বেশ রাত হয়েছে, এবার আমি উঠি। রওশন আমার সাথে নারকেল গাছ পর্যন্ত আসে। রওশনদের চাকর বারেক, যে আমার থেকে দশ বছর বড়ো হবে, হারিকেন নিয়ে চলে আমার সাথে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্যে। আমি ডুবে আছি রওশনের বাহুর মধ্যে বুকের মধ্যে তাল তাল কোমলতার মধ্যে; আমি স্বপ্নের সবুজ ঘাসের প্রান্তরে। হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগ্ধ বালকের মতো হাঁটছি।
বারেক বলে, মাহবুব ভাই, আপনে একটা মাখনের মতন বউ পাইবেন।
আমি কোনো কথা বলি না।
বারেক আবার বলে, রওশন আফা আপনার লিগা পাগল, সারা দিন পত চাইয়া থাকে। আপনে এমুন একটা বউ পাইবেন যা দুইন্নাইতে আর অয় না।
আমি কোনো কথা বলি না, বারেককে থামিয়ে দিতেও ইচ্ছে হয় না, বরং খুব ভালো লাগে বারেকের কথা। আমি চুপ করে থাকি; নইলে, আমার ভয় হয়, বারেক হয়তো বুঝে ফেলবে যে আমি মাখনের মধ্যে ডুবে আছি।
বাসায় ফিরে ভাতে আমি রওশনের কোমলতা বোধ করি, পানি পান করতে গিয়ে পানিতে আমি বোধ করি রওশনের কোমলতা, বই খুলতে গিয়ে বোধ করি ওই। কোমলতা। আমি যদি এখন লোহা ছুঁই, যদি আমার বুকে এসে লাগে কোনো পর্বত থেকে ছুটে আসা প্রকাণ্ড পাথরখণ্ড, তাহলেও আমি কোমলতা বোধ করবো। রওশন কীভাবে উঠে এসেছে চেয়ার থেকে আমি দেখি নি, কীভাবে জড়িয়ে ধরেছে আমাকে আমি দেখি নি; আমাকে জড়িয়ে ধরার সময় তার মুখ কেমন দেখিয়েছে, ঠোঁট বেঁকেছে কেমনভাবে, তাও আমি দেখি নি; আমি আজ সন্ধ্যায় রওশনকে দেখেছি শুধু আমার ত্বক আর নাসিকা দিয়ে। কোমলতা আর সুগন্ধ আমাকে ঢেকে ফেলেছে। রওশনের মাংস থেকে যে-গন্ধ আমার ভেতরে ঢুকেছে, আমি তার পরিচয় জানি না; ওই গন্ধ হয়তো হরিণের হয়তো বকুলের হয়তো ঘাসের হয়তো আগুনের হয়তো মেঘের হয়তো জ্যোৎস্নার হয়তো রক্তের, আমি জানি না, আমি কোনো দিন জানবো না। আমি বই খুলে বসি, জানালা দিয়ে নারকেল গাছ আর আকাশের দিকে তাকাই, কুয়াশা নেমে। আসছে দেখতে পাই, আমার শরীর আমার পাঁজর তাল তাল কোমলতায় ঢেকে যেতে থাকে।
রওশন যদি বেড়াতে গিয়ে থাকে? রওশনকে কি একা বাড়িতে রেখে যাবে রওশনের মা-বাবা? কি বলে রওশন বেড়াতে না গিয়ে বাড়িতে থাকবে? সকাল থেকেই এসব প্রশ্ন। দেখা দিচ্ছে আমার মনে। পড়তে ভালো লাগছে, পড়তে পড়তে রওশনকে ভাবতে সুখ লাগছে। রওশন যদি বেড়াতে না গিয়ে থাকে, কী করছে তাহলে রওশন? বই পড়ছে? আমার কথা ভাবছে? চিঠি লিখছে? যদি বেড়াতে গিয়ে থাকে, তাহলে কী করছে? আমার কথা ভাবছে? যদি রওশন বেড়াতে গিয়ে থাকে, তাহলে রওশন কি হাঁটতে পারছে? তার পা কি নদীপারের