তুমি ঠিক ধরেছো, আমি বলি, আমাদের এক আইএ ফেইল ঠিকাদারের একটি ডক্টরেট বউ আছে, ইকোনোমিক্সে পিএইচডি, ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়; ঠিকাদার হতে ইচ্ছে করে।
তুমিও একটি ডক্টরেট বিয়ে করলে পারতে, ফিরোজা বলে, ইঞ্জিনিয়ার আর পণ্ডিতে বেশ মিল হতো।
তখন একথা মনে পড়ে নি, আমি বলি।
তুমি বউটিকে দেখেছো? ফিরোজা জানতে চায়।
না, আমি বলি, তবে বউটির কথা আমি মাঝেমাঝে ভাবি।
অন্যের বউয়ের কথা ভাবাই তো তোমাদের কাজ, ফিরোজা বলে, কী ভাবো তুমি তার সম্বন্ধে?
ডক্টরেট বউটি আইএ ফেইল ঠিকাদারটির নিচে কীভাবে শোয়? আমি বলি।
শোওয়া ছাড়া আর তোমার কথা নেই, ফিরোজা বলে।
আমি আর কথা বলি না। ফিরোজা বেশ মোটা হচ্ছে, সে যে সুখে আছে তার পরিচয় তার মাংস ঠেলে বেরোতে চাচ্ছে, আমার সন্দেহ হচ্ছে তার মগজেও মাংস জন্মাচ্ছে। আমি তাকে একটু ভয়ই পাচ্ছি মনে হচ্ছে, তাকে আমি এমন কিছু বলি না। যাতে মনে হয় আমি ভালো নেই, সব ঠিক আছে এটা আমি দেখাতে চাই। আমি ব্রিজ তৈরি করি, আমার ব্রিজ ভেঙে পড়ছে এটা কেউ জেনে ফেলুক আমি তা চাই না। ফিরোজার আমাকে বেশ বিব্রত করে মাঝেমাঝে।
তোমার অফিসে আজ দশ বারো বার ফোন করেছি, ফিরোজা দুপুরে খাওয়ার সময় বলে, একবারও পেলাম না।
অফিসে ফোন লেগেই আছে, আমি বলি, কারো না কারো সাথে কথা বলছিলাম হয়তো, তাই অ্যানগেইজড ছিলো।
কাজের ফোনে তো বেশি সময় লাগার কথা নয়, ফিরোজা বলে, অকাজের আলাপেই বেশি সময় লাগে।
তুমি কি মনে করো আমি অকাজের আলাপ করি ফোনে? আমি বলি।
আমার তো তাই মনে হয়, ফিরোজা বলে।
আমিও তো মাঝেমাঝে বাসায় লাইন পাই না, আমি বলি, তুমিও কি অকাজের আলাপ করো?
ফিরোজা চুপ করে যায়, আমার আর খেতে ইচ্ছে করে না; দুপুরে একটু বিশ্রাম নেয়ার ইচ্ছে ছিলো, এখন আর ইচ্ছে করে না; খাওয়ার পরই অফিসে ফিরে যাই। আমি হেসে উড়িয়ে দিতে পারি না ফিরোজার কথাগুলো, আমি আজ মিসেস রহমানের সাথে একটু বেশিক্ষণ ধরেই কথা বলছিলাম, বলতে ভালো লাগছিলো, অনেক দিন আমি মন। খুলে কথা বলি নি। ফিরোজার সাথে মন খুলে কথাই হলো না কখনো, রওশনের সাথে সেই কবে বলেছিলাম। মাহমুদা রহমান দু-তিন সপ্তাহ ধরে ফোন করছেন, একটু একটু করে আমাদের আলাপ বাড়ছে, তার কথা শুনতে ভালো লাগছে আমার। তিনি কি হাফিজুর রহমানের সাথে এমন মধুর মিষ্টি করে কথা বলতেন, যেমন আমার সাথে বলেন? আমরা কি সবাই বন্ধনের বাইরে গেলে মধুর হয়ে উঠি, তেতো হয়ে উঠি। বন্ধনের মধ্যে? মাহমুদা রহমান, আমার মনে হয়, গত দেড় দশক এমন মধুরভাবে কথা বলেন নি, যেমন আমিও বলি নি। হাফিজুর রহমান আমার সহকর্মী ছিলেন, মাসছয়েক আগে সৌদি আরব চলে গেছেন, তাঁর বিদায়ের পার্টিতে আমরা গিয়েছিলাম, ফিরোজাও ছিলো। এ-মাসেই মাহমুদা রহমান আমাকে ফোন করেন, খুব একটা দরকারে, হাফিজুর রহমান আল মদিনা থেকে আমারই সাহায্য নিতে বলেছেন, আমি তাকে সাহায্যও করেছি, সাহায্য করতে অনেক দিন পর আমার ভালো লেগেছে। মাহমুদা রহমান প্রতিদিনই একবার ফোন করেন। খুব অদ্ভুত লাগছে আমার যে তার ফোন। পেতে আমার ইচ্ছে করে, আমার ব্যক্তিগত নম্বরটিও আমি তাকে দিয়েছি, তিনি দশটা বাজলেই বেজে ওঠেন। ওই সময় আমি আমার ঘরে কাউকে দেখতে পছন্দ করি না। তিনি খুব নিঃসঙ্গ বোধ করেন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত, এ-সময়টাতে তাঁর কন্যা দুটি ইস্কুলে থাকে, ইস্কুলে দিয়ে এসেই তার নিঃসঙ্গ লাগতে থাকে, আমাকে ফোন করে তাঁর মনে হয় তিনি নিঃসঙ্গ নন। আমারও তাই মনে হয়, মনে হয় আমিও নিঃসঙ্গ নই। অনেক বছর পর আমার ভালো লাগছে তুচ্ছ কথা, সামান্য কথা, নিরর্থক কথা।
হ্যালো, আমি রিসিভার তুলি।
হ্যালো, আমি, ওপার থেকে কণ্ঠ ভেসে আসে, তিনি একক হয়ে উঠছেন।
অপেক্ষা করছিলাম, আমি বলি।
কার? মাহমুদা রহমান বলেন।
আপনিই বলুন, আমি বলি।
বলতে সাহস হয় না, তিনি বলেন, হাসেন, হাসির শব্দ শোনা যায়। আমি হাসি শুনতে থাকি, তিনি বলেন, আজ আসবেন?
