আমি বেড়ে উঠেছি সবুজের মধ্যে-আমাকে ঘিরে ছিলো গাছপালা; আমি বেড়ে উঠেছি নীলের নিচে-আমার মাথার ওপর ছিলো জমাট নীল রঙের আকাশ; আমি বেড়ে উঠেছি জলের আদরে-আমাকে ঘিরে ছিলো নদী, আষাঢ়ের খাল আর ভাদ্রের বিল; এবং আমি বেড়ে উঠেছি নারীপুরুষের মধ্যে আমাকে ঘিরে ছিলো নারী, পুরুষ, তাদের শরীর, কাম, ভালোবাসা। আমি গাছপালার ভেতরে ঢুকতে পেরেছি, আকাশের নিচে হাঁটতে পেরেছি, জলে সাঁতার কাটতে পেরেছি; কিন্তু নারী আর পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে ঢুকতে পারি নি; আমি বুঝতে পেরেছি ওটি নিষিদ্ধ এলাকা, ওই এলাকায় সরাসরি ঢুকতে পারা যাবে না, কারো কাছে কিছু জানতে চাওয়া যাবে না, শুধু দূর থেকে দেখতে হবে, দেখে চোখ বুজে ফেলতে হবে, এবং চোখ বুজে দেখতে হবে। আমারও একটি শরীর ছিলো, আমার শরীরেরও কতকগুলো একান্ত ব্যাপার ছিলো-ছোটোবেলা থেকেই আমি তা বোধ করে এসেছি, কিন্তু সেগুলোর কথা কাউকে বলতে পারি নি। ক্ষুধা লাগলে বলেছি, সাথে সাথে সাড়া পড়ে গেছে; মাথা ধরলে বলেছি, তাতে আরো সাড়া পড়েছে; কিন্তু ওই ক্ষুধা আর মাথা ধরার থেকেও ভয়ঙ্কর অনেক পীড়ন আমি টের পেয়েছি আমার শরীরের ভেতর, তা আমি কাউকে বলতে পারি নি। আমি বুঝতে। পেরেছি শরীর এক মারাত্মক আগুন, প্রত্যেকটি মানুষ বয়ে বেড়ায় একেকটি লেলিহান অগ্নি। আমি পুরুষ-অগ্নি দেখেছি, নারী-অগ্নি দেখেছি, তাদের গোপন দাউদাউ জ্বলা দেখেছি, নিভে যাওয়া দেখেছি; আমার মনে হয়েছে মানুষ সম্ভবত অন্যের সাথে সবচেয়ে নিবিড় সাঁকোটি তৈরি করে শরীর দিয়ে। মানুষের শরীর খুব মারাত্মক ব্যাপার, ছোটোবেলায়ই বুঝেছি আমি। আমি শরীর দেখে, নারীর আগুন দেখে প্রথম কবে কেঁপে উঠেছিলাম? আমার মনে নেই, কারোই হয়তো মনে থাকে না; কিন্তু আজো চোখ বুজলে ঝিলিকের পর ঝিলিক দেখতে পাই। চোখ বুজে তাকালে আমি মাছরাঙা দেখতে পাই, আমের বোল দেখি, টিয়েঠুটো আমগাছে সিঁদুর দেখি, চিল দেখি, আর দেখতে পাই আমাদের কাজের মেয়ে, যে আমার থেকে অনেক বড়ো ছিলো, কদবানের বুক। ভরে দুটি সবুজ পেঁপে,–সে ঘর ঝাট দিচ্ছে, তার সবুজ পেঁপে কাঁপছে, সে গোসল। করে আমার সামনেই লাল গামছা দিয়ে মুছছে পেঁপে, আমি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। আমার অন্ধ চোখের কথা কেউ জানে না, কদবান কখনো টেরও পায় নি।
পুরুষদের আমি ছোটোবেলা থেকেই এক বিস্ময়কর প্রাণী হিশেবে দেখে এসেছি; মনে হয়েছে এর ক্ষুধাতৃষ্ণা কখনো মিটবে না। আমারও একদিন এমন ক্ষুধা দেখা দেবে ভেবে আমি ভয় পেয়েছি, উল্লাসও বোধ করেছি। আমাদের বুড়ো চাকরটি তার বউকে বেশ মারতো, তার রোগা বউটি তার ভয়ে কাঁপতো, বউর সামনে সে কখনো হাসতো না; কিন্তু কদবানকে দেখলে সে গলে যেতো, তার ভাঙা গাল হাসিতে ভরে উঠতো। কদবানের গোসল করার সময় সে ঘাটের পাশের মরিচ আর কচু খেত নিড়াতে শুরু করতো, কচুপাতার আড়াল থেকে তাকিয়ে থাকতো কদবানের দিকে, এমনভাবে তাকাতো যেনো কিছু সে দেখতে পায় না। কদবানও তাকে খাটাতো, এবং কদবান তাকে খাটালে তার সুখের শেষ থাকতো না। কোনো কোনো দিন গোসলের পর কদবান তাকে ডাকতো, সে দৌড়ে ঘাটে গিয়ে উপস্থিত হতো। কদবান তাকে শাড়ি ধুয়ে দেয়ার আদেশ দিতো, আর সে