বালুতে আটকে যাচ্ছে না? না, রওশন বেড়াতে যেতে পারে না; রওশন বলেছে সে বেড়াতে যাবে না, তাই রওশন বেড়াতে যাবে না। আমার জন্যেই যাবে না; আমি কান্দিপাড়ায় নেই, আমি যেখানে নেই রওশন সেখানে কেননা যাবে! সেখানে রওশনের কী সুখ! আজ যদি আমাদের বাড়ির সবাই বেড়াতে যেতো, তাহলে আমি কি যেতাম? যেতাম না, সামনে আমার পরীক্ষা আছে বলে? সেজন্যে নয়, আমি যেতাম না, কারণ সেখানে রওশন নেই। তবে আমি ছেলে, আর সামনে আমার পরীক্ষা, তাই আমি বেড়াতে না যেতে পারি; কিন্তু রওশন যাবে না কেনো? সে মেয়ে, সামনে তার পরীক্ষাও নেই, তাই সে কী করে বেড়াতে না গিয়ে পারবে? ইচ্ছে হচ্ছে। একবার গিয়ে দেখে আসি; কিন্তু না, দুপুরের আগে যাবো না; রওশন দুপুরে যেতে। বলেছে আমাকে, দুপুরেই যাবো; দুপুর পর্যন্ত আমি শুধু রওশনকে ভাববো, আর পড়বো, আর রওশনের তাল তাল কোমলতা অনুভব করবো।
দুপুরে বেরিয়েই ভয় পাই আমি, যদি গিয়ে দেখি রওশন নেই? তখন আমি খুব অন্ধকার বোধ করবো না? আমি কি তখন বাড়ি ফিরে আসতে পারবো? তখন আমি কি কান্দিপাড়ার দিকে হাঁটতে শুরু করবো? পথে পথে রওশনের পায়ের দাগ খুঁজতে খুঁজতে হাঁটতে থাকবো? রওশনের পায়ের দাগ খুঁজতে আমার ভালো লাগবে। গিয়ে দেখি রওশন দাঁড়িয়ে আছে বাধানো কবরের পাশে; কবরটিকে আমার গোলাপবাগান বলে মনে হয়, কেননা তার পাশে এক বিশাল গোলাপের মতো ফুটে আছে রওশন।
সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, রওশন বলে, তোমার দুপুর এতো দেরি করে হয়!
আমার ভয় হচ্ছিলো তুমি হয়তো নেই, বেড়াতে গেছে, আমি বলি, কী যে ভয় করছিলো!
না থাকলে তুমি কী করতে? রওশন হাসে। কান্দিপাড়ার দিকে হাঁটতে থাকতাম, আমি বলি।
সত্যি? রওশনের চোখে লাল লাল গোলাপ ফুটতে থাকে; বলে, আজ বেড়াতে যেতে হলে আমি পাগল হয়ে যেতাম।
কেনো? আমি জানতে চাই বা আমি জানতে চাই না।
কারণ সেখানে তুমি নেই, রওশন বলে, তুমি যেখানে নেই সেখানে কিছু নেই। বলে আজকাল আমার মনে হয়।
আজকাল তোমার এমন ভুল মনে হয় কেনো? আমি হেসে বলি।
তা তুমি বুঝবে না, রওশন অভিমান করে; এবং আমার ভালো লাগতে থাকে একথা ভেবে যে রওশনের চোখের পাতায় হয়তো অশ্রুর সৌন্দর্য দেখতে পাবো। রওশন বলে, এটা অংক নয় যে তুমি সহজে বুঝবে।
রওশন আমাকে নিয়ে রওশনদের দোতলার দিকে হাঁটতে থাকে; আর বলে, আজ দোতলাটি আমাদের।
আমরা দোতলায় ঢুকি, রওশন দরোজা বন্ধ করে দেয়; সিঁড়ি দিয়ে আমরা ওপরে। উঠি;–আমাদের একজনের হাতে আরেকজনের হাত।
আজ তোমাকে আমার ঘর দেখাবো, রওশন বলে, তোমার একটুও ভালো লাগবে না, খুব বিচ্ছিরি আমার ঘর।