ইচ্ছে হচ্ছে, আমি বলি।
তবে সময় হবে না, তিনি বলেন, তাহলে একটু বেশি করে কথা বলুন।
কেনো? আমি বলি।
আপনার কণ্ঠস্বর শুনতে ভালো লাগে, তিনি বলেন, আপনি কি গান গাইতেন, বা কবিতা লিখতেন? তিনি বলেন।
গান গাই নি কখনো, তবে একবার কবিতা লিখেছিলাম, আমি বলি।
কী নিয়ে লিখেছিলেন? তিনি বলেন।
আর্কিটেকচারের ওয়াজেদা মনসুরকে নিয়ে লিখেছিলাম, আমি বলি।
এখন কাউকে নিয়ে লিখুন না, তিনি বলেন।
আমি আসতে চাই, আমি বলি।
এখনই, তিনি বলেন।
একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমাদের, আমি একটা মুক্তির স্বাদ পাই, আমার চামড়ার তলে যে-জ্বরটি আমাকে পোড়াচ্ছিলো, সেটি ছেড়ে যায়; মাহমুদা রহমানকেও মুক্তির। স্বাদে বিভোর চঞ্চল মনে হয়। তার শরীরটি এতো দিন যেনো একটা ময়লা ডোবায় ডোবানো ছিলো, সেখান থেকে উঠিয়ে সেটিকে ঝকঝকে করে মাজা হয়েছে, তার ভেতর থেকে একটা দ্যুতি বেরোচ্ছে। প্রথম যেদিন সাড়ে দশটায় আমি তার উদ্দেশে। বেরোই আমার মনে হচ্ছিলো সবাই আমাকে দেখছে, ড্রাইভার ভেবেছিলো আমি মাওয়া সড়কে যাবো; সে একটু অবাক হয়, কিন্তু বিচলিত হয় না যখন আমি তাকে। লালমাটিয়ায় যেতে বলি। হাফিজুর রহমানের বাসা তারা অচেনা নয়, অফিসের গাড়ি নিয়ে সে বহুবার ওই বাসায় গেছে। আমরা একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। আমি কি। মাহমুদা রহমানকে ভালোবাসি, মাহমুদা রহমান কি আমাকে ভালোবাসেন? প্রশ্নটিকে অবান্তর মনে হয় আমার, আমাদের সম্পর্কটাকে ওই আবেগের থেকে অনেক বেশি মনে হয় আমার; আমরা একে অন্যকে মুক্তি দিয়েছি, এটা অনেক বড়ো প্রেমের আবেগ আর বিবাহের স্কুল প্রথা থেকে। আমরা কি কয়েক ঘন্টা টেলিফোনে বা মুখোমুখি বসে কথা বলে মুক্তি পেতে পারতাম, যদি না মুক্ত হতো আমাদের শরীর? মনের মুক্তির জন্যে। শরীরের মুক্তি দরকার। মাহমুদা রহমানের শরীরটিকে যেদিন আমি প্রথম সম্পূর্ণ দেখি এক অলৌকিক অনুভূতি হয় আমার, চোখের সামনে থেকে একটি পর্দা সরে যায়, আমি দেখি সুন্দরকে। এ-শরীরের সাথে জড়িত হওয়ার জন্যে আমার কি ভালোবাসা। দরকার এ-শরীরের অধিকারীকে? এমন প্রশ্ন আমার মনে জাগে; এবং মনে হতে থাকে এ-শরীর, নারীর শরীর স্বভাবতই সুন্দর, এর সাথে জড়িত হওয়ার জন্যে জন্মজন্মান্তরের। ভালোবাসা দরকার নেই, দরকার নেই কোনো পূর্ব-আবেগ, দেখামাত্রই একে ভালোবাসা যায়, জড়িত হওয়া যায় এর সাথে। আমি জড়িত হয়ে পড়ি, আমরা জড়িত হয়ে পড়ি। মাহমুদা রহমানের সাথে যদি আমার বিয়ে হতো, বা যদি তাকে এখন আমি বিয়ে করি, তাহলে আমরা পরস্পরের কাছে যা পাচ্ছি, পরস্পরকে যা দিচ্ছি, তা কি পেতাম, তা কি দিতাম, তা কি পাবো, তা কি দিতে পারবো? আমরা দুজনের কেউই বিয়ের কথা ভাবি না, দুজনেই আমরা তা পরখ করে দেখেছি।