আনন্দের সাথে কদবানের শাড়ি ধুতে শুরু করতো, মনে হতো কদবানের যদি গোটাদশেক শাড়ি থাকতো তাহলে সন্ধ্যে পর্যন্ত সেগুলো ধুয়ে তার প্রাণমন ভরে উঠতো। কদবানকে একটু ছোঁয়ার জন্যে তার হাত কাপতো। কদবানের হাত থেকে হুঁকো নেয়ার সময় তার হাত কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে পড়তো কদবানের। হাতের ওপর, তখন তার হাত আর নড়তো না; কদবান ঠেলা দিয়ে তার হাতে হুঁকো। ধরিয়ে দিতো। দক্ষিণের বাড়ির শালু ফুপুর দিকে কে চঞ্চল হয়ে তাকাতো না? শালু ফুপুকে দেখলে আমি মাটির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। চকচকে কালো ছিলো তার গায়ের রঙ, বুক দুটি সাংঘাতিকভাবে উঁচু, আর পেছনের দিকটা ভয়ঙ্কর; সে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি ঝড়ের বেগে যেতো, তার বুক ঢেউয়ের মতো কাঁপতো, তার পেছনটা নৌকোর মতো দুলতো; সে গিয়ে দাঁড়াতে কারো রান্নাঘরের দরোজায়, কারো বড়ো ঘরের দরোজায়, উঁচু গলায় কথা বলতো; আবার ঝড় জাগিয়ে অন্য কোনো বাড়িতে যেতো। আমি একদিন শুনতে পাই বাবা তাকে ডাকছেন কালো শশী বলে। শশী শব্দের অর্থ তখন আমি জেনে গেছি, কিন্তু কালো শশী শোনার পর আমার ভাবনাগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে যায়, কালো চাঁদের কথা ভাবতে ভাবতে আমার রক্তনালি ভরে উজ্জ্বল অন্ধকার ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
ছোটো খালা বেড়াতে এলে আমাদের খুশির শেষ থাকতো না, এবং বাবাকেও খুব খুশি দেখাতো। ছোটো খালা আমাদের বাড়ি দু-এক মাস পরপরই বেড়াতে আসতো, তাকে দেখলে আমরা সবাই খুশি হয়ে উঠতাম। তার ঝলমলে রঙ আর গোলগাল মুখ দেখে আমাদের বুক ভরে উঠতো, কেননা ছোটো খালা মানেই ছিলো আদর, আরো আদর, এবং আরো আদর। আমি তখন বড়ো হয়ে গেছি, তবু খালা আমাকে ঘষে ঘষে গোসল করিয়ে দিতো, চুল আঁচড়ে দিতো; ইস্কুলে খাওয়ার জন্যে আধুলি বা টাকা দিতো। চমৎকার চমৎকার রান্না তৈরি করতো ছোটো খালা, আনন্দে আমাদের বাড়িটা। ঝলমল করে উঠতো। সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন বাবা, যদিও তা দেখা যেতো না, কিন্তু আমি দেখতে পেতাম; ছোটো খালার নাম ধরে বাবা ডাকতেন, একটা সুর ঝরে পড়তো বাবার গলা থেকে; ছোটো খালা পাখির মতো উড়ে গিয়ে উপস্থিত হতো, কখনো পান নিয়ে কখনো তামাক নিয়ে, কখনো শুধুই একটা ঝলমলে মুখ নিয়ে। মায়ের নাম ধরে ডাকতে বাবাকে কখনো শুনি নি। মায়ের সাথে বাবার আসলে কোনো কথাই হতো না। বাবার সাথে মায়ের কোনো ঝগড়া ছিলো না, মাকে বাবা কখনো গালাগালিও করতেন না, মাকে অনেকক্ষণ না দেখলে তোর মা কইরে বলে আমার। কাছ থেকে মায়ের খবর নিতেন; কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বাবার মুখে কখনো আভা ফুটে উঠতে দেখি নি, আর মাকেও কখনো চঞ্চল হয়ে উঠতে দেখি নি বাবাকে দেখে বা না দেখে। বাবা ও মায়ের মধ্যে যতোটুকু কথা হতো, তার সবটাই কাজের। কথা; আর কাজের কথা মানুষের বেশি থাকে না বলে তাদের বিশেষ কথাই হতো না। আমি আরো কয়েকটি বাবা আর মা দেখেছি; রফিকের, সিরাজের, রোকেয়ার মা ও বাবাকে দেখেছি, দেখে বুঝেছি মা ও বাবার কাজ মা ও বাবা হওয়া, এবং তাদের মধ্যে