তোমার ঘরে ঢুকলে আমি পাগল হয়ে যাবো, আমি বলি।
কেনো? রওশন জিজ্ঞেস করে, আর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে।
আমি জানি না, বলি আমি।
তোমাকে পাগল দেখতে আমার খুব ভালো লাগবে, হাসে রওশন, তবে একেবারে পাগল হয়ে যেয়ো না।
যদি হয়ে যাই? আমি বলি।
তাহলে পাগলের বউ হয়ে আমাকে থাকতে হবে চিরকাল, রওশন আমার চোখের মণির ভেতরে তার চোখের মণি গেঁথে দিয়ে হাসে।
আমার ভেতরটা কেঁপে ওঠে-বউ! কী সুন্দর শব্দ! রওশন বউ হবে আমার, রওশন নিজে বলছে একথা! সারা পৃথিবীকে, সব চাঁদতারাগ্রহনক্ষত্রকে, চিৎকার করে শোনাতে ইচ্ছে করছে। রওশন আমার খুব কাছাকাছি, আমার মুখোমুখি; দুটি হাত সে আমার। বাহুর ওপর রেখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি বলি, আবার ওই কথাটি বলো।
রওশন মুখ উঁচু করে আমার চোখে চোখ রেখে জলের ঘূর্ণির মতো তার ঠোঁট বাঁকিয়ে বনের সবচেয়ে সুন্দর পাখিটির মতো বলে, বউ।
আমি কাপছি, আরো শুনতে ইচ্ছে করছে আমার, বলি, কার?
রওশন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, তোমার।
আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, আমার পৃথিবী কাঁপছে, চঞ্চল হয়ে নাচছে। আমি রওশনকে খুব আস্তে জড়িয়ে ধরি, তার চুলের ঘ্রাণ নিই, রওশন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
একটি ছোট্ট খাট রওশনের, একটি টেবিল রওশনের, টেবিলে কয়েকটি বই আর পাউডার আর স্নোর কৌটো রওশনের, একটি চেয়ার রওশনের, দুটি জানালা রওশনের, আর জানালা পেরিয়ে একটি বাঁশবাগানের সবুজ দৃশ্য রওশনের। রওশন আমাকে চেয়ারে বসতে বলে, আর সে পা ঝুলিয়ে বসে খাটে।
রওশন আমার হাত দুটি তার হাতে নিয়ে আঙুল দেখতে থাকে, নখ দেখতে থাকে, এবং বলে, এ-আঙুলগুলো কখনো ভালো করে দেখতে পাই নি।
আমি হাত টেনে নিতে চাই, রওশন বলে, এ-হাত দুটি আমার, তোমাকে শুধু রাখতে দিয়েছি, তাই বেশি টানাটানি কোরো না তো বলে হাসে রওশন।
আমি বলি, তোমার নখ সুন্দর।
রওশন বলে, মিছে কথা; তোমার নখ সুন্দর। দেখি তো তোমার নখ বড়ো হয়েছে কিনা?
রওশন আমার নখ খুঁটতে থাকে, আর বলে, তুমি একটু চুপ করে বসো, আমি তোমার নখ কেটে দিই। রওশন টেবিলের ড্রয়ার থেকে ব্লেড বের করে।
তুমি সত্যিই আমার নখ কাটবে নাকি? আমি হাত টেনে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে বলি।
তুমি দেখো তো আমি কী করি, রওশন আমার হাত টেনে নিয়ে খুব মসৃণভাবে নখ কাটতে থাকে। নখের টুকরোগুলো সে জমিয়ে রাখে তার বাঁ হাতে; এবং বলে, জানো। এগুলো দিয়ে আমি কী করবো?
জানি না তো, আমি বলি।
একটি ছোট্ট লাল কৌটোতে নখের টুকরোগুলো রাখতে রাখতে রওশন বলে, এগুলো আমি জমিয়ে রাখবো, মাঝেমাঝে খুলে দেখবো এগুলো তোমার নখ, দেখতে আমার ভালো লাগবে।
আমি রওশনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, আর বলি, তুমি তো আমার নখ দেখবে, কিন্তু আমি কী দেখবো?
