে হবে। আমি যে দেখতে পাচ্ছি না ওকে, ভালোই; ওকে জিততে হবে, আমার চোখের। বাইরে থেকে হলেও ও জিতুক। ওর ঘরে সাধারণত আমি যাই না, ও পছন্দ করে না। ওর ঘরে কেউ যাক। ওর ঘরে গেলে দেখি সব কিছু ছড়িয়ে আছে, বিছানায় টেবিলে মেঝেতে ছড়িয়ে আছে নোংরা কাগজে ছাপা বই নিউজপ্রিন্টের খাতা ইংরেজি হিন্দি গানের ক্যাসেট, আর ও-ও সব সময়ই এলোমলো হয়ে আছে।
সব কিছু এমন ছড়ানো কেনো? আমি ভয়ে ভয়ে জানতে চাই।
ছড়ানো না থাকলে আমি কিছু খুঁজে পাই না, অর্চি বলে, সাজানোগোছানো ঘর আমি সহ্য করতে পারি না, যাচ্ছেতাই নোংরা লাগে।
আমরা তো সব গুছিয়ে রাখতাম, আমি বলি।
তোমরা খুব গেঁয়ো ছিলে, অর্চি বলে, যাও তো আব্বা, কথা বলার আমার একদম সময় নেই।
তোমার কি কিছু লাগবে? আমি আরেকটুকু কথা বলতে চাই।
আহা, আমার কিছু লাগবে না, অর্চি বলে, লাগবে কি না আমার ভাবতে হবে, এখন আমার ভাবার সময় নেই।
আমি আর কথা বলার সাহস করি না, ঘর থেকে বেরিয়ে আসি, যদিও ওর সাথে। আমার আরো কথা বলার ইচ্ছে করে। অর্চি কী পছন্দ করে, কীভাবে বেড়ে উঠছে, ও কী স্বপ্ন দেখে, কোনো স্বপ্ন দেখে কি না আমি জানি না। ওকে দেখলে মনে হয় ও কেন্দ্রে আছে, ওর বয়সে আমি কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে ছিলাম, কেন্দ্র কোথায় আমি জানতাম না, কেন্দ্রে যেতে হবে তাও কখনো মনে হয় নি, এখনো মনে হয় কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে আছি। অর্চির সাথে কথা বললে প্রতি মুহর্তেই আমি বোধ করি ও আছে কেন্দ্রে, আমি আছি প্রত্যন্তাঞ্চলে। এই সেদিনও এতোটুকু ছিলো, আমার সাথে একটা সম্পর্ক। ছিলো, এখন দশম শ্রেণীতে অর্চি, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক নেই, বা আছে যা আমি বুঝতে পারি না, কোনো দিন পারবো না। অর্চি যখন ছোট্ট ছিলো, আমি ওর সাথে খেলতাম; ও একটা ব্রিজকে জোড়া লাগিয়ে রেখেছে। ওর তখন নিঃসঙ্গ লাগতো। নিজেকে, এখন লাগে না; এখন অন্যের সঙ্গই অসহ্য মনে হয় ওর।
ছোট্ট বয়সে একবার অর্চি আমাকে নির্বাক করে দিয়েছিলো; সেদিন থেকে আমি, ওর সামনে পাহাড়ের মতো দাঁড়াতে পারি না, আজকাল একেবারেই পারি না। অর্চি আমাকে বলে, আব্বু, এসো আমরা ভাইবোন খেলি; আমি বিস্মিত হয়ে তাকাই, অসহায়ভাবে বলি, এসো, খেলি, কীভাবে খেলতে হবে বলো; অর্চি আমাকে চমৎকার চমৎকার আদেশ দিতে থাকে। সেদিন থেকে আমি আর ওর পিতা নই, ওর থেকে ছোটো কেউ, যাকে অর্চি আদেশ দিতে পারে। তবে অর্চি আমাকে ভাই বলে স্নেহ করেছে অনেক দিন, তারপর ভুলে গেছে; এখন অবশ্য আমার মনে হয় অর্চি আমাকে অমন কিছু বলুক, কিন্তু কিছুই বলে না। ওর দুঃখের কথা, ছোটোবেলায়, বলতো। আমাকে, এখন বলে না; ওর কি দুঃখ নেই, দুঃখের কোনো কথা নেই? ফোরে পড়ার সময় ওর খুব ইচ্ছে হতো ক্লাশের ক্যাপ্টেন হতে, বারবার চেষ্টা করেও হতে পারে নি; ক্যাপ্টেন হওয়ার জন্যে মাসে মাসে ওর ক্লাশে পরীক্ষা হতো, মন দিয়ে অর্চি পড়তো, পরীক্ষা দিয়ে এসে একটু কষ্টের সাথে বলতো, হতে পারলাম না, আব্বু। ওর কষ্ট দেখে আমার কষ্ট হতো, ভালোও লাগতো এজন্যে যে কষ্টে অর্চি ভেঙে পড়ে নি। ওদের ক্লাশের প্রথম মেয়েটি বারবার ক্যাপ্টেন হতো, তার সাথে পেরে উঠতে না অর্চি, সে-মেয়েটি নিশ্চয়ই খুব মেধাবী ছিলো। একবার অর্চি প্রায় ক্যাপ্টেন হয়েই গিয়েছিলো, কিন্তু ওই মেধাবী মেয়েটি তা মেনে নিতে পারে নি, তাকে ক্যাপ্টেন হতেই হবে। অর্চি খাবার টেবিলে প্রায় কেঁদেই ফেলে, খুব কষ্টে চোখের পানি চেপে রাখে, আমি ওর জন্যে খুব হাল্কা একটু কষ্ট পাই। সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে অর্চি ক্যাপ্টেন হয়ে গিয়েছিলো, আপা ঘোষণাও করে দিয়েছিলো; কয়েক মিনিট ক্যাপ্টেন থেকে খুব সুখ লাগছিলো। অচির। অমন সময় নাশিন, সে-মেধাবী মেয়েটি, অর্চির খাতা জোর করে ছিনিয়ে নেয়, নিয়ে পড়তে থাকে; পড়ে এক সময় লাফিয়ে চিৎকার করে ওঠে, আপা, অর্চি বাঁকা বি লিখতে ভুল করেছে; দৌড়ে মেয়েটি খাতা নিয়ে যায় আপার কাছে। আপা এবার চশমা মুছে চোখে লাগিয়ে দেখতে পায় সত্যিই অর্চি বাঁকা বি লিখতে ভুল করেছে, তাই আপা অর্চির ক্যাপ্টেনের পদ বাতিল করে দিয়ে নাশিনকে ক্যাপ্টেন ঘোষণা করে। অর্চি কেঁদে ফেলে, আমি শুনে ভয় পাই।