তোমার কী দেখতে ইচ্ছে করে? রওশন জিজ্ঞেস করে।
আমার ইচ্ছে করে কৌটোয় করে তোমার আঙুল আমার ড্রয়ারে রাখি, একটি আঙুল আমাকে দেবে? আমি বলি।
রওশন দু-হাত বাড়িয়ে বলে, তোমার যেটি ইচ্ছে করে কেটে নাও; বলো, তোমার কোনটি কেটে নিতে ইচ্ছে করে?
আমি আমার মুঠোর ভেতর রওশনের আঙুলগুলো চেপে ধরে রওশনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, বলি, সবগুলো।
রওশন বলে, নাও, এগুলো তোমার।
আমি রওশনের দু-হাতের আঙুলগুলো আমার গালে ঘষতে থাকি, কপালে ঘষতে থাকি, নাকে ঘষতে থাকি।
রওশন তর্জনীর ডগা দিয়ে আমার নাক ঘষতে ঘষতে বলে, তোমার নাকে খুব মিষ্টি মিষ্টি ঘাম জমেছে।
তাতে কী হয়েছে? আমি বলি।
তোমার বউ তোমাকে খুব ভালোবাসবে, রওশন হাসে।
আমার ইচ্ছে করছে রওশনকে জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু আমি ধরি না; যদি রওশন কিছু মনে করে।
রওশন বলে, তোমার একগুচ্ছ চুল যদি তুমি আমাকে দিতে!
কী করবে চুল দিয়ে? আমি বলি।
মাঝেমাঝে দেখবো, মনে হবে তোমাকে দেখছি, রওশন বলে, আজকাল সারাক্ষণ তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে। একটু থেমে বলে, আমাকে সারাক্ষণ দেখার ইচ্ছে যদি কারো হতো!
একজনের হয়, আমি জানি, আমি বলি, দিনরাত দেখার ইচ্ছে হয় তার।
রওশন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, একবার শুধু তুমি তার নাম বলো, আমার কানে কানে একবার শুধু তার নাম বলো।
আমি রওশনের কানে কানে বলি, মাহবুব।
রওশন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে, তার নাম দুবার বলো, তিনবার বলো, চারবার বলো, একশোবার বলো, সারাদিন বলো, সারারাত বলো, মাহবুব, মাহবুব, মাহবুব।
রওশনের চুলে ঢেকে যাচ্ছে আমার নাকমুখ, সুগন্ধে ভরে উঠছে আমার আত্মা, আমার রক্ত। আমি রওশনের মাথাটি দু-হাতে ধরে চুলের ভেতর চোখ মুখ নাক। ঢুকিয়ে দিয়ে ঘ্রাণ নিই।
তোমার চুলের সুগন্ধে আমার প্রাণ ভরে গেছে, আমি বলি।
ইচ্ছে হলে আরো ঘ্রাণ নাও, রওশন বলে।
আমি রওশনের চুলের ঘ্রাণে আমার প্রাণ আরো ভরে তুলতে থাকি। তারপর রওশনের মুখটি আমি নিই আমার অঞ্জলিতে।
রওশন, তুমি চোখ বোজো, তোমাকে আমি দেখবো, আমি বলি।
রওশন চোখ বোজে; আমি রওশনের মুখের নতুন রূপ দেখে অন্ধ হয়ে যাই। রওশন অনেকক্ষণ পর চোখ খোলে, আমার মনে হয় আমাদের গ্রামে ভোর হলো। এখন ডালে। ডালে পাখি ডেকে উঠবে, ফুল ফুটবে।
রওশন আমার নাকের নিচে আঙুল বুলোয় আর বলে, তোমার গোঁফ উঠছে, কী। নরম। একটু পরে বলে, তুমি কিন্তু গোঁফ রেখো না।
আমি জিজ্ঞেস করি, কেনো? গোঁফ আমার ভাল্লাগে না, রওশন বলে, আর হাত বুলোতে থাকে আমার মুখে, গালে, চিবুকে, গলায়।